ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিঙ্গাপুরের বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি ক্রিস এনার্জি বাঙ্গুরা গ্যাসফিল্ডের দুটি কূপ খননের কাজ দিয়েছে বাপেক্সকে

বাপেক্স প্রথম বিদেশী কোম্পানির গ্যাসকূপ খননের কাজ পেল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ আগস্ট ২০১৫

বাপেক্স প্রথম বিদেশী কোম্পানির গ্যাসকূপ খননের কাজ পেল

রশিদ মামুন ॥ সিঙ্গাপুরভিত্তিক বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি ক্রিস এনার্জির নিয়ন্ত্রণে থাকা বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্রে দুটি কূপ খননের কাজ পেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। ক্রিস এনার্জি বুধবার বাপেক্সকে কাজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই প্রথমবার বাপেক্স কোন বিদেশী কোম্পানির গ্যাস কূপ খননের কাজ করতে যাচ্ছে। অন্যদিকে একই সময়ে সরকারের সিদ্ধান্তে চারগুণ বেশি খরচে বাপেক্সের শ্রিকাইল গ্যাস ক্ষেত্রের কূপ খনন কাজ দেয়া হয়েছে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রোমকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাপেক্সের উপর সরকার আস্থা হারালেও বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি আস্থা রেখেছে। জানা যায় ক্রিস এনার্জির ডাকা দরপত্রে গ্যাজপ্রোমের ঠিকাদার হয়ে বাংলাদেশে কূপ খনন করা চীনা কোম্পানি এরিয়েল অংশ নেয়। কিন্তু তাদের বদলে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সই শেষ পর্যন্ত কাজ পেল। বাপেক্স সূত্র বলছে, বুধবারই ক্রিস এনার্জি লেটার অব ইনট্যান্ট (কাজ শুরুর অনাপত্তিপত্র) দিয়েছে বাপেক্সকে। এখন কূপ খনন করার খরচ নিয়ে আজ থেকে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু হবে। বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আতিকুজ্জামান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে জানান, বুধবারই কাজ শুরুর অনাপত্তিপত্র পেয়েছি। কূপ খনন করে বাপেক্স কত টাকা পাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে প্রতিদিনের হিসেবে দর জমা দেয়া হয়েছে। এখন কূপ খনন করতে কত দিন সময় প্রয়োজন তার উপর নির্ভর করছে আমরা কত টাকা পাব। সে বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার থেকে আলোচনা শুরু হবে বলেও জানান তিনি। বাপেক্স সূত্র জানায়, এর আগে বাপেক্স বিদেশী কোন কোন কোম্পানির গ্যাসকূপ ওয়ার্কওভার করলেও কোন কোম্পানি বাপেক্সকে দিয়ে কূপ খনন করাতে রাজি হয়নি। এই প্রথম কোন আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাপেক্সকে দিয়ে কূপ খনন করাচ্ছে। ক্রিস এনার্জি সূত্র জানায়, বাঙ্গুরায় দুটি নতুন গ্যাস কূপ খননের আগ্রহপত্র চাইলে প্রাথমিকভাবে ১০টি কোম্পানি এতে অংশ নেয়। যোগ্য বিবেচনায় চারটি কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় রাখা হয়। এই তালিকায় এরিয়েল এবং সিনোপ্যাকের মতো দুনিয়াজুড়ে কাজ করা খ্যাতনামা কোম্পানিও ছিল। যারমধ্যে বাপেক্সকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিল ক্রিস এনার্জি। বাপেক্স তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতারও দীর্ঘ সময় পর পেট্রোবাংলার আওতা থেকে বের হয়ে ১৯৮৯ সালে কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ওই বছর জুলাই মাসে একটি পৃথক কোম্পানি হিসেবে বাপেক্সের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে এ কোম্পানির অপারেশনাল কার্যক্রমের খরচ গ্যাস সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাহ করা হতো। যাতে বাপেক্সকে সব সময় সরকার বা অন্য কোম্পানির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। নিজেদের অর্থ না থাকায় বাপেক্স কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহস করত না। পরবর্তীতে ২০০০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এটি আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি আলাদা কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। তখন বাপেক্স তেল গ্যাস উত্তোলনও শুরু করে। শুরু থেকেই বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে বাপেক্স শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারেনি। সূত্র জানায়, ভারতের ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড হাইড্রোকার্বন ইন্ডিয়া লিমিটেড থেকে পৃথক হয়ে ১৯৮৯ সালের মার্চে যাত্রা শুরু করে। এখন ২০১৫ সালে এসে ওএনজিসি ১৭টি দেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে কাজ করছে। এমনকি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তারা ব্লক ইজারা নিয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাপেক্সের মধ্যেও এই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দেশীয় কোম্পানির বদলে আন্তর্জাতিক কোম্পানির প্রতি আগ্রহের কারণে বাপেক্সের বিকাশ সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিকে কূপ খনন করার যন্ত্রাংশই কিনে দেয়া হয়নি বহুদিন। এছাড়া পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ না করায় বাপেক্স একটি প্রশিক্ষণশালায় পরিণত হয়েছে। এখানে কিছু দিন কাজ করে বেশিরভাগ দক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারী বহুজাতিক কোম্পানিতে বেশি বেতনে কাজ করতে চলে যান। সরকারের সাম্প্রতিক মনোভাব পর্যালোচনায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রোমকে দিয়ে সরকার আরও পাঁচটি কূপ খনন করছে। যেখানে বাপেক্সের নিজস্ব গ্যাস কোম্পানিও রয়েছে। সরকারের উপর পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হওয়ায় নিজস্ব রিগ বসে থাকার পরও বাপেক্সকে নীরব থাকতে হচ্ছে। বাপেক্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, ভ্যাট ট্যাক্সসহ শ্রিকাইলে গ্যাজপ্রোমকে দিয়ে কূপ খনন করতে খরচ পড়বে ২৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাপেক্স শ্রিকাইলে যে নতুন কূপ খনন করার প্রস্তাব দিয়েছে তাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। নিজেদের রিগ বসে থাকার পরও চারগুণ বেশি অর্থ খরচ বাপেক্সকে দিয়েই পরিশোধ করানো হবে। এখন মোবারকপুরে বাপেক্সের একটি রিগ কাজ করছে। সেখানে কাজও শেষ পর্যায়ে আর বাইরে বাপেক্স সালদা নদীতে রিগ পাঠিয়েছে কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। কৈলাসটিলায় কূপ খনন শেষে রিগ বসে রয়েছে। এছাড়া বাপেক্সের হাতে কূপ খননের কোন নতুন কাজও নেই তারপরও কেন বাপেক্সর নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্রে গ্যাজপ্রোমকে দিয়ে কূপ খনন করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই সরকার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। অন্যদিকে ঠিক একই সময়ে বাপেক্সের প্রতি আস্থা রেখেছে বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি। বাপেক্সের কূপ খনন কাজ পাওয়া তারই প্রমাণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। জানতে চাইলে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, এটা খুবই খুশির খবর যে বাপেক্স আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কাজটি পেয়েছে। এই প্রথম বাপেক্স কোন বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্যাস ক্ষেত্রে কূপ খনন করছে। তিনি জানান, আগে বাপেক্সের রিগ ছিল না। এছাড়া অয়েল কন্ট্রোল সার্টিফিকেট ছিল না। এজন্য সবার সঙ্গে আলোচনা হলেও কেউ কাজ দিতে চাইত না। এখন ভারতে নিয়ে কর্মকর্তা- কর্মচারীদের প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক মানের কাজ করতে সক্ষম বলেও জানান তিনি।
×