ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বে ভাত শালিকের সংখ্যা বাড়লেও গ্রামবাংলায় কমে আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৩ আগস্ট ২০১৫

বিশ্বে ভাত শালিকের সংখ্যা বাড়লেও গ্রামবাংলায় কমে আসছে

শাহীন রহমান ॥ যেসব পাখির কলকাকলিতে ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙে তাদের মধ্যে ভাতশালিক অন্যতম। গ্রাম বাংলায় এমন কোন মানুষ নেই পাখিটির সঙ্গে যার পরিচয় নেই। পাখিটি দেখেনি এমন গ্রামের মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পাখি বিশারদের মতে বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বে এদের সংখ্যা বাড়লেও গ্রাম বাংলায় কমে আসছে। সে কারণে আইইউসিএনএই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। দেশের বন্যপ্রাণী আইনেও এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখি বিশারদদের মতে এই প্রজাতির শালিক এখনও গ্রাম বাংলার সর্বত্রই দেখা গেলেও সংখ্যায় আগের তুলনায় কমে গেছে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে বলে বিরূপ অবস্থাতেও টিকে আছে। এরা সবকিছু খাওয়ার পাশাপাশি মানুষের বসতবাড়ির আশপাশে থাকতেই ভালবাসে। মানুষের আহার্য ভাত, তরকারি, চাল, চিড়া, মুড়ি খেতে অভ্যস্ত। সুযোগ পেলে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে খাবার খেয়ে পালিয়ে যায়। ভাতশালিকের দেহের বেশিরভাগ অংশজুড়ে রয়েছে বাদামি রঙ। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড় কালচে। বুকের ওপরের অংশ ও লেজ ওপরে ঢাকনিও কালো। দেহের বাকি অংশ কালচে বাদামি। কোন ঝুঁটি নেই। এর ডানার সাদা পট্টি ওড়ার সময় স্পষ্ট হয়। একইভাবে স্পষ্ট হয় লেজের প্রান্তভাগ। চোখের নিচে ও পেছনের পালকহীন চামড়া হলুদ। চোখ বাদামি বা লালচে বাদামি। ঠোঁট হলুদ। নিচের ঠোঁটের গোড়া সামান্য বাদামি সবুজ। পা, পায়ের পাতা ও নখর হলুদ। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা একই রকম, কেবল আকারে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা সামান্য বাদামি কালো এবং গলা ও বুক অপেক্ষাকৃত ফিকে বাদামি। এরা যত্রতত্র চিকন ডালপালা ও আঁশ দিয়ে গোলাকার বাসা তৈরি করে। ইংরেজীতে এদের ‘কমন ময়না’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে ভাতশালিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাতশালিক এশিয়ার আবাসিক পাখি। আদিনিবাস ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায়। এছাড়া তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান এবং মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোচীন ও চীনও এদের মূল আবাস। এছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এদের দেখা মেলে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইল, নিউজিল্যান্ড, নিউ ক্যালিডোনিয়া, হাওয়াই, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত মহাসাগরের দ্বীপসমূহ (সেসেলস, মরিশাস, মালদ্বীপ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং লাক্ষাদ্বীপ) এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহে প্রজাতিটির দেখা মেলে। ভাতশালিক বসত বাড়ির আশপাশেই গাছের ডালে বাস করে। ভোরে যেসব পাখির কলকাকলিতে মানুষের ঘুম ভাঙে, ভাতশালিক তাদের অন্যতম। দিনের অবসর সময়ে এরা প্রচুর শব্দ করে ডাকাডাকি করে। এদের ডাক বেশ বিচিত্র। উচ্চকণ্ঠে চিড়িক শব্দে ডাক দেয়, শিস দেয়, ঘর ঘর শব্দ করে। প্রায়ই পালক ফুলিয়ে মাথা ওপর নিচ ঝাঁকিয়ে ডাকাডাকি করে। ঘরে ফেরার আগে বা বিশ্রামের আগেও এরা দলবদ্ধ হয়ে ডাকাডাকি করে। ভয় পেলে বা আশপাশে বিপদের আভাস পেলে চকে চকে শব্দে ডেকে দলের অন্য সদস্যদের সতর্ক করে দেয়। উড়ে পালানোর সময়ও একই রকম আওয়াজ করে। মানুষের কথাও অনুকরণ করতে পারদর্শী। অন্য সব পাখি আর জীবজন্তুর ডাকও নকল করতে পারে। ফলে কথা বলা পাখি আর গায়ক পাখি হিসেবে ভাতশালিক বেশ সমাদরে পালন করা হয়। পাখি বিশারদরা বলছেন, অন্য সব শালিকের মতো ভাতশালিকও সর্বভূক। শহর, গ্রাম, প্রান্তর, ডাস্টবিন সর্বত্রই এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। পোকামাকড়ের সন্ধানে ঘাসজমিতে এদের প্রায়ই লাফিয়ে লাফিয়ে চরে বেড়াতে দেখা যায়। মূলত এরা ঘাসফড়িং বা পঙ্গপাল খুঁজে খুঁজে শিকার করে খায়। সে জন্যই এর বৈজ্ঞানিক নাম হয়েছে পঙ্গপাল শিকারী। শুধু ভূমি থেকে নয়, অন্যান্য উৎস থেকেও বিচিত্র রকমের পতঙ্গ এরা আহার করে। পোকামাকড়ের সন্ধানে এরা তৃণভূমিতে গবাদিপশুর পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায়।
×