ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুল ইসলাম

বর্ষায় গ্রামের রূপ ॥ কবিতা ও গানের দিন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ আগস্ট ২০১৫

বর্ষায় গ্রামের রূপ ॥ কবিতা ও গানের দিন

পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অদূরেই আমাদের সুসং দুর্গাপুর এলাকা। তাই বাংলাদেশের অন্য এলাকার চেয়ে এখানে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি ও বর্ষার রূপ-প্রকৃতিও একটু ভিন্ন বটে। কিন্তু আজকে গ্রামীণ অবকাঠামো ও জীবনধারায় যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তাতে বর্ষার সেই আগের রূপটি যেন আর ধরা দেয় না। এখন গ্রামে গ্রামে কাঁচা-পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, পাকাবাড়ি, বিদ্যুতের সরবরাহ ও বৈদ্যুতিক বিনোদন সরঞ্জামাদির ব্যবহারে বর্ষাকেও কৃত্রিম মনে হয়। আর বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে বর্ষার রূপ ও প্রকৃতিতেও ঘটেছে ছন্দপতন। তাই তো দেখি ভরা শ্রাবণেও সেচ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উঠিয়ে আমন ধানের চারা রোপণ করতে। নদী-নালা, খাল-বিল যেমন বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি ভরাটও হচ্ছে ধীরে ধীরে। জলের যে বিস্তৃতি বা থৈ থৈ ভাব তা ক’দিনই আর এখন চোখে পড়ে? এখন আর ছোট ছোট নৌকা আর ভেলার ব্যবহার তেমন নেই, ছইতোলা নৌকা-গয়না দিয়ে বউ-ঝিয়েরা তেমন নাইওর যায় না। নদী আর হাওড়-বিলে রঙিন পালতোলা নৌকার সারির সেই নান্দনিক দৃশ্য আজ কোথায় গেল? যান্ত্রিক নৌকার ভটভট আওয়াজে মাঝি কী করে তুলবে মধুর ভাটিয়ালী গান? বাড়ির পাশের ধানক্ষেত, ডোবা, নালা, খাল-বিল নদীতে মাছ ধরার সেই দৃশ্য আজ কমে গেছে। এখন পদ্ম-শাপলা ফোটা বিল সীমিত, কচ্ছপ-কাছিম আর শামুক-ঝিনুকের বিচিত্র বিচরণ কম, সাপ-গুইসাপের নিঃশব্দ সন্তরণ নেই, রাতভর ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিমধরা ডাক তেমন শুনি না। এখন আর সোমেশ্বরী নদী দিয়ে হাতি আর প্রকা- গাছ ভেসে আসার গল্প শুনি না, মহাশোল আর বড় বাঘাইড় মাছ ধরার আনন্দও এখন চোখে পড়ে না। যে সুস্বাদু মাছগুলো বর্ষার মূল আনন্দের খোড়াক, তাদের দুষ্প্রাপ্যতা বর্ষার আনন্দকে আজ মাটি করে দিয়েছে। আজ বর্ষা আছে কিন্তু চিঁড়েকুটা আর খৈ ভাজা তেমন আছে কি? দাবা, লুডু, তাস খেলা, পুঁথিপাঠ ও কাঁথা সেলাইয়ে সময় কাটানো আনন্দ বহুগুণে কমে এসেছে। তবুও এখানে হরেক রকম বৃষ্টি আসে, বর্ষা আসে, মাটি ফিরে পায় প্রাণ, সবুজ-শ্যামলিমায় ভরে যায় আনাচ-কানাচ মাঠ-প্রান্তর। কম করে হলেও ফোটে রকমারি বর্ষার ফুল, ওড়ে ভ্রমর-প্রজাপতি, রকমারি রসালো ফলে মিষ্টি হয় মুখ, শিশু-কিশোররা মেতে ওঠে বর্ষার জলক্রীড়ায়, লাগাতার মুষলধারে বৃষ্টির নিক্কণ ছন্দে জেগে ওঠে প্রেমিক মন, আর তাই তো কবিগুরুর সুরে অনেকেই গেয়ে ওঠেÑ ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরীষায়’, ‘আষাঢ়-শ্রাবণ মানে না তো মন’ অথবা আধুনিক কবিদের সুরেÑ ‘আকাশ এতো মেঘলা, যেও না তো একলা’ অথবা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর পায়ে দিয়ে সোনার নূপুর, আঁকাবাঁকা মেঠো পথে কোন রূপসী হেঁটে যায়’? আরও কত গান কবিতা জন্ম দেয় এই বর্ষা। বর্ষা মাটিকে সিক্ত আর উর্বর করে, মানুষকে সিক্ত করে আর সিক্ত করে মানুষের মনকেও। তাই তো বর্ষা অপরূপা অনন্যা এ গ্রামবাংলায়। দুর্গাপুর, নেত্রকোনা থেকে
×