ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

বহুমাত্রিক আনুষ্ঠানিকতায় উদ্দীপ্ত সেলিম আল দীন জন্মোৎসব

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৯ আগস্ট ২০১৫

বহুমাত্রিক আনুষ্ঠানিকতায় উদ্দীপ্ত সেলিম আল দীন জন্মোৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শরতের মেঘে ভাসা এমনি দিনে জন্মেছিলেন সেলিম আল দীন। আনন্দ-বেদনার যুগলবন্দীতে আজ তিনি আসছেন স্মরণে। আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে ভালবাসা আর আবেগে উদ্্যাপিত হচ্ছে তাঁর জন্মদিন। আর বেদনার বিষয়টি হচ্ছে তিনি নেই। তবে সৃষ্টির ঐশ্বর্যে অনাদিকাল পর্যন্ত স্মরিত হবেন তিনি। বাংলা নাট্য ভুবনের কিংবদন্তি নাট্যকার সেলিম আল দীনের জন্মদিনে এভাবেই বললেন তাঁর জীবনসঙ্গী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা। মঙ্গলবার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে নাট্যাচার্যের এক জন্মোৎসবের উদ্বোধনী বক্তব্যে এভাবেই আপন আবেগের প্রকাশ ঘটান মেহেরুন্নেসা। আর এই দিনটি ছিল বাংলা নাটকের অনন্য এক নাট্যকার সেলিম আল দীনে ৬৬তম জন্মবার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা নাটকে নতুন আলোর দিশারী হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই বরেণ্য নাট্যকার। পশ্চিমা নাট্যরীতিকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেছেন হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্য নিয়ে। বাংলা নাটকে প্রবর্তন করেছেন বর্ণনাত্মক ধারা। নাট্যরচয়িতা পরিচয়ের বাইরে দীর্ঘ তিন যুগ ধরে নাট্যকেন্দ্রিক নানা কর্মতৎপরতা, গবেষণা, চর্চা ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন শিল্পের উচ্চতম শিখরে। বাংলার ঐতিহ্য ও শেকড়সন্ধানী এই নাট্যকারের জন্মদিনে ছিল বহুমাত্রিক আয়োজন। এসব আয়োজনে নানা আনুষ্ঠানিকতা স্মরণ করা হয় বাংলানাট্যের এই যুগস্রষ্টাকে। সকাল থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতা। পুষ্পবৃষ্টিতে সিক্ত হয় তাঁর কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত সমাধিসৌধ। ফুলেল শুভেচ্ছা নিবেদনের আগে বের করা হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। অন্যদিকে বিকেল থেকেই নাট্যাচার্যের জন্মোৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা প্রাঙ্গণ। সেমিনার, নাট্য প্রদর্শনী, নাট্যকারের জীবনদর্শন ও শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা, তাঁর রচিত গানের অভিনয় ও কোরিওগ্রাফিসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় বৈভবময় হয়ে ওঠে জন্মোৎসবের আয়োজন। নাট্যকারকে নিবেদিত পুষ্পাঞ্জলি ও শোভাযাত্রা ॥ জনকণ্ঠের জাবি সংবাদদাতা জানান, সেলিম আল দীনের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। এরপর একে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা, নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ, জাবির নাটক নাট্যত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আফসার আহমদসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ঢাকা থিয়েটার, স্বপ্নদল, দ্যাশ বাঙলা নাট্যদল, বুনন থিয়েটার, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, তালুকনগর থিয়েটার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, সেলিম আল দীন ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন। সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের আগে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বের কর হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এছাড়া শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে প্রদর্শিত হয় তথ্যচিত্র। আর সন্ধ্যায় এই মিলনায়তনের থিয়েটার ল্যাবে মঞ্চস্থ হয় সেলিম আল দীন রচিত নাটক ঊষা উৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন দিনের উৎসবে আজ বুধবার ও কাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একই মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হবে নাট্যাচার্য রচিত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পরিবেশিত নাটক স্বর্ণ বোয়াল। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জন্মোৎসব ॥ ‘নিকষ আঁধারে সদা জাজ্বল্যমান, ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথ সেলিম আল দীন’ সেøাগানে নাট্যসংগঠন স্বপ্নদলের আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমিতে মঙ্গলবার থেকে শুরু হলো দুই দিনব্যাপী ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জন্মোৎসবÑ২০১৫’। বিকেলে নাট্যাচার্যের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা একাডেমির সেমিনার কক্ষে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন। এরপর মঞ্চসারথী আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সেলিম আল দীনের জীবন-শিল্পকর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনা এবং ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন : নবীন দর্শকের দৃষ্টিতে’ শীর্ষক সেমিনার। সমকালীন নাট্যসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন দর্শক এতে অভিমত উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নাট্যাচার্যের শিল্পসঙ্গী নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যজন এস এম মহসীন, জাবি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান খায়েরুজ্জাহান মিতু, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল নাট্যজন আকতারুজ্জামান ও মূকাভিনয় ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল রিজোয়ান রাজন। সেমিনার শেষে অতিথিরা সবাই মিলে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। সন্ধ্যায় এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে জাহিদ রিপনের নির্দেশনায় স্বপ্নদল পরিবেশন করে সেলিম আল দীনের কালজয়ী নাটক ‘হরগজ’। সভাপতির বক্তব্যে আতাউর রহমান বলেন, বাংলা নাটকে বর্ণনাত্মক রীতির প্রচলন করেন সেলিম আল দীন। বর্ণনা দিয়ে কথার জালে দর্শককে নাটকের সঙ্গে বেঁধেছিলেন তিনি। অনাড়ম্বর অভিনয়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তাঁর নাটকের সংলাপে ছিল একইসঙ্গে গীতিময়তা ও কাব্যিক ব্যঞ্জনা। আর কাব্যে যে কথাটি সংক্ষেপে বলা যায় গদ্যে তা অনেক বড় হয়ে যায়। বাংলার মাটির রসসহ বিশ্ব দর্শনকে আত্মস্থ করেই ইঙ্গিতময় প্রকাশে রচনা করেছিলেন নাটক। আজ বুধবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় স্টুডিও থিয়েটার হলে জাহিদ রিপনের নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’-র মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হবে। বুনন থিয়েটারের আয়োজনে জন্মোৎসব ॥ শব্দে শব্দে শূন্যতায় বাজে পূর্ণতার শঙ্খ সেøাগানে নাট্যাচার্যের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করে বুনন থিয়েটার। মঙ্গলবার শরতের বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে সেলিম আল দীনের গানের ওপর অভিনয় ও কোরিগ্রাফি অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বাদনের মাধ্যমে শুরু হয় এ উৎসব। আর সন্ধ্যায় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় সেলিম আলম দীন রচিত ও আনন জামান নির্দের্শিত দলটির পরিবেশিত চাকা নাটকের ২৫তম প্রদর্শনী। এর আগে প্রযোজনাটির রজতজয়ন্তীর প্রদর্শনীর আশীর্বচনে অংশ নেন নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা ও মঞ্চকুসুমক অভিনয়শিল্পী শিমূল ইউসুফ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান। চাকা নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আশরাফুল বিলাস, শুভনন্দ করিম, রাজন কান্তি দে, দেওয়ান শাত-ইল, ললিত মৌসুম, শ্রাবন্তী লিজা প্রমুখ। ঢাকা থিয়েটারের সেলিম আল দীন উৎসব ॥ নাট্যাচার্যের জন্মজয়ন্তী চার দিনের কর্মসূচী নিয়েছে ঢাকা থিয়েটার। শুক্রবার সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে সেলিম আলম দীন উৎসবের সূচনা হয়। আজ বুধবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টার থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে তাঁর নাট্য চরিত্রগুলোকে নিয়ে পরিবেশনা ‘পুতুল তোমার জনম কী রূপ’। উৎসবের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একই মিলনায়তনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ মঞ্চস্থ করবে স্বর্ণবোয়াল। শুক্রবার বিকেল চারটায় শিল্পকলার সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে স্মারক বক্তৃতা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সেলিম আল দীন ফাউন্ডেশন থেকে দেয়া হবে ‘সেলিম আল দীন পদক’। পদক পাচ্ছেন কলকাতার অধ্যাপক অরুণ সেন। এছাড়া ঢাকা থিয়েটার একজন জ্যেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বকে মীর মকসুদ উস সালেহীন-বজলুল করিম পদক ও একজন নবীন নাট্যকর্মীকে দেয়া হবে ফওজিয়া ইয়াসমিন শিবলী পদক। ছায়ানটে ট্যাগোর ইন সুফিয়ানা ॥ সুফি মতবাদ সব দেশে সব কালেই কট্টরপন্থীদের কাছ থেকে মানুষকে সহজিয়া পথে নিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছে। সেই মতবাদের অনুসারীরাই সঙ্গীতে সুফিধারার সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি দেশের সংস্কৃতিতেই তাই সুফি গানের দেখা পাওয়া যায়। তবে সেইসব দেশের সংস্কৃতি, সামাজিক বাস্তবতাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠে তার সুর, কথা ও আবেগের প্রকাশ। তাঁরা সবাই আধ্যাত্মবাদ বা ভক্তিমূলক গানের চর্চা করেন। এদের মধ্যে অনেকেই দলবেঁধে পরিবেশন করেন সুফি সঙ্গীত আবার কেউ বা গান শোনান একক কণ্ঠে। অনেক কবি সাহিত্যিক সুফিবাদের ধারায় প্রভাবিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সুফিধারার চিন্তা ও মৃতভাবনাকে অবলম্বন করে বিশেষ আয়োজন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে ভারতের দল শ্রুতিবৃত্ত। মঙ্গলবার দলটি রবীন্দ্রনাথকে উপজীব্য করে উপস্থাপন করে ‘ট্যাগোর ইন সুফিয়ানা ও দ্য ওয়ে’ শীর্ষক বিশেষ পরিবেশনা। শরতের সন্ধ্যায় ধানম-ির ছায়ানট ভবনের রমেশ চন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলন কেন্দ্রে পরিবেশিত আয়োজনটির পরিকল্পনার পাশাপাশি কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে আবৃত্তি করেন শুভদীপ চক্রবর্তী। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শম্বুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে সেতারে ছিলেন দীপশঙ্কর ভট্টাচার্য আর তবলায় সঙ্গত করেন নবারুন দত্ত। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের পাঁচ শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করেন। এরা হলেন মাহবুবা কামাল, গোলাম হায়দার, জাকির হোসেন তপন, আমিনা আহমেদ ও সাঈদা হোসেন পাপড়ি।
×