ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতে জমা দিল ৭১ টিভি ॥ আদেশ কাল

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৭ আগস্ট ২০১৫

আদালতে জমা দিল ৭১ টিভি ॥  আদেশ কাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য এক বিচারপতির কথোপকথন নিয়ে একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত খবর এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের ভিডিও সিডি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে দাখিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রচারিত প্রধান বিচারপতি ও আরেক বিচারপতির কথোপকথনের অডিও সিডিও দাখিল করেছে একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ, যেখানে এক বিচারপতিকে বেঞ্চে না রাখতে সাকার পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করার বিষয়টি প্রধান বিচারপতি স্বীকার করেছেন। এছাড়া বাড়ির মামলায় মওদুদ আহমদ এক বিচারপতিকে বেঞ্চে না রাখতে প্রধান বিচারপতির হাতে পায়ে ধরেছেন, প্রধান বিচারপতির কণ্ঠে এমন স্বীকারোক্তিও ওই সিডিতে রয়েছে। রবিবার সকালে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপীল বিভাগে সিডি দাখিল করেন। সিডি দাখিলের পর আপীল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে দুই সদস্যের বেঞ্চ বিষয়টি মঙ্গলবার কার্যতালিকায় আদেশের জন্য রাখার নির্দেশ দেন। এরপর জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন দাঁড়িয়ে আদালতকে জানান, জনকণ্ঠের মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এরপরও কেন এই মামলাটি আজকের (রবিবার) কার্যতালিকায় এসেছে। এ সময় আদালত বলেন, ভুল করে মামলাটি আবার কার্যতালিকায় এসেছে। এর আগে গত ১০ আগস্ট সোমবার জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (এম এ খান মাসুদ) এবং নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়ের পক্ষে আপীল বিভাগে দাখিল করা রুলের জবাবের সঙ্গে ওই কথোপকথনের সিডি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এরপরই ওই সিডি খবর এবং প্রতিদিনের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘একাত্তর জার্নালে’ প্রচার করে একাত্তর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। গত ১১ আগস্ট এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, দৈনিক জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে সোমবার একাত্তর টেলিভিশন প্রধান বিচারপতির একটি কথোপকথন প্রচার করে। যাতে প্রধান বিচারপতির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যার সঙ্গে কথা হয়েছে তার ছবি দেখানো হয়নি, ব্ল্যাকে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, এরপর মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বিভাগ আমার ও সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের মতামত জেনেছেন। এরপর একাত্তর টিভির প্রচারিত ভিডিও এবং টকশোর ভিডিও ১৬ আগস্টের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রবিবার সকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, একাত্তরের সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা প্রমুখ। রবিবার একাত্তর টিভির পক্ষে আদালতে সিডি উপস্থাপনের পর জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন সাংবাদিকদের বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত খবর ও টকশোতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য এক বিচারপতির কথোপকথন প্রচার করে একাত্তর টেলিভিশন। সেখানে সাকা চৌধুরীর আপীল মামলায় এক বিচারপতিকে বেঞ্চে না রাখতে প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হয়েছিল বলে তিনি স্বীকার করেছেন। এছাড়া মওদুদ আহমদের বাড়ির মামলায় প্রধান বিচারপতির হাতে পায়ে ধরে এক বিচারপতিকে বেঞ্চে না রাখতে অনুরোধ করেছেন, এমন কথোপকথনও ওই সিডিতে রয়েছে। সেই সিডি জনকণ্ঠের পক্ষে আদালতে দাখিলের পর একাত্তর টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। এ কারণে একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষকে ওই দিনের খবর ও টকশোর সিডি আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। তিনি বলেন, আদালতের প্রতি সম্মান রেখে একাত্তর টেলিভিশন খবর ও টকশোর ভিডিও সিডি এবং প্রধান বিচারপতির কথোপকথনের অডিও সিডি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ার পরও, তা আবার রবিবারের কার্যতালিকায় আসে। পরে বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হলে ভুলবশত এসেছে বলে আদালত জানিয়েছেন। সিডি দাখিলের পর একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু সাংবাদিকদের বলেন, যে কথোপকথন প্রচার করার কারণে আদালত আমাদের খবর ও টকশোর সিডি দাখিল করতে বলেছেন, তা গত সোমবারই জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর কোন বিষয় আদালতে উপস্থাপনের পর সেটি পাবলিক প্রপার্টি হয়ে যায়। আমরাসহ অনেকেই ওই খবর প্রচার করেছে। তবে কেন আদালত বিশেষভাবে আমাদের সংবাদ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের সিডি চেয়েছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা আদালতে সিডি দাখিল করেছি। আদালত মঙ্গলবার আদেশ দিবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আদালতে উপস্থাপিত কোন বিষয় নিয়ে সংবাদ করলে, তার মাধ্যমে আদালত অবমাননা হবে না। গত ১০ আগস্ট সোমবার আপীল বিভাগে ৬ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে জনকণ্ঠের মামলার শুনানিতে আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন একটি অডিও রেকর্ডের শ্রুতিলিখন উপস্থাপন করেন, যেটি বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলা এবং মওদুদ আহমদের বাড়ি নিয়ে মামলার বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য এক বিচারপতির কথোপকথন যেখানে সাকা পরিবারের পক্ষ প্রধান বিচারপতির সাক্ষাতের বিষয় ও মওদুদ আহমদ তার নিজ মামলার এক বিচারপতিকে না রাখার কথা বলেন। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি এই কথোপকথনের বিষয়টি স্বীকারও করেন। পরে গত সোমবার রাতে একাত্তর টেলিভিশনে জনকণ্ঠের আদালত অবমাননা মামলা নিয়ে প্রতিবেদনে ওই অডিও টেপ সম্প্রচার করে। এছাড়া রাতে তাদের সংবাদ বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান ‘একাত্তর জার্নাল’- এও ওই টেপের বিষয়ে আলোচনাও হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অডিও টেপটি শোনানো হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেন মিথিলা ফারজানা। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন এবং সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল ইসলাম এবং টেলিফোনে যোগদেন জনকণ্ঠের আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন। ওই অনুষ্ঠানে সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বিচারপতিদের কোড অব কন্ডক্টের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করেন। তিনি বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট ২০০০ এর ১৪টি ধারা এবং কি করলে এই কন্ডাক্টের ধারা লঙ্ঘন হয় তা তুলে ধরেন। বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার রায়ের পাশাপাশি বিচারপতি নিজের অবস্থানটাও নিশ্চয়ই পরিষ্কার করবেন বলে তিনি মনে করেন। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তিনজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর পদত্যাগ করার উদাহরণ দেন। তিনি আরও বলেন, এই ধরনের শপথ ভঙ্গ করার পর ইমপিচমেন্টের চেয়ে পদত্যাগ করাই ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিনও সাংবাদিক মঞ্জুরুল ইসলামের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। এছাড়া তিনি প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা রয়েছে বেঞ্চ পুনর্গঠন করার, এ্যাটর্নি জেনারেলের এমন দাবির বিষয়ে বলেন, সব কিছুর পরও তার একটা কোড অব কন্ডাক্ট আছে। আমাদের চাকরির ক্ষেত্রে কোড অব কন্ডাক্ট রয়েছে। যেটা আমদের মানতে হয়। এর বাইরে আমরা যেতে পারি না। এই আলোচনা অনুষ্ঠানে দুই আলোচকই প্রধান বিচারপতি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে যে প্রকাশ্য আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়টিও তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, গত ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সাকার পরিবারের তৎপরতা/পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয় লেখেন নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়। ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর আপীলেও মৃত্যুদ- বহাল রাখার রায়ের পর পরই জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে তলব করে আদেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশ অনুয়ায়ী ৩ আগস্ট জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (এম এ খান মাসুদ) এবং নিবন্ধের লেখক নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় আদালতে উপস্থিত হন। এবং তিন মাসের সময়ের আবেদন করেন। পরে আদালত এক সপ্তাহের সময় দেন। পরবর্তীতে গত রবিবার ও সোমবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত বৃহস্পতিবার আদেশ দেন সুপ্রীমকোর্ট। আদেশে, আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে ওই দিন আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন সময় পর্যন্ত এজলাসে বসে থাকার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তাদের দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। এই জরিমানার টাকা দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আদেশে। এছাড়া জরিমানা অনাদায়ে তাদের সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদ- ভোগ করতে হবে বলেও আদেশে বলা হয়।
×