ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ টেলিকম নীতিমালার আরও পরিমার্জন লাগবে

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৩ আগস্ট ২০১৫

একুশ শতক ॥ টেলিকম নীতিমালার আরও পরিমার্জন লাগবে

সারা দুনিয়াতেই টেলিকম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বিশেষ করে দুনিয়া যখন ডিজিটাল হচ্ছে তখন সকল রাষ্ট্রই টেলিকম খাতের উন্নয়নে নজর দিয়েছে। আমরাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই দেখেছি। এজন্য আমরা কেবল যে এ বিষয়ে একটি মন্ত্রণালয় রেখেছি তাই নয়, আমাদের একটি টেলিকম রেগুলেটরি সংস্থাও আছে। টেলিকমের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এই সংস্থা গুরুত্ব দিয়েই পরিচালনা করে। সম্প্রতি তাদের দ্বারা তৈরি করা একটি টেলিকম নীতিমালার খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। টেলিকম বিভাগের অধীনে বিটিআরসির ওয়েবসাইটে এটির বিষয়ে মতামত আহ্বান করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি মনে করি এর ওপর মতামত দেয়াটা আমার নাগরিক দায়িত্ব। বিশেষ করে সেই খাতের সঙ্গে প্রায় তিন দশক যুক্ত থাকার প্রেক্ষিতে এর নীতি- কৌশল-কর্ম পরিকল্পনায় আমি যুক্ত রয়েছি এটিও আমার মনে রাখার দরকার। ক’দিন আগে ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে টেলিকম নীতিমালার খসড়া বিষয়ে আলোচনা করার জন্য উপস্থিত হয়েছিলাম। সরাসরি আলোচনা করতে গিয়ে এই বিষয়ে কিছু মতামতও দিয়েছিলাম। সত্য কথা হচ্ছে, নীতিমালার খসড়াটি ডাউনলোড করে পাঠও করেছিলাম তখনই। নীতিমালাটি ছিমছাম। এতে অনেক ভাল বিষয় আছে। বিশেষ করে এমন অনেক বিষয়ের কথা আছে যা টেলিকম বিভাগ, বিটিআরসি ও সরকারী বেসরকারী খাতের মানুষদের উচিত ছিল অনেক আগেই বাস্তবায়ন করা। যেমন নাম্বার পোর্টেবিলিটি। ’৯৮ সালে প্রথম নীতিমালা করার পর এতদিনে কেন এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা হয়নি তার কারণ আমি জানি না। একইভাবে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট কেন পৌঁছেনি সেটিও আমার অজ্ঞাত। কেন দিনে দিনে ডিজিটাল বৈষম্য বাড়ছে সেটিও আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী নিজে গত ৬ আগস্ট ২০১৫ গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় ইন্টারনেটের ব্যয়কে আনার জন্য বলেছেন এবং তাদের কাছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে বলেছেন। সেটিও কেন এখনও নীতিমালায় থাকতে হবে এটি আমি মানতে পারি না। নীতিমালায় ইউএসও ফান্ড নিয়ে কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি বহুদিন যাবত এ ফান্ডটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহার হয়নি। এই ব্যর্থতার দায়কে চিহ্নিত করা উচিত। কিন্তু সেগুলোকে এখন আবার নতুন সময়সীমায় আবদ্ধ করে প্রলম্বিত করা হয়েছে। ইচ্ছা ছিল টিভিতে নীতিমালার সব বিষয় নিয়ে কথা বলব। তবে সময় স্বল্পতার জন্য টিভিতে সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলা সম্ভব হয়নি। সেটি স্বাভাবিকও। এই লেখাটি পড়তে হয়ত ১০ মিনিট লাগবে। কিন্তু টিভিতে আধা ঘণ্টায় এর সব প্রসঙ্গ আলোচনা করা যায় না। এ আলোচনায় নীতিমালা বিষয়ে নিজের ভাবনাটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ্আলোচনার শুরুতেই এটি মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশে আইসিটি বা টেলিকম খাতের নাম উঠলেই কেবল শেখ হাসিনা সরকারের কথাই ওঠে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর শেখ হাসিনার সরকার কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করার পাশাপাশি মোবাইলের মনোপলি ভাঙ্গা, অনলাইন ইন্টারনেটের প্রসার, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার বিস্তার এবং টেলিকম নীতিমালা প্রণয়নের মতো যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন। সেই নীতিমালার সুফল দেশ ভোগ করেছে। অন্যদিকে ২০০১ সালের পর ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট ও পরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই নীতিমালাটির নবায়নও করেনি। প্রথমত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, টেলিকম প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী ও তার মন্ত্রণালয়কে নীতিমালা নবায়নের কাজটি এগিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে ২০০৯ সালেই এই খসড়াটি প্রণীত হলে আমি আরও খুশি হতাম। ১৯৯৮ সালে প্রণীত জাতীয় টেলিকম নীতিমালার নবায়ন করার জন্য জাতীয় টেলিকম নীতিমালা ২০১৫-এর খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। নীতিমালাটি এখন বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের ওয়েবসাইটে মতামতের জন্য দেয়া আছে। ধারণা করি বিষয়টির প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে এবং বিটিআরসি বেশকিছু মতামতও পেয়েছে। আমার মতামতগুলো নি¤œরূপ : ১) নীতিমালার মেয়াদ : খসড়া নীতিমালায় নীতিমালার মেয়াদ ১০ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি মনে করি এভাবে নীতিমালার একটি মেয়াদ বা সময়কাল নির্ধারণ সঠিক উপায় নয়। বরং নীতিমালাটির মেয়াদ নির্দিষ্ট না করে সেটি প্রতি দুই বছর পর পর নবায়ন করা হবে বলে উল্লেখ থাকা দরকার। টেলকম এমন একটি খাত যাতে দশ বছর সময় বেঁধে দেয়া কঠিন। এই খাতে প্রতিদিন নতুন প্রযুক্তি আসছে। ফলে আজকের নীতিমালা ১০ বছর বহাল থাকবে না। দুই বছর পরই এটি অচল হয়ে যাবে। খসড়ার বক্তব্য অনুসারে দশ বছরে এই নীতিমালার আর নবায়ন হবে না। সেটি একেবারেই আত্মঘাতীমূলক হবে বলে আমি মনে করি। অনুগ্রহ করে দুই বছর পর পর নীতিমালা পর্যালোচনার বিষয়টি যুক্ত করুন। ২) কর্মপরিকল্পনার মেয়াদ : নীতিমালার মেয়াদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও একটি বিষয় হচ্ছে কর্মপরিকল্পনার মেয়াদ নির্ধারণ। নীতিমালায় স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা হিসেবে যেভাবে কর্মপরিকল্পনাকে বিন্যস্ত করা হয়েছে তাকে ২০২৫ সালের বদলে ২০২১ সালে সীমিত করা উচিত। এজন্য ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২১ সালকে যথাক্রমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনার মেয়াদ হিসেবে গণ্য করা উচিত। আমি কর্মপরিকল্পনাগুলো দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছি। এতে যেসব কর্মপরিকল্পনা যে সময়ে সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে সেটি মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। আমি মনে করি কাজগুলো আমাদের আরও বেশি করে করতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই সেগুলো সম্পন্ন করতে হবে। ৩) সংজ্ঞা : খসড়া নীতিমালায় কিছু ইংরেজী শব্দের ব্যাখ্যা দেয়া আছে। কিন্তু টেলিকম খাতের অতি প্রয়োজনীয় শব্দের সংজ্ঞা দেয়া নেই। যেমন ডিজিটাল ডিভাইস কি সেটি নীতিমালায় বলা উচিত। এ্যাপ, প্রোগ্রাম কি সেইসব বিষয়ে নীতিমালায় ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দিতে হবে। ৪) কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নকারী : কর্মপরিকল্পনাগুলো খুবই সীমিত ও ক্ষুদ্রতায় শৃঙ্খলিত। যেমন কর্মপরিকল্পনার ৮.১.৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, স্বল্প মেয়াদে ১২০০ ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইবার বিস্তৃত করা হবে। আমরা জানি যে, দেশে প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন পরিষদ আছে। এর বাইরে আছে ওয়ার্ড ও পৌরসভা। আমি এটিও জানি যে, সরকারের আইসিটি ডিভিশন এবং বেসরকারী খাত মিলে দেশের প্রায় সকল ইউনিয়ন ও পৌরসভা-ওয়ার্ডে ফাইবার অপটিক্স কেবল বসাচ্ছে। নীতিমালাটি কেবল কি টেলিকম বিভাগের? দেশের বাকি ইউনিয়নে কি হবে তার কোন উল্লেখ নীতিমালায় নেই। মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদেও এর কোন উল্লেখ নেই। নীতিমালায় কেবল টেলকম বিভাগকেই কেন আলোচনায় রাখা হলো সেটি বুঝি না। মনে রাখা দরকার যে এটি জাতীয় নীতিমালা। এই নীতিমালায় জাতীয় পর্যায়ে যারা যাই করুক তার প্রতিফলন ঘটানো উচিত। অন্যদিকে এসব কর্মপরিকল্পনা কে বাস্তবায়ন করবে সেটিও এতে উল্লেখ করা নেই। আমি নীতিমালার প্রণেতাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯-২০১৫ দেখার জন্য অনুরোধ করছি। সেখানে বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ৫) নীতিমালার ৩ ধারায় লক্ষ্য নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এর ৩.৫ ধারায় ‘অনলাইন নীতিমালা’ শব্দটি যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ অনলাইন কর্মকা-ের পুরোটাই টেলিকম খাতকে ঘিরে। ফলে অনলাইনের সঙ্গেও টেলিকম খাতকে সমন্বয় হতে হবে। ৬) লক্ষ্য অংশে দেশের প্রতিটি মানুষের হাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছানো কেন যুক্ত হয়নি সেটি আমি বুঝিনি। টেলিকম খাতের এখন বড় চ্যালেঞ্জ হতে হবে দেশের প্রতিটি বাড়িতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছানো। এতে জনগণের ক্রয় ক্ষমতায় ইন্টারনেট আনা এবং ঢাকা ও দেশের অন্য অঞ্চলের মাঝে সংযুক্তি সেবা ও দামের পার্থক্য নিরসনও একটি বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় দেশের গ্রামাঞ্চলে ব্রডব্যান্ড নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। ফাইবার ক্যাবলে ঢাকার বাইরে ইন্টারনেট মানেই বাড়তি খরচ। এই বৈষম্য দূর করাটা নীতিমালার অন্যতম লক্ষ্য হতে হবে। ৭) ৪ অধ্যায়ে অনুসরণীয় নীতিসমূহ অধ্যায়ে বৈষম্য দূরীকরণের কোন উল্লেখ নেই। ফলে বিদ্যমান বৈষম্য বা ডিজিটাল ডিভাইড দূর করার কোন প্রচেষ্টা এই নীতিমালায় নেই। নীতিমালায় প্রযুক্তি সমতা এবং সকলের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছানোর কোন গাইডলাইনও নেয়া হয়নি। ধারা ৪.২ এ এই বিষয়টি যুক্ত হতে পারে। যদিও ধারা ৬.১.২ এ ডিজিটাল ডিভাইডের কথাটি উল্লেখ আছে তথাপি আমি মনে করি গাইডলাইন অংশে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার থাকা দরকার। ৮) নীতিমালায় ডিজিটাল নিরাপত্তার কথা উল্লেখ আছে। ধারা ৬.১.২ এ প্রাইভেসি বিষয়েও বলা আছে কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অপরাধ দমন ইত্যাদি বিষয় স্পষ্ট হয়নি। এছাড়া নীতিমালায় ডিজিটাল অপরাধ দমন, চ্যালেঞ্জ, প্রতিকার ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত আইনসমূহের নবায়ন বিষয়ে সুস্পষ্ট কথা বলা দরকার। ৯) নিরাপত্তার বড় দুর্বলতা যে এতে কনটেন্ট বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কনটেন্ট প্রস্তুত, বিতরণ, বিপণন ও এর হারাহারি ভাগ বিষয়ে বিটিআরসি ইঁদুর বিড়াল খেলছে। এই বিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে বিটিআরসি কোন উদ্যোগই সামনে নিচ্ছে না। বোঝা যায় যে মোবাইল অপারেটরদের ইচ্ছার কাছে বন্দী বিটিআরসি এই বিষয়ে সামনে যেতে চায় না। কিন্তু টেলিকম খাতের প্রসারে সবচেয়ে জরুরী বিষয়টি হচ্ছে কনটেন্ট। ১০) নীতিমালায় শিক্ষায় টেলিকম খাতের ব্যবহারের বিষয়টি অনুপস্থিত। দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের প্রধান স্তম্ভ শিক্ষা। এই খাতে টেলিকম খাতকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা হবে এবং তাদের কাছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কিভাবে পৌঁছানো হবে তার কোন গাইডলাইন আমি নীতিমালায় দেখিনি। ১১) নীতিমালায় দেশে হার্ডওয়্যার ও সফটওয্যার উৎপাদন নিয়ে কথা আছে। সফটওয়্যার উৎপাদনে বেসরকারী খাতের ভূমিকাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং হার্ডওয়্যার উৎপাদনে টেশিসসহ বেসরকারী খাতকে কর সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে কোন প্রস্তাবনা নেই। আমি মনে করি টেলিকম নীতিমালার খসড়ার আরও পর্যালোচনা দরকার। বিশেষ করে যারা এর সঙ্গে যুক্ত তাদের সঙ্গেই বেশি কথা বলা দরকার। আমি এটিও মনে করি যে, কেবল মোবাইল বা পিএসটিএন অপারেটর বা সরকারী কর্মকর্তাদের মতামতের ওপর ভর করে নীতিমালা চূড়ান্ত করা ঠিক হবে না। আইসিটি খাতের বিজ্ঞজনদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি শিক্ষার সঙ্গে যারা যুক্তে তাদের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। তবে সবচেয়ে বড় কথা খসড়াটি যেহেতু হয়েছে সেহেতু এর পর্যালোচনা দ্রুত হতে হবে এবং অতি দ্রুত এটিকে আলোর মুখ দেখাতে হবে। ঢাকা, ২২ আগস্ট, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected] ওয়েবপেজ:ww w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×