ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে গরু মোটাতাজাকরণে কড়াকড়ি

কোরবানির সঙ্কট কেটে যাচ্ছে ॥ ১০ লাখ গরু আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৫ আগস্ট ২০১৫

কোরবানির সঙ্কট কেটে যাচ্ছে ॥ ১০ লাখ গরু আসছে

এম শাহজাহান ॥ কোরবানি ঈদ সামনে রেখে গবাদি পশু সঙ্কটের শঙ্কা কেটে যাচ্ছে। ঘাটতি ১০ লাখ গরু ভারত থেকে আসবে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও পদক্ষেপের ফলে। ইতোমধ্যে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের নজরদারি শিথিল করা হয়েছে। বাড়ছে গরু আমদানি। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলার সীমান্ত দিয়ে গরু আসা শুরু হয়েছে। শীঘ্রই ভারত সীমান্তের ৩১টি করিডর দিয়েই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যে গরু আমদানি পুনরায় চালু করা হবে। গরু বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে যাতে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে গোলাগুলি না ঘটে সে বিষয়েও সতর্ক থাকবে উভয় দেশ। এছাড়া কোরবানি সামনে রেখে দেশীয় গরু মোটাতাজাকরণে বিষাক্ত রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহার করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওইসব গরু হাটে আনা হলে জরিমানাসহ বেপারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বর্তমান সরকারের কঠোর নীতিমালার কারণে সে দেশ থেকে গরু আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আশঙ্কা ছিল, এ কারণে আগামী কোরবানি ঈদের সময় এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে অভ্যন্তরীণ বাজারে। কিন্তু সেই শঙ্কা কেটে যাচ্ছে উভয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে। কোরবানির চাহিদা মেটাতে ভারত থেকেই গরু আমদানি করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী কোরবানি ঈদ সামনে রেখে গরু সঙ্কটের কোন আশঙ্কা নেই। ওই সময় ৭০ লাখ গরু ও মহিষের প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের রয়েছে ৬০ লাখ। বাকি ১০ লাখ গরু ভারত থেকে আনা হবে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। এই বাণিজ্য ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভারত থেকে গরু আসা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, গরু আমদানির বিষয়ে সরকার যা করেছে তা সবই ইনফরমাল ট্রেড। এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে করার তেমন সুযোগ নেই। যুগের পর যুগ এভাবেই চলে আসছে। আর তাই ইনফরমাল ট্রেড বা অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে এবারও আমরা ভারত থেকে গরু আনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। ভারতে চাহিদার অতিরিক্ত গরু রয়েছে, আর আমাদের রয়েছে ঘাটতি। তাই বাণিজ্যের স্বার্থেই ওখান থেকে গরু আসবে। বাঁধ দিয়েও যেমন নদীর স্রোত আটকিয়ে রাখা যায় না তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে ভারত আমাদের গরু দেবে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। বাণিজ্য সচিব বলেন, প্রাণিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। তবে কোরবানি সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের নামে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ফরমালিনের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সফল হয়েছে। তেমনি ভোক্তা স্বার্থ-সংরক্ষণে দেশের প্রচলিত আইনে গরুর হাটে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। আশা করা হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে কোরবানিতে বিষমুক্ত গরু বাজারে পাওয়া যাবে। চাহিদা অনুসারে যোগান এবং বিষমুক্ত গরু সরবরাহের মতো বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। সূত্রগুলো বলছে কোরবানি ঈদে প্রায় ৭০ লাখ গরু ও মহিষের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এখন দেশে কোরবানি দেয়ার মতো গরু ও মহিষের মজুদ রয়েছে ৬০ লাখ। সেই হিসাবে ১০ লাখ গরুর ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে কোরবানির সময় গরু আমদানির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আগামী কোরবানি ঈদে বিপুল সংখ্যক গরু, মহিষ ও ছাগলের প্রয়োজন হবে। এই বিপুল পরিমাণ পশুর সিংহ ভাগ আসার কথা ভারত থেকে। কিন্তু সীমান্ত দিয়ে গরু সেভাবে আসছে না। তিনি বলেন, গরু আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন বিভিন্ন কায়দা কৌশলে আবার আমদানি হচ্ছে। তবে তার জন্যও গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। এছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকে কিছু গরু ও মহিষ আমদানি সম্ভব। আগে এসব গরু-মহিষ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এনে বাংলাদেশে পাঠাতেন। কিন্তু এখন তা বন্ধ। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারী পদক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়ছে। জানা গেছে, ভারত থেকে গরু আমদানির জন্য সীমান্তে ৩১টি করিডর স্থাপিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি করিডর আছে রাজশাহী অঞ্চলে, ১২টি। এছাড়া যশোর, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রামেও গরু আমদানির করিডর রয়েছে। এসব করিডর থেকেই অবৈধপথে আসা পশু বৈধ করা হয়। সরকারী নিয়ম অনুসারে প্রতিটি গরু মহিষের জন্য ৫০০ টাকা, দুম্বা বা ছাগলের জন্য ২০০ টাকা এবং উট, গাধা বা ঘোড়ার জন্য ৬ হাজার টাকা রাজস্ব দিতে হয়। তবে এ অর্থ আদায় করা হয় পশু বিক্রির মূল্য হিসাবে। জানা গেছে, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার সীমান্তপথে এক সপ্তাহ ধরে ভারত থেকে গরু আসার সংখ্যা বাড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি গরু আসছে। এ জেলার সীমান্তপথে গত এক মাসে প্রায় ৫০ হাজার গরু এসেছে ভারত থেকে। এ ছাড়া গত ১৫ দিনে ৫০ থেকে ৭০ হাজারের বেশি গরু এসেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ও উত্তরের নওগাঁ সীমান্ত পথে। ভারত থেকে পশু আমদানির বৈধ কোন পথ নেই। সীমান্ত এলাকার লোকজন ঝুঁকি নিয়ে ভারত থেকে পশু নিয়ে আসে চোরাই পথে। এসব গরু আনতে গিয়ে প্রায়ই বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান নিরীহ গরুর রাখাল ও ব্যবসায়ীরা। সূত্রগুলো বলছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যেসব গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, তার ৯০ শতাংশ ঘটনার পেছনেই থাকে সীমান্তে গরু বাণিজ্য। দেশে গরু উৎপাদন বাড়ছে ॥ আমিষের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই প্রাণিসম্পদ বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা বাড়ছে তার চেয়েও বেশি। দেশে মোট গরুর চাহিদার ৭০ শতাংশের যোগান দেয় দেশীয় খামারিরাই। বাকি ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে প্রতিবছর দেশে গরু উৎপাদন বাড়ছে। কুষ্টিয়া, যশোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের প্রায় জেলায় গরুর বড় বড় খামার গড়ে উঠছে। সরকারী সহযোগিতায় বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারাও গরু উৎপাদনে এগিয়ে আসছেন। ফলে গরু আমদানির চাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, আমদানি প্রক্রিয়া চাপে থাকায় আমরা এবার নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে বেশি মনোযোগী হব। ভবিষ্যতে আর আমদানির প্রয়োজন হবে না।
×