ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এ বছরেই গ্রেনেড হামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার আশাবাদ প্রধান সরকারী কৌঁসুলির

ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা ও তদন্তে দীর্ঘসূত্রতাই বিচার বিলম্বের কারণ

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২১ আগস্ট ২০১৫

ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা ও তদন্তে দীর্ঘসূত্রতাই বিচার বিলম্বের কারণ

সৈয়দা ফরিদা ইয়াসমিন জেসি ॥ শুরুতে মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা, এরপর এখন অতিরিক্ত সাক্ষীর বোঝা- ফলে গত ১১ বছরেও শেষ হয়নি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার। তবে আগের বছরের তুলনায় গত এক বছরে মামলাটির বিচার কার্যক্রম দ্রুত চলেছে। গত এক বছরে ৮৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান, এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল, ওই আদালতের পিপি এ্যাডভোকেট আবু আবদুল্লাহ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে ১৭৬ জন সাক্ষীর। বর্তমানে কোন সপ্তাহে দুই দিন, কোন সপ্তাহে তিন দিন মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। কোন কোন আসামি গুরুত্বপূর্ণ অন্য মামলার আসামি এবং তাদের ঢাকার বাইরে থেকে এনেও হাজির করতে হচ্ছে। একই আদালতে গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু মামলা চলছে। ফলে ২১ আগস্ট মামলাটি পরিচালনা বিরতি দিয়েই করতে হয়। প্রতিদিন করা সম্ভব নয়। ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার আদালতে আসে বলেও জানান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানের সহকারী আইনজীবী আকরাম হোসেন শ্যামল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা পরিচালনাকারী প্রধান সরকারী কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান ও সরকারি কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল জনকণঠকে বলেন, ২০১৫ সালের মধ্যেই গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন করতে তারা চেষ্টা করবেন এবং মামলার বিচার আগামী ডিসেম্ব^রের মধ্যে শেষ হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন। তাদের বিশ্বাস মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন করতে আর সর্বোচ্চ চার থেকে সাড়ে চার মাস সময় লাগবে। এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল আরও বলেন, আর খুব বেশি হলে ৪০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হতে পারে। এ হিসাব থেকেই দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে জোর আশাবাদ ব্যক্ত করছেন । গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ২৬ জন কারাগারে আটক রয়েছে এবং সাবেক তিনজন আইজিপিসহ আটজন জামিনে রয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ মামলার চার্জশীটভুক্ত ৫২ জন আসামির মধ্যে ১৮ জন এখনও পলাতক রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে পিপি বলেন, বিচারে বিলম্বের বড় কারণ হচ্ছে ঢাকার বাইরে অভিযুক্তদের আনা- নেয়া করা। মামলার কয়েকজন আসামি অন্য ফৌজদারি মামলারও আসামি। উল্লেখ্য, গ্রেনেড হামলা মামলার কয়েকজন আসামি চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, কয়েকজন ঢাকার রমনা বটমূলে বিস্ফোরণ মামলা, কয়েকজন গোপালগঞ্জে ৭৬ কিলোগ্রাম বোমা পুঁতে রাখা মামলা এবং কয়েকজন সিলেটে শাহজালাল মাজারে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। আসামিদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধ মামলার আসামি। আইনজীবী কাজল আরও বলেন, আমরা মামলাটির দ্রুত বিচারের জন্য সোম, মঙ্গল ও বুধবার শুনানির তিনটি স্থায়ী তারিখ নির্ধারণ এবং বকশীবাজারে একটি অস্থায়ী আদালত স্থাপন করাসহ একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দু’টি পৃথক মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা এবং অপরটি বিস্ফোরক আইনে মামলা। সিআইডি মামলার নতুন তদন্ত করে ২০১২ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দু’টি পৃথক সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করে। সিআইডি এর আগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই বিএনপির একজন সাবেক উপমন্ত্রীসহ ২২ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয়। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এই চার্জশীট তৈরি করে। পরবর্তীতে মামলার পুনরায় তদন্ত করা হয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সিআইডি কর্মকর্তাদের সাজানো জজ মিয়া নাটক নিয়ে সংবাদপত্রগুলো চটকদার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে মামলার আলামত নষ্ট করা ছাড়াও তদন্তের নামে প্রহসনের অভিযোগ করেন এবং প্রকৃত আসামিকে আড়াল করতে জজ মিয়ার নাটক সাজানো হয় বলে জানান সৈয়দ রেজাউর রহমান। এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করে দেয়া হয় অভিযোগপত্র। কিন্তু সেখানেও আর্জেস গ্রেনেডের উৎসের কোন তথ্য ছিল না। আদালতের নির্দেশে আবারও নতুন তদন্ত হয়। এ মামলায় মোট ৬ বার তদন্ত কর্মকতা পরিবর্তন করা হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সনের ছেলে বিএনপির সিনিয়র নেতা তারেক রহমান ও দেশী-বিদেশী জঙ্গীসহ আসামি হন ৫২ জন। তদন্তের দীর্ঘসূত্রতাই বিচার বিলম্বিত হওয়ার অন্যতম কারণ। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন এজলাসে ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। এদিকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি সংসদ ভবনে কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে সভায় এ পরামর্শ দেয়া হয়। সভায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় এও জানানো হয়, এই মামলার অভিযোগপত্র ও সম্পূরক অভিযোগপত্রে মোট সাক্ষী ৪৯১জন। ইতোমধ্যে ২টি মামলার প্রত্যেকটিতে ১৬৭ জন করে (ওই পর্যন্ত) সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে। গ্রেনেড হামলা মামলার ৫২ আসামির মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ জন আসামি কারাগারে আটক আছেন। এ ছাড়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৮ জন আসামি রয়েছেন পলাতক। অন্যদিকে লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মোঃ আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে রয়েছেন।
×