ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন আইনজীবীকে নিয়ে বহু প্রশ্নের জবাব মেলেনি এখনও

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২৫ আগস্ট ২০১৫

তিন আইনজীবীকে নিয়ে বহু প্রশ্নের জবাব মেলেনি এখনও

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ জঙ্গী অর্থায়নের ঘটনায় সুপ্রীমকোর্টের তিন আইনজীবীর গ্রেফতারের ঘটনা নিয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। তদন্তসংস্থা র‌্যাব সন্দেহজনক বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের উৎস খুঁজে পেলেও এ অর্থ কার মাধ্যমে পেয়ে গ্রেফতারকৃত আইনজীবীগণ চট্টগ্রামভিত্তিক হামজা ব্রিগেড নেতা মনিরুজ্জামান ডনের তিনটি এ্যাকাউন্টে প্রদান করেছেন তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এছাড়া এ পর্যন্ত হামজা ব্রিগেডের ২৮ নেতাকর্মী তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানিয়েছেন, ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার মাধ্যমেই অর্থায়নের ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে দুবাইয়ের নাগরিক আল্লামা লিবদি ও তাদের সংগঠনের এক বড় ভাই জড়িত। র‌্যাব এদের খুঁজছে কিন্তু লিবদি বিদেশী নাগরিক। তার এ দেশে না থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর বড় ভাই কে এবং তার বিস্তারিত পরিচয় কি তা নিয়ে র‌্যাবের তদন্ত চলছে জোরালোভাবে। বাঁশখালীর সাধনপুরের লটমনি পাহাড়ের গহীন অরণ্যে হামজা ব্রিগেডের জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার ও ৫ জনকে গ্রেফতারের পর ওই ঘটনায় সুপ্রীমকোর্টের তিন আইনজীবীকে চারদফা রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সোমবার এই তিন আইনজীবীকে হামজা ব্রিগেডের হাটহাজারীর ঘটনায় পৃথক পৃথক সময়ের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করেছে চট্টগ্রামের আদালত। সুপ্রীমকোর্টের তিন আইনজীবী জঙ্গী অর্থায়নের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও এ নিয়ে র‌্যাব তদন্তের আদ্যোপান্ত এখনও প্রকাশ করেনি। তবে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এ ঘটনায় বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের কারও কারও সম্পৃক্ততা পেয়েছে। যা নিশ্চিত হওয়ার জন্য র‌্যাব তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ধারণা দেয়া হচ্ছে এ ঘটনার সঙ্গে বিরোধী ওই রাজনৈতিক দলের কয়েকজন রাঘব বোয়াল জড়িত থেকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম-আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাকে জঙ্গী অর্থায়নের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। যদিও ব্যারিস্টার ফারজানা বলে যাচ্ছেন উক্ত অর্থ মামলা পরিচালনার জন্য গ্রহণ করার পর অভিযুক্তরা জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিনি তা ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু উক্ত অর্থ কোন চ্যানেলে তিনি পেয়েছেন তা এখনও স্বীকার করেননি। র‌্যাব সূত্র জানায়, তাদের তদন্তে আরও বহু প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। তাই তাদের হামজা ব্রিগেড সম্পর্কিত হাটহাজারীর ঘটনার মামলায় রিমান্ডে আনা হয়েছে। এদিকে, র‌্যাবের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোসাদ্দেক মিনহাজ এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের হওয়া এই মামলায় ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার ২ দিন এবং অপর দুই আইনজীবী হাসানুজ্জামান লিটন ও এ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপনের ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয়। জনাকীর্ণ আদালতে উভয় পক্ষের কৌঁসুলিদের বক্তব্য শুনে বিচারক এই আদেশ দেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ‘আল মাদ্রাসাতুল আবু বকর’ নামের একটি কওমি মাদ্রাসা থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ১২ জঙ্গীকে গ্রেফতারের ঘটনায় হাটহাজারী থানায় দায়ের করা মামলার আসামি হিসেবে সোমবার আদালতে উপস্থিত করা হয় এই তিন আইনজীবীকে। মাদ্রাসাটিকে জঙ্গী সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’ তাদের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল বলে স্বীকারোক্তি মিলেছে। ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার বাড়িও হাটহাজারী উপজেলায়। তাছাড়া তারই ব্যাংক এ্যাকাউন্টে রয়েছে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের প্রমাণ। শহীদ হামজা ব্রিগেডের এক সদস্যকে তিনি টাকা দিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও রয়েছে। এসব বিবেচনায় এই তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগ বেশ জোরালো। হাটহাজারীর মামলায় র‌্যাব-৭-এর এএসপি রুহুল আমিন তিন আসামির প্রত্যেকের ৫ দিন করে রিমান্ড প্রার্থনা করেন। সোমবার আদালতে র‌্যাবের করা রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করেন বিএনপিপন্থী এ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন ও এ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তারসহ আসামি পক্ষের বিএনপিপন্থী কৌঁসুলিরা। তারা আসামিদের জামিনের আবেদনও করেন। অপরদিকে, চট্টগ্রাম জেলা পিপি এ্যাডভোকেট আবুল হাশেমসহ রাষ্ট্র পক্ষের কৌঁসুলিরা জামিনের বিরোধিতা এবং রিমান্ড আবেদনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, ব্যারিস্টার শাকিলা নিজেই স্বীকার করেছেন যে, হেফাজতে ইসলামসহ জঙ্গী সংগঠনগুলোর মামলা তিনি পরিচালনা করেন। এতে প্রমাণ হয় যে, তার সঙ্গে জঙ্গীদের যোগাযোগ রয়েছে। সুতরাং জঙ্গী কারা এবং কোথায় হতে তাদের অর্থ আসে তা জানার জন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত জামিনের আবেদন নাকচ এবং আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিপক্ষের কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার তার বক্তব্যে বলেন, বাঁশখালীর মামলায় মঞ্জুর হওয়া রিমান্ডে ইতোমধ্যেই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আদালতে তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীও দিয়েছেন। একই আসামিদের একই ধরনের মামলায় আর জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন নেই। অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, দ-বিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী যেহেতু ঘটনাস্থল এবং মামলা আলাদা সেহেতু উভয় মামলাতেই আদালত জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিতে পারেন। শুনানি শেষে আদালত ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার ৪৮ ঘণ্টা এবং এ্যাডভোকেট হাসানুজ্জামান লিটন ও এ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপনের ৭২ ঘণ্টা করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। উৎস্যুক মানুষের ভিড় আদালতে ॥ জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগে তিন আইনজীবী গ্রেফতারের ঘটনাটি চট্টগ্রামে বেশ আলোচিত হয়। এর আগে বাঁশখালীর আদালতে তিন আসামিকে হাজির করা হলেও সোমবারই প্রথম তাদের উপস্থিত করা হয় চট্টগ্রাম আদালত ভবনে। ফলে এ নিয়ে চট্টগ্রামের আইনজীবী এবং সাধারণ মানুষের আগ্রহও ছিল ব্যাপক। ফলে চট্টগ্রামের বিচারিক হাকিম আদালতকে কেন্দ্র করে কর্মদিবস শুরু হওয়ার পর থেকেই এক ধরনের আকর্ষণবোধ পরিলক্ষিত হয়। সকাল ১০টার দিকে তিন আইনজীবী আসামিকে র‌্যাবের কড়া পাহারায় আদালত ভবনে আনা হয়। এদিন পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনিও ছিল স্বাভাবিক দিনের তুলনায় বেশি। বেলা ১১টার দিকে তাদের তোলা হয় আদালতে। প্রায় আধা ঘণ্টা শুনানির পর জামিন ও রিমান্ড আবেদনের বিষয়ে আদেশ হয়। এরপর ফের কঠোর নিরাপত্তায় তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে আদালতে উভয়পক্ষের বিপুলসংখ্যক আইনজীবী উপস্থিত থাকলেও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আমার মেয়ে পরিস্থিতির শিকারÑশাকিলার মা ॥ আদালতের আদেশের পর দুপুরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার মা বিএনপি নেতা ও সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের স্ত্রী ফরিদা ওয়াহিদ দাবি করেন, রাজনীতি করার কারণে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তার মেয়ে। তিনি বলেন, বিএনপির হয়ে মামলা লড়ায় মেয়েকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। জঙ্গীদের সঙ্গে অর্থ লেনদেন প্রসঙ্গে ফরিদা ওয়াহিদ বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে সে যে কোন মামলা নিতেই পারে। পরে কোন উপলব্ধি থেকে সেই অর্থ ফেরত দিয়েছে। এটি তো দোষ হতে পারে না। ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাকে মামলায় আসামি করার বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি দাবি করেন। উল্লেখ্য, হাটহাজারীর মেয়ে ব্যারিস্টার ফারজানা বিএনপির কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের কন্যা। তিনি বিএনপির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্যও। জঙ্গী সম্পৃক্ততা প্রমাণিত ॥ সোমবার রিমান্ড আবেদন শুনানির পর দুপুরে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি চট্টগ্রাম জেলা পিপি এ্যাডভোকেট আবুল হাশেম আসামিপক্ষের কৌঁসুলিদের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এই তিন আইনজীবী যে হামজা ব্রিগেডকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন তা জবানবন্দীতে স্বীকারও করেছেন। সে অর্থ স্রেফ মক্কেল ও আইনজীবীর মধ্যকার লেনদেন কিনা তা প্রমাণের বিষয়। তবে টাকার অঙ্কটি এত বড় যে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উদ্রেক করে। তিনি বলেন, ব্যারিস্টার শাকিলাসহ তিন আইনজীবী টাকা দিয়েছেন এবং জঙ্গীদের মামলা গ্রহণ করেছিলেন- এটিই জঙ্গী সম্পৃক্ততার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কোন আইনজীবীই তার মক্কেলের বিস্তারিত বিষয় না জেনে মামলা গ্রহণ করেন না।
×