* শ্রমিক সংঘ কী? শ্রমিক সংঘের কার্যাবলী আলোচনা কর। শ্রমিক সংঘ কি মুজুরি বাড়াতে পারে?
উ: শ্রমিক সংঘ (ঞৎধফব টহরড়হ): শ্রমিক নিজেদের স্বার্থরক্ষা, আস্থার উন্নতি, চাকুরির, শর্তাবলীর উন্নতি সাধন এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিয়োগকারীর সাথে দরকষাকষিকরে মজুরি বৃদ্ধির জন্য যে স্থায়ী গঠন করে তাকে শ্রমিক সংঘ বলা হয়।
শ্রমিকরা আশা করে অধিক মজুরি। অন্যদিকে মালিকপক্ষ চায় কম মজুরিতে শ্রমিকদের কাজ করতে। শ্রমিক পক্ষ ও মালিকপক্ষের মধ্যে এভাবে সর্বদায় স্বার্থে দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের শোষণ করে। তাই শ্রমিকরা তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সম্মিলিতভাবে শ্রমিক সংঘ গড়ে তোলে। তারা মনে করে একক প্রচেষ্টায় যা সম্ভব নয় শ্রমিক সংঘের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব।
অর্থনীতিবিদ ব্রিটিশ ও ওয়েব এর মতে,“ শ্রমিক সংঘ হল মজুরিজীবীদের একটি স্থায়ী সংগঠন যার দ্বারা তাদের নিয়োগের অবস্থা সংরক্ষণ বা উন্নত করা যায়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, শ্রমিক সংঘ হল একটি সংগঠন যা দরকষাকষির মাধ্যমে মালিকদের নিকট থেকে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে।
শ্রমিক সংঘের কার্যাবলী: শ্রমিক সংঘের কার্যাবলীকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা Ñ
ক) কল্যাণমূলক বা ভ্রাতৃত্বমূলক কার্যাবলী।
খ) সংগ্রামী কার্যাবলী
গ) রাজনৈতিক কার্যাবলী
ঘ) আপসমূলক কার্যবলী।
ক) কল্যাণমূলক বা ভ্রাতৃত্বমূলক কার্যাবলী (ডবষভধবব ভঁহপঃরড়ঁং): শ্রম সংঘ শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি ও শ্রমিক কল্যাণ সাধনের জন্য যে সব কাজ করে থাকে তাহলো--
১. অর্থনৈতিক সাহায্যে: শ্রমিক সংঘ সকল সদস্যদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিপদকালীন সাহায্যে করে থাকে।
২.শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা: শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক সংঘ সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বাস্তবমূখী শিক্ষাও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।
৩. সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা: শ্রমিক সংঘ শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা করে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।
৪.চিকিৎসা ব্যবস্থা: শ্রমিক সংঘ দরিদ্র ও অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিসায় বিভিন্ন ধরনের সাহায্যে সহায়তা করে থাকে।
৫. ব্যবসায় বিনিয়োগ: বর্তমান কালে শ্রমিক সংঘ সদস্যদের চাঁদায় গঠিত তহবিল থেকে লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করে এবং লভ্যাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করে।
৬.আবাসিক সমস্যার সমাধান: বর্তমানে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকগণ শ্রমিক সংঘের মাধ্যমে সদস্যদের আবাসিক সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
৭.চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা বরা: শ্রমিক সংঘ শ্রমিক ও তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য ক্লাব, পাঠাগার শরীর চর্চা কেন্দ্র, আমোদ-প্রমোদ ও খেলার ব্যবস্থা করে থাকে।
খ. সংগ্রামী কার্যাবলী (গরষরঃধহঃ ঋঁহপঃরড়হং): শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি- দাওয়া আদায়ের জন্য যে সব সংগ্রামী কার্যক্রম করে তা হলো
৮. চাকুরির নিরাপত্ত: মালিকপক্ষ অবৈধভাবে, খেয়াল খুশিমত যাতে শ্রমিক ছাঁটাই করতে না পারে, সেই ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখে।
৯. চাকুরির শর্তাবলি উন্নত করা: শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা হ্রাস, কারখানার পরিবেশ উন্নয়ন, পেনশন, বোনাস, পদোন্নতি প্রভৃতি অনুকূল দাবি আদায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১০. ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ: আমাদের দেশের মত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ শ্রমের যোগান বেশি হওয়ার মজুরি অত্যন্ত কম হয়। এমতাবস্থায় শ্রমিক সংঘ কর্তৃপক্ষকে মজুরি নির্ধারণে বাধ্য করে।
১১. কাজের সময়সীমা হ্রাস: শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের প্রতিদিনের কাজের ন্যূনতম সময় সীমা কর্তৃপক্ষের কাজ থেকে আদায় করে দেয় এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য মজুরি আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকে।
১২. শোষণ ও নির্যাতন বন্ধ: শ্রমিক সংঘ শ্রমিক শোষণ, নির্যাতনবন্ধ, শিশু শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের নির্যাতন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
১৩. বীমা ব্যবস্থা প্রচলন: শ্রমিকদের ঝুঁকি এড়াতে ও শ্রমিকদের নিধাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিক সংঘ মালিক পক্ষকে বীমা প্রথা প্রচলন বাধ্য করে।
১৪. কাজের পরিবেশ উন্নত করা: শ্রমিক সংঘ মালিক পক্ষকে বুঝিয়ে কাজের পরিবেশকে উন্নত করে থাকে।
১৫.ন্যায্য মজুরি: শ্রমিক সংঘ মালিক পক্ষের সাথে দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আদায় করে থাকে।
গ) রাজনৈতিক কার্যাবলী (চড়ষরঃরপধষ ঋঁহপঃরড়হং): শ্রমিক সংঘ শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার জন্য রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যাবলীতে অংশ গ্রহণ করে থাকে তা নিচে আলোচনা করা হল:
১৬. আইন প্রণয়: শ্রমিক সংঘ বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি আইন, কারখানা আইন, ক্ষতিপূরণ আইন প্রভৃতি আইন সভার মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা করে।
১৭. দল গঠন: শ্রমিকসংঘ শ্রমিক স্বার্থরক্ষার জন্য রাজনৈতিক দলগঠন করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চেষ্টা করে।
১৮. আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ: শ্রমিক সংঘ তাদের স্বার্থ কথা বলার জন্য অনেক সময় জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আইনসভায় প্রতিনিধি পাঠানো প্রচেষ্টা নেয়।
ঘ) আপসমূলক কার্যাবলি: অনেক সময় শ্রমিক সংঘ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে না পারলে মালিক পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সুযোগ- সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টত যে, শ্রমিক এমন একটি সংঘ যার দ্বারা শ্রমিকরা একতাবদ্ধভাবে মালিকদের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়সহ সার্বিক উন্নয়নে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে শ্রমিক সংঘ যৌক্তিক ভূমিকা পালন করলে শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও উন্নতি অর্জিত হবে।
শ্রমিক সংঘ কি মজুরি বৃদ্ধি করতে পারে?
উল্লেখিত প্রশ্নোত্তরে অর্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে, শ্রমিক সংঘ কখনই স্থায়ীভাবে মজুরি বাড়াতে পারে না।
কারনগুলো নিম্নরূপ-
ক. মজুরি বৃদ্ধি পেলে দ্রব্যের দাম বাড়বে ফলে চাহিদা কমবে। উৎপাদন হ্রাস পাবে ফলে শ্রমের চাহিদার কমবে ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে।
খ. শ্রমিকের পরিবর্তে মূলধন নিবিড় উৎপাদন পদ্ধতির কারণে শ্রমিকসংঘ মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলন করতে পারবে না।
গ. উৎপাদন খরচের অধিকাংশ অংশ যদি মজুরি বাবদ ব্যয় তবে শ্রমিক সংঘ মুজরি বৃদ্ধির দাবি করতে পারবে না।
আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে শ্রমিক সংঘ নিম্ন লিখিত বিভিন্ন উপায় মজুরি বৃদ্ধি করতে পারে।
১। যৌথ দরকষাকষি: যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতার সমান মজুরি আদায় করতে পারে। সাধারণ প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতাপেক্ষা কম মজুরি মালিকপক্ষ দিয়ে থাকে।
২। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি: শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে মুজরি বাড়াতে পারে।
৩। শ্রমিকের যোগান নিয়ন্ত্রণ: শ্রমিক সংঘ কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রমিকের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করতে পারে। যেমন-