ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৬ আগস্ট ২০১৫

গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

পত্রিকার সূত্র মতে গড় আয়ু এখন ৭০-এর বেশি। এ নিয়ে Independent TV-তে আমাকে ‘আশার বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে ১৫ মিনিটের জন্য কিছু বলতে হয়েছে। এত বড় অর্জনের জন্য বলতে গেলে ১৫ মিনিট যথেষ্ট নয়, তেমনি খবরের নিউজটাও খুব বিশদ ছিল না। সাংবাদিক ভাইয়েরা বোধ হয় হেডলাইন করেননি, কারণ তাঁরা গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে নিশ্চয়ই পুষ্টি সংক্রান্ত অর্জনকে সন্তোষজনক মনে করেননি। যদিও HPNSDP (Health, Population, Nutrition sector Development programme-এর কর্মসূচীতে পুষ্টির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ আছে, তবুও পুষ্টি নিয়ে, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু বা প্রতিষেধকের মতো বিশাল কোন কর্মযজ্ঞ চোখে পড়েনি বা প্রচারও তেমন নেই। পুষ্টির কথা শেষদিকে বলব। কেন গড় আয়ু দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের একটি, শিশুমৃত্যু হার কমানো। এ উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতিও লাভ করেছে। এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় এ অর্জন বিশাল এবং সরকার তার জন্য গর্ববোধ করতে পারেন। শিশুমৃত্যু রোধ বা কমানো গড় আয়ু বৃদ্ধির এক গাণিতিক নিয়ম। দ্বিতীয়টি হলো মাতৃমৃত্যু রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া এবং তাতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। গর্ভাবস্থায় অর্থাৎ গর্ভধারণের ৬ মাসের মধ্যে Abortionএবং Septic abortion বা Abortion জনিত রক্তক্ষরণ এবং সময়মতো ব্যবস্থা নেয়ার ব্যর্থতাও মাতৃমৃত্যুর একটা বিশাল কারণ এবং প্রসবকালীন সময়ে Obstructed Labour শুধু মাতৃমৃত্যু নয়, শিশুমৃত্যুরও অন্যতম কারণ। হরমোন, পুষ্টিজনিত, আঘাতজনিত বা অন্য অনেক কারণেই Premature delivery বা অপরিপক্ব প্রসব একটি অন্যতম কারণ শিশুমৃত্যু এবং শিশু পঙ্গুত্বের। প্রসবের পরে এবং আগে ঊপষধসঢ়ংরধ জনিত মাতৃমৃত্যুও এক সময় বিরাটসংখ্যক ছিল, যা বর্তমানে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য অনেকাংশে কমে এসেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রসব, প্রসবোত্তর ইনফেকশনও ছিল মাতৃমৃত্যুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা কিনা সরকারী এবং বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও নতুন নতুন এ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের জন্য অনেক কমে এসেছে। গর্ভধারণ অবস্থায় এবং প্রসবোত্তর সময়ে মায়েদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু আরও অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং গাণিতিক নিয়মে গড় আয়ুও বৃদ্ধি পাবে। ইমিউনাইজেশন বা রোগ প্রতিরোধক বা প্রতিষেধক প্রয়োগের জন্য সরকারের কর্মসূচী, গণ-মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ প্রচারণা বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে সংক্রামক ব্যাধিজনিত শিশুমৃত্যু রোধে বিশ্ব দরবারে এক শ্রদ্ধার আসনে পৌঁছে দিয়েছে। এক্ষেত্রে যেমন সরকার, গণমাধ্যম এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ধন্যবাদ পাবার যোগ্য, তেমনি এঅঠও (এষড়নধষ অষষরধহপব ভড়ৎ ঠধপপরহধঃরড়হ ্ ওসসঁহরুধঃরড়হ) এবং এধঃবং ভড়ঁহফধঃরড়হ অর্থাৎ ইওখখ ্ গঊখওঘউঅ এধঃবং ভড়ঁহফধঃরড়হ বেশিরভাগ কৃতিত্বের দাবিদার। কারণ তারাই বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনকে নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে দিতে সহায়তা করেছেন। এ কথা এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইরষষ ্ গঊখওঘউঅ এধঃবং ভড়ঁহফধঃরড়হ-এর মতো পৃথিবীর বড় ১০০ জন ধনী ব্যক্তি যদি তাদের সম্পদের কিয়দংশ এধঃবং ভড়ঁহফধঃরড়হ-এর মতো স্বাস্থ্য ও সেবামূলক খাতে দান করতেন তাহলে পৃথিবীতে দারিদ্র্য বা স্বল্পোন্নত দেশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না, বরং অনেকগুলো দরিদ্র দেশ মধ্যম আয়ের বা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে স্থান লাভ করতে পারত। তাই সংক্রামক ব্যাধিজনিত বা প্রতিরোধযোগ্য রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধ শুধু শিশুমৃত্যু রোধ করেনি, বরং গাণিতিক হারে গড় আয়ু বৃদ্ধিতে শক্তি জুগিয়ে দিয়েছে। ইওখখ ্ গঊখওঘউঅ এঅঞঊঝ ঋঙটঘউঅঞওঙঘ-এর সেøাগান হলোÑ ঊাবৎু ঢ়বৎংড়হ ফবংবৎাবং ঃযব পযধহপব ঃড় ষরাব ধ ঐবধষঃযু ্ চৎড়ফঁপঃরাব ষরভব. আমরা যখন সত্তরের দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র তখন শিশু বিভাগ এবং ধাত্রীবিদ্যা বিভাগে যথাক্রমে ডিপথেরিটিক ল্যারিংজাইটিস (শ্বাসনালীর ডিপথেরিয়া) এবং ধনুষ্টঙ্কার রোগ (টিটেনাস) দুটি শিশু ও মাতৃমৃত্যুর একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হতো। বর্তমানে ছাত্ররা ডিপথেরিয়ার রোগী দেখতেই পায় না। ধন্যবাদ উচঞ ভ্যাকসিনকে এবং মায়েদের যারা সময়মতো তার সন্তানের ভ্যাকসিন দিতে ভুল করেন না। শিশু চিকিৎসক বন্ধুরাও যাদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান দিতে এবং সাহস জোগাতে পেরেছেন তারা ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। কেননা আগে টিকার নাম শুনলেই আমরা স্কুল থেকে পালাতাম। মাথাপিছু আয় বা চবৎ ঈধঢ়রঃধ ওহপড়সব গত কয়েক বছরে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে, যাতে করে মানুষ নিজেই আমিষ বা ফলমূলের চাহিদা আংশিকভাবে হলেও মেটাতে পারছেন। স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং পুষ্টি সচেতনতা উভয়ে মৃত্যুরোধে যথেষ্ট ভূমিকা রেখে থাকে। বিশুদ্ধ পানীয় সরবরাহ, স্যানিটেশনের আংশিক উন্নতি, মৃত্যু ও ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু (গড়ৎঃধষরঃু ্ গড়ৎনরফরঃু) কমাতে যথেষ্ট সহায়তা করছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি এ পি জে. আবদুল কালামের ২০২০ স্বপ্ন পূরণে ভারতের করণীয় চটজঅ অর্থাৎ চৎড়ারফরহম টৎনধহ ভধপরষরঃরবং ঃড় জঁৎধষ অৎবধং, অত্যন্ত সুন্দর দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। বলেছেন, গ্রাম আর শহরের মধ্যকার পার্থক্য একটা সূক্ষ্ম লাইনের মতো হতে হবে। গড় আয়ুর বৃদ্ধির বিপদসঙ্কুল জায়গা হলো অসংক্রামক ব্যাধি (ঘড়হ পড়সসঁহরপধনষব ফরংবধংব)। যার মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, শ্বাসনালীর প্রদাহ, স্ট্রোক ইত্যাদি জাতীয় অসুখের যে হার বৃদ্ধি পাচ্ছে তার যথোপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। অবশ্যই এখন একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামে এ ব্যাপারে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যদি (ক) একটা গর্ভবতী মাকে সঠিক খাদ্যের এবং চলাচলে সঠিক আনুষঙ্গিক সব ধরনের উপদেশ দেয়, মাঝে মাঝে মায়ের প্রস্রাব পরীক্ষা এবং রক্তচাপ মেপে দেয়, (খ) একটা শিশুর জন্মের পরে যেভাবে দৈহিক বা ওজন বৃদ্ধি হওয়া উচিত তা হচ্ছে কি না? না হলে উপযুক্ত পরামর্শ নেয়ার কথা বলে দেয়া, (গ) ৪-৫ মাস বয়সে শিশুর পরিপূর্ণ শুনানি আছে কিনা, চোখে দেখতে পায় কিনা, তা প্রাথমিক পরীক্ষা করে দেখে দেয়, (ঘ) কোন বিকলাঙ্গতা আছে, দৈহিক বা মানসিক, (ঙ) সিনিয়ার সিটিজেনদের অর্থাৎ ষাট উর্ধ মহিলা ও পুরুষদের রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার (ইষড়ড়ফ ঝঁমধৎ) মেপে দেয় তাহলে অবশ্যই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অতি প্রাথমিক কাজটা সুন্দরভাবে করা যাবে। বাস্তবতা হলো, সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছেন, জনশক্তি নিয়োগ দিয়েছেন, মাঝে মাঝে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, কিন্তু তাদের বিবেক যদি তাড়া দেয় কর্তব্যস্থলে থাকার জন্য তাহলেই সম্ভব সরকারের স্বাস্থ্যসেবা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, কাজ না করে বেতন নেয়ার প্রবণতা অনেকের ব্যাপারে সত্য। আমার একজন প্রিয় শিক্ষক, প্রয়াত অধ্যাপক এসজিএম চৌধুরী স্যার বলতেন, ‘বয়স ষাট হলে স্বাভাবিকভাবে কমবেশি ৬টা এবং সত্তরের ওপরে হলে ৭ বা ৭-এর অধিক ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।’ এবং তাই সত্যি। সুতরাং সুস্থভাবে আরও বেশি বেঁচে থাকতে হলে, গড় আয়ুর পরিমাণ আরও বাড়াতে হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম আরও কমাতে হবে এবং এদের গুণগত মানও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিছু কিছু অসুখের জন্য খাদ্যে ভেজাল একটা অন্যতম কারণ। খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ ক্যান্সারের মতো গুরুতর ও ব্যয়বহুল অনেক অসুখ কমিয়ে দেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য সূচকের উন্নতি, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মিলেই যে কোন দেশের উন্নয়নের সূচকের মান বাড়াতে সহায়তা করে। এটাও নিশ্চিত মৌলিক অধিকারের বাকি ৪টি অর্থাৎ খাদ্য, শিক্ষা, বস্ত্র ও বাসস্থানেরও একটা ভূমিকা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবিএম ফারুক সাহেবের ’৮০ দশকের একটি গবেষণা কাজের ঞরঃষব ছিল ঐবধষঃয রং ধ ষবাবৎ ভড়ৎ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ । ৩৫ বছর পরে এ ব্যাপারটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কখনও কখনও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা নিয়েই সবচেয়ে কম আলোচনা হয়ে থাকে। যেমন, মানুষের জীবনকুশলতা ও জীবনমানের পক্ষে স্বাস্থ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। অথচ ভারতে প্রকাশ্য বিতর্ক এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে স্বাস্থ্য বিষয়টাই কার্যত অনুপস্থিত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গঠনমূলক প্রবন্ধ যেমন উপস্থাপন করে, তেমনি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রায় প্রত্যেকটিই স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান নিয়মিত করে, যার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের লোকজন স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন। এক বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে টিকাকরণের অনুপাত দেখালে বোঝা যাবে সরকার ও গণমাধ্যম কত বেশি তৎপর ছিলÑ এবং বাংলাদেশের এ বিরাট সাফল্য সরকারের প্রত্যাশা ও নজরদারির ফসল। নিচের ছকে টিকাকরণের হার দেখলেই বোঝা যাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি কত ঈর্ষণীয়।
×