ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

প্রতিবাদে তারাই ভরসা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৯ আগস্ট ২০১৫

প্রতিবাদে তারাই ভরসা

দু’হাজার সাত-এর বিশ আগস্ট ছাত্ররাই জানিয়ে দিয়েছিল এখনও তারাই সমাজের প্রতিবাদী অংশ। এ দেশের ইতিহাস গড়ার প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য অংশ ছাত্র রাজনীতি। যে দৃষ্টিকোণ থেকেই হোক ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা অস্বীকার করে কেউ ইতিহাস লিখতে পারবেন না। ছাত্র রাজনীতির আজকের অবস্থা দেখে অনেকেই একে নাকচ করতে চান এই বলে যে, চরম অধঃপতনে পৌঁছেছে ছাত্র রাজনীতি; যা তার মূল বৈশিষ্ট্য, আদর্শ ও প্রতিবাদী চরিত্র হারিয়ে স্বার্থের আবর্তে পাক খাচ্ছে। অভিযোগ পুরো স্বীকার করেও বলতে হয়Ñ আজও ছাত্ররাই সমাজের অন্যতম প্রতিবাদী অংশ। এর শেষ প্রমাণ রয়েছে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। দু’বছরের জরুরী অবস্থায় যে সামান্য প্রতিবাদ এসেছিল তা ছাত্রদের কাছ থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনাসদস্যদের দুর্ব্যবহারে ফুঁসেছিল তারা। এ অল্প সময়ের ক্ষোভেই ক্যাম্পাস থেকে সেনারা ছাউনি সরাতে বাধ্য হয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরশাসন পতনের ইতিহাসও ছাত্রদের গড়া। ওই অভ্যুত্থানে অগ্রণী ছিল ছাত্ররা, এটা সবার জানা। একাত্তর, ঊনসত্তর, বায়ান্ন তো আছেই। কিন্তু নব্বইয়ের সফল আন্দোলনের পর থেকে অদ্ভুত এক আঁধার নেমেছে যেন ছাত্র রাজনীতিতে। আড়াই দশকে তা কেবল বেড়েছে। এ ক’বছরে মূল ধারার রাজনীতির গতি-প্রকৃতিই কি ঠিক থেকেছে? ছাত্র রাজনীতি মূল ধারার বাইরে নয়। মূল ধারার রাজনীতিতে গতি থাকলে ছাত্র রাজনীতিও গতি পায়। প্রত্যক্ষ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু। ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষদিকে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্ররাও যুক্ত হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশন তখন ছাত্রদের মুখপাত্র। ছাত্র রাজনীতির গতিরেখা অন্যভাবে স্পষ্ট হয় পঞ্চাশের দশক পেরিয়ে। ষাটে এসে চূড়ান্ত প্রতিবাদী রূপ পায়। ব্রিটিশ বিতাড়নের মধ্য দিয়ে ভারতে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন শেষ হলেও আমাদের সে আন্দোলন করতে হয়েছে আরও কয়েকবার, এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে ছাত্ররাই। তারাই তখন অগ্রবর্তী। রাজনৈতিক দলগুলো বরং বলা যায় সহযোগীর ভূমিকায় ছিল। ছাত্র রাজনীতি তখন পুরোপুরি আদর্শিক ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে লড়েছে। ব্যক্তিস্বার্থের বদলে সমষ্টিবাদের আদর্শ গুরুত্ব পেয়েছে। অবশ্য তখন সময়টাই ছিল অন্যরকম। এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বহু দেশে তখন ব্যাপক গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছাত্র আন্দোলন এগিয়েছে। সবখানেই সামনে ছিল জাতীয় মুক্তির আদর্শ। আন্তর্জাতিকভাবেই ষাট দশক ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য সময়। যদিও অনেক দেশেই শেষ পর্যন্ত আন্দোলন অসম্পূর্ণ থেকেছে অথবা প্রত্যাশিত লক্ষ্যে যেতে পারেনি। ভারত ভাগ করে এখান থেকে ঔপনিবেশিক প্রভু বিদায় নিলেও সে জায়গা পূরণ করে সামরিক শাসন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার বছরতিনেক পর থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দানা বাঁধতে থাকে এবং তা শুরু করে ছাত্র সংগঠনগুলো। মূলত ছাত্র ইউনিয়ন সে সময় ছাত্রদের মধ্যে সুসংগঠিত আন্দোলন গড়তে নেতৃত্ব দেয়। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন সর্বাত্মক ছাত্রধর্মঘট তারাই ডাকে এবং সফল হয়। তবে সংগঠিত আন্দোলন শুরু এবং তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিলেও নেতৃত্বের দুুর্বলতায় আটকে যায় তারা। মতাদর্শিক বিতর্কে পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়। এর প্রভাবে ভাঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নও। নেতৃত্বের শূন্য জায়গা পূরণ করে ছাত্রলীগ। তারপর তো ঊনসত্তর। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সফল গণঅভ্যুত্থানে ইতিহাসের আরেক অধ্যায় শুরু। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, আগরতলা শেষে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির স্পষ্ট আদর্শবাদী ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে আদর্শের উজ্জ্বলতা ক্রমশ কমতে থাকে। জাতীয় রাজনীতির আলো-হাওয়ায় পুষ্ট হলেও স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত তার নিজস্ব দ্যুতি ছাপিয়ে মূল দল বড় হয়নি। পরে তাই হলো। ক্ষুব্ধ স্বার্থহীন আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠন দলীয় সঙ্কীর্ণতায় দীর্ণ হয়ে ক্রমশ পুরনো গৌরব হারাল। স্বাধীন দেশে সামরিক শাসন জন্ম দিল আরেক রাজনৈতিক দল। সত্তর দশকের দ্বিতীয় ভাগে সে দলের ছাত্র অঙ্গসংগঠন ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্র চর্চার নতুন মাত্রা যোগ করে রাজনীতির ধারাই পাল্টে দেয়। তেজস্বিতা, আদর্শবাদ, দেশপ্রেমের জায়গা নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাস, চাঁদা ও টেন্ডার প্রতিযোগিতা। প্রত্যক্ষ প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে নিজেরাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয় এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে মূল রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে একে লালন করে। ছাত্ররা ১৯৯০ সালে ঝলসে ওঠে আরেক সামরিক শাসকের পতন ঘটাতে। তিনি সেনা ব্যারাক থেকে এসে গণতন্ত্রের পোশাক পরার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট অনিচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়েন। এ শাসক ক্ষমতা ঘাড়ে নিয়ে শিক্ষানীতি ঘোষণা করলে তার যুগের প্রথম পর্বেই ছাত্ররা জানিয়ে দিয়েছিল তারা আছে। ষাট দশকে শিক্ষানীতি ইস্যু করে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, আশির দশকেও তাই। বিরাশি সালের শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গড়ায় বুর্জোয়া নাগরিক অভ্যুত্থানে, যার মূল নায়ক ছিল ছাত্ররা। তারপর গণতন্ত্রের হাওয়া বইল দেশে, ছাত্র রাজনীতিতে আদর্শ আর ফিরল না। আদর্শের ধারক হলো ছোটখাটো বাম সংগঠনগুলো; যাদের শক্তি সীমিত। একেবারে এ সময়ে এসে ছাত্র রাজনীতির অবস্থা কি? এখন ক্যাম্পাসে গোয়েন্দা লাগিয়ে ‘ভাল’ ছাত্রনেতা খুঁজতে হয়Ñ এ তথ্যে বোঝা যায় ছাত্র রাজনীতিতে সাংগঠনিক চর্চা কোথায় পৌঁছেছে। অস্ত্রের ঝনঝনানি কিছুটা কমলেও বেড়েছে বয়সের বিড়ম্বনা। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে এখনও অনেকে ‘ছাত্রনেতা’ হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন; যাদের অনেকের সন্তানও স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। ‘হল দখল’ স্ট্র্যাটেজি বাজার হারালে সে জায়গা নেয় ‘পদবাণিজ্য’। বয়স পেরুলেও ছাত্রত্ব ধরে রাখার এই প্রাণপণ চেষ্টা সেজন্যই। ছাত্র আন্দোলন বলতেই চোখের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভেসে উঠলেও আন্দোলন বলতে যা বোঝায় তা দীর্ঘদিন সেখানে অনুপস্থিত। শান্ত ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত বুয়েটে বছরখানেক আগে চলেছে অন্যরকম এক আন্দোলন। যার শুরু শিক্ষকদের মধ্য থেকে। বলা যায়, শিক্ষকদের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল ছাত্ররা। আন্দোলন চলেছে শান্তিপূর্ণভাবে। এটাই ছিল এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ইস্যু যাই হোক, পক্ষে-প্রতিপক্ষে সন্ত্রাসী কর্মসূচী পুরোটাই অনুপস্থিত ছিল এখানে। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের আন্দোলন হয়ে গেল। দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই বিক্ষুব্ধ হওয়ার বীজ খুঁজলে হয়ত দেখা যাবে তা রয়েছে মূলধারার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যেই। সুতরাং আগে সংশোধন হতে হবে মূলকে।
×