ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিসন্ধ্যায় আলোর মিছিল

৪০ প্রদীপের আলোয় পরাজিত অন্ধকার বঙ্গবন্ধুকে দেখা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৪ আগস্ট ২০১৫

৪০ প্রদীপের আলোয় পরাজিত অন্ধকার বঙ্গবন্ধুকে দেখা

মোরসালিন মিজান পনেরো আগস্ট গত হয়েছে। গত হয়েছে বটে, শোক কাটেনি। বাঙালীর ব্যথা বেদনা নানা ভাব ও ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকতাও ঢের হয়। হচ্ছে। তবে একটু আলাদা করে বলতে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এখানে বক্তৃতা নেই। বাহুল্য নেই। সন্ধ্যা হতেই প্রিয় পিতার প্রতিকৃতির সামনে অবনতমস্তক হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন ডাক্তাররা। কর্মকর্তা কর্মচারীরা যোগ দিচ্ছেন। সব শ্রেণীর, সকল ধর্মের মানুষ একটি জায়গায় সমবেত হচ্ছেন। অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী। তাই ৪০টি প্রদীপ। প্রতিদিন জ্বলছে। মোমের যৎসামান্য আলো। এই আলোতেও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠছে মহান নেতার মুখ। আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় জেগে ওঠছে ক্লান্ত করুণ প্রাণ। পুরো আয়োজনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের নিচতলায়। এখানে বিশাল দেয়ালে ততোধিক বিশাল বঙ্গবন্ধু। অনন্য সাধারণ ম্যুরালটি গড়েছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী হামিদুজ্জামান। ২০ বাই ১০ ফিট মাপের ম্যুরালে রাজনীতির কবি। অপেক্ষাকৃত সৌম্যশান্ত চেহারা। সাদা রং দেয়ালে সিমেন্টের রিলিফ ওয়ার্ক। শান্তির কপোত ওড়িয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। চোখ একবার গেলে সরতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মকর্তা কর্মচারী এই মোহনায় মিলিত হন। এ জায়গাটিতেই চলছে প্রদীপ প্রজ্বলনের কর্মসূচী। কেমন হয় পুরো আয়োজনটি? জানার জন্য শনিবার সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে হাজির হন এই প্রতিবেদক। প্রদীপ প্রজ্বলনের নির্ধারিত সময় ছিল সন্ধ্যা ৭টা। কয়েক মিনিট বাকি যখন, কাউকে তেমন দেখা গেল না। এলোমেলো ঘোরাফেরা করছিলেন কেউ কেউ। তাহলে? একটু সংশয় সন্দেহ সবে উঁকি দিচ্ছিল মনে, ওমনি উপাচার্য কামরুল হাসানের নেতৃত্বে দলবেঁধে নেমে আসতে দেখা গেল ডাক্তারদের। ঘড়িতে তখন ঠিক ৭টা। এরই মাঝে অকারণ ঘোরঘুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মকর্তা কর্মচারীরা এসে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়েছেন। কখন যেন নিভে গেছে বৈদ্যুতিক বাতি। অন্ধকার গাঢ় হলো বটে। বেশি সময় স্থায়ী হলো না। ৪০টি মোমবাতি জ্বলে ওঠলো। জ্বালালেন ৪০ জন। সামান্য নুয়ে সেগুলো বেদীমূলে স্থাপন করলেন। মন তখন আপনি গেয়ে ওঠলোÑ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।/ এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে/...আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব/ সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।/ নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,/ যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো...। মোমের আলোয় বঙ্গবন্ধুকে পরিষ্কার দেখা গেল। উদ্ভাসিত হলেন মহানায়ক। নতুন ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হলেন। সেদিকে তাকিয়ে কিছু সময়ের নীরবতা। একটি মোবাইল ফোন অবশ্য বেজে ওঠেছিল হঠাৎ। কিন্তু ভাব গাম্ভীর্য নষ্ট হলো না মোটেও। কারণ মোবাইল ফোন থেকে ভেসে আসছিলÑ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা...। সব মিলিয়ে অদ্ভুত আবেগঘন পরিবেশ। নিজের অজান্তেই নরম হয়ে যায় মন। বুকের ভেতরে কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। পিতা হারানোর শোক কীভাবে শক্তিতে পরিণত হয়, অনুভব করা যায়। এই অনুভূতি নিয়েই কাজে ফিরে যান সবাই। পেছন পেছন গিয়ে কথা হয় মোঃ খলিলুর রহমান নামের চতুর্থ শ্রেণীর এক কর্মচারীর সঙ্গে। তাঁর সরল বলাÑ আমার লেখাপড়া কম। তবে বঙ্গবন্ধুরে চিনি। আমি তাঁর লোক। বাংলাদেশটারে তো উনি বানাইছে। এই জন্য প্রথম দিন থাইকা ছবিটার সামনে দাঁড়ায়া নেতারে স্মরণ করি। প্রায় একই রকম আবেগ ভালবাসার কথা জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামরুল হাসান। উদ্যোগটি তিনিই গ্রহণ করেছেন। কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যেটুকু ভাল আছি তাতো বঙ্গবন্ধুর জন্যই। তিনি সারা জীবন আমাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন। একটি দেশ দিয়ে গেছেন তিনি। দলমত নির্বিশেষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত। এ জন্য শোকের মাসে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। আমি মহান নেতাকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগটি করে দিয়েছি বলতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নেতার নামে গড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখানেই তো বিশেষ আয়োজন থাকবে। তবে গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতায় নয়। একান্তে মুজিবকে নিয়ে ভাবার, স্মরণ করার ইচ্ছে থেকেই মোমবাতি প্রজ্বলনের কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। কথার এক ফাঁকে উপাচার্যের কক্ষে প্রবেশ করেন যুবক চেহারার একজন ডাক্তার। জানতে চান, পরদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বলনের বিষয়টি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবেন কিনা? কথা শেষ করতে না করতেই উপাচার্য বলেন, না। কাউকে নোটিস করতে হবে না। আমি চাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই আসুক। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে কিছু সময় নীরবে দাঁড়াক। এমন কথা থেকেও চমৎকার একটি ম্যাসেজ পাওয়া যায়। আন্তরিকতাটুকু স্পষ্ট হয়। সহকর্মীর সঙ্গে ছোট্ট কথা শেষ হলে উপাচার্য ফের কথা বলেন প্রতিবেদকের সঙ্গে। এ পর্যায়ে কিছুটা যেন পেছনে ফিরে যান। বলেন, বিএনপি জামাত জোট সরকারের সময় বঙ্গবন্ধুর নামে গড়া বিশ্ববিদ্যালয়েই সবচেয়ে বেশি বঙ্গবন্ধুর অবমাননা করা হয়েছে। এই কষ্ট ভুলবার নয়। তিনি বলেন, স্কুলে পড়ার সময় থেকে মহান নেতাকে ভালবাসতে শিখেছিলাম। এই শিক্ষার মূল্য অনেক। মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ভালবাসা ছিল সে একই ভালবাসা নিয়ে ডাক্তারদের রোগীর সেবায় পাশে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। কথা শেষ করে নিচে নেমে আসার সময় ফের চোখ যায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালটির দিকে। পিতার দিকে তাকিয়ে আবারও মনে হয়, এই শোক শেষ হওয়ার নয়। হয়ত তাই কবিকে লিখতে হয়Ñ যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যহ ভোরে/ মেলবো দু’চোখ, দেখবো নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,/ যতদিন পাবো বাতাসের চুমো দেখবো তরুণ/ হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করবো শোক...।
×