ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরি তিনদিন ধরে বন্ধ, আটকে পড়া মানুষের দুর্ভোগ চরমে

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৪ আগস্ট ২০১৫

ফেরি তিনদিন ধরে বন্ধ, আটকে পড়া মানুষের দুর্ভোগ চরমে

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ নাব্য সঙ্কটে শিমুলিয়া (মাওয়া)-কাওড়াকান্দি ফেরি চলাচল কার্যত তিনদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এই রুটে ৪টি রো রো ফেরিসহ ১৮টি ফেরির মধ্যে এখন চলছে একটি মাত্র ফেরি। এই অচলতায় আটকে পড়া অনেক যান ফিরে যাওয়ার পরও রবিবার উভয়পাড়ে ছয় শতাধিক যানের দীর্ঘ লাইনে রয়েছে। এর মধ্যে শিমুলিয়া প্রান্তেই সাড়ে ৩শতাধিক যান আটকা পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার শিমুলিয়ায় এসব আটকে পড়া মানুষের কষ্টের যেন সীমা নেই। দেশের সর্ববৃহৎ এই ফেরি সার্ভিসের অচলবস্থায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। যাত্রী দুর্ভোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এদিকে নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজান খান রবিবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে বলেন, এই ফেরি সার্ভিস কবেনাগাদ স্বাভাবিক হবে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তবে সোমবার একটি পর্যবেক্ষণ দল ঘটনাস্থলে যাবে, পর্যবেক্ষকদের মতামতের পরই এই বিষয়ে বলা যাবে। মন্ত্রী বলেন, এখন শুধু নাব্যতা সঙ্কট না, দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিক স্রোত। এত স্রোত এখানে কখনও দেখা যায়। আর নাব্যতা রোধে পদ্মা সেতু কাজে ব্যবহৃত বড় আকারের একটি ড্রেজার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রবিবার বিকালে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সভায় সেতু সচিব এবং প্রকল্প পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুযায়ী একটি পর্যবেক্ষণ টিম সোমবার শিমুলিয়ায় যাবে। তাদের পর্যবেক্ষণের পরই এই ড্রেজার কাজ শুরু করবে। তবে তিনি আশা করেন এই ড্রেজার ব্যবহার করা গেলে নাব্য সঙ্কট সমাধান করা যাবে। তিনি জানান, বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র ৬টি ড্রেজারে সেখানে রয়েছে, কিন্তু তীব্র স্রোতের কারণে কাজ করতে পারছে না। নৌ মন্ত্রী বলেছেন, এই স্রোতে চলার ক্ষমতা রয়েছে ৩টি ফেরির, সেগুলো চলার চেষ্টা করছে। এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে- পারাপারের অপেক্ষায় থাকা মানুষের কষ্ট। অনেক আটকেপড়া যান ফিরে গেছে। এর মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাক বেশি। পণ্য আটকা থাকায় নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। শিশু ও বৃদ্ধদের অবস্থা আরও খারাপ। রবিবার ঢাকার উত্তরা থেকে শিবচরের উদ্দেশে রওনা দেয়া শামীম শিমুলিয়ায় এসে পড়েছেন বিপাকে। তিনি বিকেল ৫টায় জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মাওয়া ঘাটে এসেছেন। সঙ্গে মা ও ছোট বোন আছে। একটি বিয়ের দাওয়াতে গ্রামে যাচ্ছিলেন। এখন মা ও বোনকে নিয়ে এই উত্তাল পদ্মায় স্পিডবোট দিয়েও পার হতে পারছেন না, ফিরেও যেতে পারছেন না। অপেক্ষা করছেন ফেরি কুসুমকলির সিরিয়ালের। খুলনাগামী হাসান জানান, পরিবার নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন। দুটো শিশু সন্তান নিয়ে গরমে আছেন। তাছাড়া এখানে খাবার সমস্যা ছাড়াও টয়লেটের সমস্যাতো রয়েছেই। শিমুলিয়া ঘাটে আটকেপড়া ট্রাক ড্রাইভার মুক্তার বিশ্বাস জানান, মুরগির খাবার নিয়ে গাজীপুর থেকে শরিয়তপুর যাচ্ছিলেন। ছয়দিন ধরে শিমুলিয়া ঘাটে বসে আছেন। কবে সিরিয়াল পাবেন তাও জানেন না। মালিকের নির্দেশ না থাকায় ফিরেও যেতে পারছেন না। অনিশ্চিত অবস্থায় আছেন তিনি। মুক্তার বিশ্বাস জানান, প্রথম দিন যে খাবার ৫০ টাকায় খেয়েছেন। এখন সেই খাবারের দাম বেড়ে ১শ’ টাকা। তিনি বলেন, ‘কেমনে আছি ভাষায় কইতে পারুম না। বড় জটিলতায় পড়ছি।’ একই অবস্থা ঢাকার রামপুরা থেকে শরীয়তরপুরগামী ট্রাক ড্রাইভার সুরুজ ও মাদারীপুরগামী আবুল বাশার, চট্টগ্রাম থেকে আসা খুলনাগামী মোঃ রোমানের। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ এই রুটে ফেরি চলছে ঠেকে ঠেকে। এই সময় ধরে রো রো ফেরি একেবারেই বন্ধ ছিল। ছোট ও মিডিয়াম ফেরি দিয়ে সার্ভিসটি সচল রাখা হলেও এখন তাও বন্ধ। শুক্রবার বিকেল ৫টায় ফেরি সার্ভিস বন্ধ হবার পর শনিবার সারাদিনে শিমুলিয়া থেকে ফেরি ছেড়ে গেছে মাত্র ৭টি। তার মধ্যে দু’টি গন্তব্যে পৌছতে পারলেও বাকি ৫টি ফেরি ঘাটে ফিরে এসেছে। শনিবার রাত ১২টার দিকে কুসুমকলি নামের একটি ফেরি কাওড়াকান্দির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এই ফেরিটি রবিবার ভোর সোয়া ৫টায় আবার শিমুলিয়া পৌঁছে। সকাল সাড়ে ৭টায় আবার কওড়াকান্দির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আবার ফিরে এসে বিকেল পৌনে ৫টায় কাওড়ান্দির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। কমযান দিয়ে এভাবে রবিবার সারাদিন ১৮টি ফেরির মধ্যে এ ফেরিটি দিয়ে কিছু যান পারাপার করা হয়েছে মাত্র। নতুন ফেরি ‘কুসুমকলি’র ইঞ্জিন ক্ষমতা ভাল এবং অপেক্ষৃত কমপানিতে চলার উপযোগী হওয়ার কারণেই এটি চলাচল করছে। এদিকে বিকেলে ‘ক্যামিলায়’ নামের একটি ফেরিও শিমুলিয়াঘাট ছেড়ে গেছে। এটি চ্যানেল অতিক্রম করেছে বলে সন্ধ্যায় বিআইডব্লিউটিসির মাওয়ার সহকারী ম্যানেজার শেখর চন্দ্র রায় নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি আশঙ্কা করেছেন অবস্থা এতটাই জটিল কত সময় চলতে পারে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিআইডব্লিউটিসি জানায়, যেখানে প্রতিদিন ৭০/৮০ টিপ ফেরি চলাচল করত এখন সেখানে ১/২টি ফেরি ৭/৮ টিপ দিচ্ছে। নাব্য সঙ্কটের কারণে গত দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে ফেরি চলাচল নানাভাবে ব্যাহত হয়ে আসছে। নাব্য সঙ্কটরোধে ড্রেজিং করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তীব্র স্রোতে ভরাবর্ষায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে লৌহজং টার্নিং পয়েন্টের মুখ। স্বাভাবিক ফেরি চলার জন্য চ্যানেলে পানির গভীরতা প্রয়োজন সাড়ে ৭ ফুট। কিন্তু পানির গভীরতা এখন সর্বনিম্ন ৬ ফুটের নিচে নেমে এসছে। বিআইডব্লিউটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মোঃ সুলতান উদ্দিন খান জানিয়েছেন, নাব্য সঙ্কট দূর করতে গত ২১ জুলাই হতে পদ্মা নদীর লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে বিআইডব্লিউটিএ’র তিনটি ড্রেজার কাজ করছে। ইতিমধ্যে ৩৬০ ফুট প্রশস্ত আপসাইটে ড্রেজিং করা হয়েছে। যা দিয়ে ফেরিগুলো চলাচল করছে। এখন আরও ৩৬০ ফুট ডাউন সাইটে মাটি খননের কাজ চলছে। কিন্তু পদ্মায় প্রচ- স্রোত আর বন্যার করণে উজান থেকে নেমে আসা পালি মাটি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে চ্যানেলের মুখ। মাটি খননের গতি বাড়াতে আরও একটি প্রাইভেট ড্রেজার ভাড়ায় আনলেও স্র্রোতের কারণে ড্রেজারটি যথাযথা স্থানে স্থাপন করা যাচ্ছে না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খনন কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, শিমুলিয়া ঘাটে আটকেপড়া যান ও যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তায় স্থানীয় প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। ফেরি সার্ভিস সম্পর্কে সার্বিক চিত্র উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সঙ্কট নিরসনে সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে।
×