ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিপ্তি ইসলাম

অভিমত॥ পুঁথিগত বিদ্যা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৭ আগস্ট ২০১৫

অভিমত॥ পুঁথিগত বিদ্যা

যে বিদ্যা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায় না তাই পুঁথিগত বিদ্যা। যে শিক্ষার সঙ্গে জ্ঞানার্জনের বিশেষ কোন সম্বন্ধ নেই, কেবল জীবিকার জন্য ব্যবহৃত হয় তাই পুঁথিগত বিদ্যা। তবে এ শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে সামাজিক জীবনের এক প্রকার ভারসাম্য বজায় থাকে। এ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে শৃঙ্খল আবর্তের মধ্যে। তবে পুঁথিগত শিক্ষা শিক্ষিত মানুষের ভাবগাম্বীর্জ বাড়াতে ও ভদ্রবেশী ভদ্রলোক হতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত মানুষ বেশিরভাগই একাডেমিক শিক্ষা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে চুকিয়ে দেয় পড়াশোনার সঙ্গে সকল সম্পর্ক। প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় না কোন বিনোদন। কারণ একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বা বিনোদনের কোন সম্বন্ধ থাকে না। পুঁথিগত বিদ্যা যেন আরাম-আয়াস, ভোগ-বিলাসের জন্য নিবেদিতপ্রাণের আজীবন প্রয়াস। অথচ জ্ঞানার্জনই বিনোদনের সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। আর সৃজনশীল ও মানবিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে শিক্ষা অর্জিত হয় তাই প্রকৃত শিক্ষা। পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে থাকে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক। সামাজিক মর্যাদার সম্পর্ক। এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচিত হয় জীবিকার হাতিয়ার হিসেবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জীবন ও জীবিকা এক কঠিন সংগ্রামের নাম। তাই মানুষ বিদ্যার সঙ্গে বিনোদনের কোন যোগসূত্র খুঁজে না, খুঁজে জীবিকা। বিদ্যার কাছে শরণাপন্ন হয় না বুদ্ধির জন্য। ভুল করেও মনে হয় না শিক্ষার কাছে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে সমস্যা সমাধানের জন্য। বিদ্যাপীঠ শিক্ষার্থীদের তৈরি করে প্রমাণপত্র পাওয়ার উপযোগী করে। প্রমাণপত্রের নিশ্চয়তা বা স্বীকৃতি দেয়াই বিদ্যাপীঠের কাজ। প্রমাণপত্র বা নিবন্ধনই হলো পুঁথিগত বিদ্যার যোগ্যতার মাপকাঠি। বিদ্যাপীঠগুলো গড়ে ওঠে তীব্র প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ মানের প্রমাণপত্রের জন্য। কারণ প্রমাণপত্র অর্জিত হলে কর্মজীবন তথা পার্থিব জীবন হবে অধিকতর আরামদায়ক ও সম্মানজনক। জ্ঞানার্জন সীমাবদ্ধ থাকে শিট, পাঠ্যবই, গাইড, অবশেষে পরীক্ষার খাতা পর্যন্ত। আর এটাই পুঁথিগত বিদ্যার প্রধান লক্ষ্য। যারা পুঁথিগত বা একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয় তাদের বলা হয় অশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত, আর যারা এই প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত বা নিবন্ধিত তাদের বলা হয় শিক্ষিত। এই শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউ নয় গতানুগতিক ধ্যান-ধারণার উর্ধে। উভয়ের মধ্যেই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কীর্ণতা বিদ্যমান। এরা জীবন ও জগত সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণার ওপর নির্ভরশীল প্রথাগত পাপী। প্রজ্ঞাহীন চেতনায় প্রতিক্রিয়াশীল। নিয়তিতে বিশ্বাসী গতানুগতিক। জ্ঞানার্জনের পিপাসা নিয়ে, সেবার মানসিকতা নিয়ে পেরুতে হবে শিক্ষাঙ্গন। যে জাতি যত বেশি জ্ঞানী, সে জাতি তত বেশি মানবিক। যে জাতি যত বেশি ন্যায়পরায়ণ, সে জাতি তত বেশি ত্যাগী। জ্ঞানার্জনের পিপাসা মানুষকে দান করে অমরত্ব। অর্জিত জ্ঞানের আলো আলোকিত করে একটু একটু করে পৃথিবীকে। শিক্ষাক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে পুঁথিগত বিদ্যার এক বিশাল সংস্কৃতি। যাকে ভাত-কাপড়, প্রাসাদ-অট্টালিকার মতো প্রতীক দিয়ে নির্ণয় করা যায়। প্রত্যাশিত ও প্রয়োজনীয় গুণের, মাপের, মানের ও মাত্রার শিক্ষার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি এ দেশে এখনও। তাই চিন্তা ও চেতনায় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় জীবনে পশ্চাৎমুখী বলয়ে রয়ে গেছে। পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্যানরা পৌঁছাতে পারে না সেক্যুলার চেতনার আনুকূল্যে। অনুমান, আন্দাজ, কল্পনাপ্রসূত প্রথা পদ্ধতির সঙ্গে এক প্রকার সমন্বয় করে জীবন অতিবাহিত করে। পুঁথিগত বিদ্যার গুণ, গৌরব-গর্ব নিয়ে আস্থাভাজন হন সুজান ও সজ্জনে। এক কথায় আত্মসেবী শ্রেষ্ঠ নাগরিক বনে যান। বিদ্যা মানুষকে অর্জন করতে হয় নিজ পরিবার, প্রতিবেশ, প্রতিকূলতা ও প্রকৃতি থেকে। বোধ থেকে, বিবেক থেকে, নিজের জন্মের পরিম-ল থেকে। দেশী-বিদেশী বই ও পত্রিকা পড়া অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে। অন্যের সুখে ও দুঃখে শরিক হয়ে, হোক সে পশু কিংবা প্রতঙ্গ, হোক সে সংখ্যালঘু কিংবা ভিনদেশী, বিধর্মী। প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তির চোখের গভীরতা, হৃদয়ের প্রসারতা আর দৃষ্টিভঙ্গির দূরদর্শিতা বিশ্ব সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ। প্রকৃত শিক্ষা যেন জ্ঞানার্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, আর জীবিকার মাধ্যম হোক কর্মমুখী শিক্ষা। জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হোক সৃজনশীল শিক্ষা। বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হোক গবেষণামূলক।
×