ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

শেখ মুজিব ॥ ইতিহাসের রাখাল রাজা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৫ আগস্ট ২০১৫

শেখ মুজিব ॥ ইতিহাসের রাখাল রাজা

আগস্ট মাস বাঙালীর ইতিহাসের শোকের মাস। এ মাসে আমরা হারিয়েছি তিনজন মহান বাঙালীকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু এবং নজরুল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পৃথিবীর প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নোবেল বিজয়ী। এই মহান মনীষীর মহাপ্রয়াণের ঠিক ত্রিশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় এমন আর এক বাঙালীর নেতৃত্বে কালের বিবর্তনে তাঁকে মনে করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো কালজয়ী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে ডিঙ্গিয়ে, ঠিক যেমনটা ইংরেজরা উইনস্টন চার্চিলের গলায় শ্রেষ্ঠ ইংরেজের বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছেন শেক্সপিয়রের মতো আর এক কালজয়ী মানুষকে ডিঙ্গিয়ে। ১৯৯৫ সালে কানাডার দু’জন সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ কানাডা থেকে ক্যুবেক প্রদেশের সম্ভাব্য বিচ্ছেদের আইনগত দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখছিলেন, ‘১৯৪৫ সালের পর বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে সফলভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার কৃতিত্ব অর্জন করে। এ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রধান শক্তি ছিল ঐ জাতির সহজাত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এক অতুলনীয় বিজয় ছিনিয়ে আনে। তিনি যে আস্বাদিত জনসমর্থন পেয়েছিলেন সেটা একটি পশ্চিমা গণতন্ত্রে অভাবনীয়।’ অনুরূপ মতামত যেমনÑ ‘শেখ মুজিবের একমাত্র অপরাধ একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন’Ñ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে, ক্যাপিটল হিলে যেটা নিরন্তর প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার লেখক পেগী ডারদিন যিনি ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তিনি ২ মে ১৯৭১ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তানে তাড়িত রাজনৈতিক জোয়ার’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। যেটাতে তিনি লেখেন, ‘সমস্ত মার্চে শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মীরা আঁকাবাঁকা গেম খেলেন এবং তাঁদের লক্ষ্য ও কৌশল স্পষ্ট করতে অস্বীকার করেন। অবশ্য তাঁদের এটা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। স্বাধীনতার জন্য একটি খোলাস্ট্যান্ড হতো সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা যেত। ... শেখ মুজিব পূর্ব ও পশ্চিমের এক জাতীয় নেতা হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি, যদিও একটি সর্বপাকিস্তান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ পাওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাতীয় পরিষদে তাঁর ছিল।’ জেনারেল রাও ফরমান আলী অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা। ‘সবশেষে তারা (বাঙালীরা) পাকিস্তান শাসন করার সম্ভাবনা দেখেছিল। মুজিব (পাকিস্তানের) প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর তাঁর উপদেষ্টারা তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সামরিক এবং পিপিপির সম্মিলিত বাহিনীর শক্তি তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা সত্যে পরিণত হতে দেবে না। অতএব তিনি একটি নতুন জাতির ‘জনক’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’ জেমস জে নোভাক (১৯৭০ সাল থেকে যিনি ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করেছিলেন) তার সুন্দর বই : ‘ইধহমষধফবংয : জবভষবপঃরড়হং ড়হ ঃযব ধিঃবৎ’ নামের বইতে রাজনীতিবিদ এবং আমাদের স্বাধীনতার নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের এক উজ্জ্বল চিত্রাঙ্কন এবং তাঁকে উপস্থাপন করেছেন। নোভাকের ভাষায়, ‘শেখ মুজিব রাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের তাৎক্ষণিতা নিয়ে আসেন। সূক্ষ্ম কূটচাল অথবা খাপছাড়া পদক্ষেপ নিয়ে তিনি জনগণকে ক্লান্ত করতেন না। সরকারী পদের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। যদিও কখনও প্রকাশ্যে বলেননি বা লেখেননি তথাপি তাঁর উত্থানের সময় থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর দিনে তাঁকে গ্রেফতার করা পর্যন্ত সবাই জানত এবং বুঝত তিনি স্বাধীনতার পক্ষেই কথা বলছেন। তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে কোন ঘোষণা না দিয়ে তিনি পাকিস্তানীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছেন। এবং পুরোটা সময় মুজিব চোখ পিটপিটিয়েছেন এবং মিটমিটিয়ে হেসেছেন এবং বাংলা ও বাংলাদেশের কথা বলে গেছেন, যেন চাইলেই ছাদের ওপর লাল সবুজের পতাকার পতপত করে উড়ার দৃশ্য উপভোগ করা যেত।’ যাই হোক, তাঁর ছয় দফা থেকে এক দফায় রূপান্তর একটি দিন বা একটি মাসে ঘটেনি। নোভাকের কথায়Ñ ‘মুক্তিযুদ্ধের বহু আগেই, মুজিব পূর্ববাংলাবাসীদের মনে সাফল্যের সঙ্গে এই বোধ সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন যে, তারা পাকিস্তানী আগ্রাসন ও অবিচারের শিকার। এর ফলে আন্দোলনরত বাঙালীরা সবসময় এক ধরনের নৈতিক স্বস্তিতে থেকেছে যে, তারা নির্দোষ এবং যা করছে তা ন্যায্য। তাঁর বিশ্বাস যাই হোক না কেন, তাঁর ব্যক্তিত্বই তাঁকে তাঁর যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত করেছিল। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন ধূমকেতুর মতো। বস্তুত তিনি ছিলেন এক সজ্ঞাত শক্তি, যার ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ মানসের গভীরতম প্রদেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ছিলেন এক নৌকা, যাতে চেপে জনগণের আকাক্সক্ষা বয়ে যেতে পারত।’ বহুদিন আগে সক্রেটিস যেমনটা বুঝেছিলেন তেমনি রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবও বুঝেছিলেন যুক্তি এবং আবেগের সংমিশ্রণের। নোভাকের কথায়Ñ ‘মুজিব সামরিক এবং মার্শাল পাকিস্তানী পাঞ্জাবীদের তুলনায় বাংলা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের বোধকে সবসময় উস্কে দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি বাঙালী কবিদের কবিতা দিয়ে পাকিস্তানের মহান কবি ইকবালের কবিতাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন। জনগণকে উদ্দীপ্ত করার জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন কাজী নজরুলের উদ্দীপনাময় গান এবং কবিতা। অকৃত্রিম বাঙালী মনের সূক্ষ্ম এবং শৈল্পিক গুণাবলী এবং সেই মনের নৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কবিতার ভূমিকা কি তা মুজিব বুঝেছিলেন। এটা বিশ্বাস করা হয়, ‘বাংলাদেশ কখনই কিছু বিশ্বাস করে না যতক্ষণ না একজন কবির দ্বারা তা উচ্চারিত হয়।’ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ইকবালের সমকক্ষ বাঙালী কবি। তার চেয়ে বড় যেটা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলার সন্তান। ফলে ইকবালের চাইতে অনেক বেশি প্রিয়। মুজিবের এই কবিতা কৌশল এত ফলপ্রসূ হয়েছিল যে, এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথের গান ও সাহিত্য গাওয়া এবং পাঠ করাকে দেশদ্রোহিতা আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটাই মুজিব চেয়েছিলেন। অন্যদিকে উদ্দীপনাময় গান ও কবিতার কারণে বিদ্রোহের পূর্বক্ষণে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনীর কাব্যিক কণ্ঠস্বর।’ তাঁর কঠোর পরিশ্রম, সরলতা এবং সত্যবাদিতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে নোভাক লিখেছেন, ‘পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত মুসলিম লীগাররা ঢাকা অথবা চট্টগ্রামের চেয়ে লন্ডনে থাকতে এবং দেশী নৌকার তুলনায় এ্যারোপ্লেনে ভ্রমণ করতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। একইভাবে তারা ভোট প্রার্থনা বা ভোট অর্জনের চাইতে ভোট কিনতেন। অন্যদিকে শেখের রীতি ছিল কঠোর পরিশ্রম। অক্লান্তভাবে তিনি জেলায় জেলায়, মহকুমায় মহকুমায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মাঠের পর মাঠ হেঁটে মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, মানুষদের সংগঠিত করেছেন। তাদের চা, ভাত, ডাল, লবণ ভাগ করে খেয়েছেন; নাম মনে রেখেছেন, তাদের সঙ্গে মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন, ফসলের মাঠে প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত হয়েছেন, কেউ মারা গেলে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কেঁদেছেন এবং কুলখানিতে উপস্থিত থেকেছেন। শেখ মুজিব অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হতেন আন্তরিকতার সঙ্গে, আচরণ করতেন সহানুভূতির সঙ্গে এবং হাত বাড়িয়ে যা স্পর্শ করতেন তা গোলফ ক্লাব বা ক্লাবের চেয়ার নয়, জনগণের ঘর্মাক্ত ধূলিমলিন হাত। জনগণ কি বিশ্বাস করে, কি চায় তা তিনি জানতেন এবং তাদের বোধগম্য ভাষায় সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারতেন। জনগণও এটা জানত বলে তারা বিশ্বাস করত তাঁর মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই।’ গণহত্যা, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং অনুচ্চারিত দুঃখভোগের নয় মাসে শেখ মুজিবের নাম লাখ লাখ মানুষের অন্তরে রাতদিন প্রজ্বলিত হয়েছিল এবং তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের জনগণের এক উপদেবতা। জেনারেল রাও ফরমান আলীর ভাষায়Ñ ‘বাংলাদেশের জনগণের ৯০% শেখ মুজিবের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা দ্বারা বিমোহিত হয়েছিল এবং তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য তাদের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল।’ বিবিসির বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের পৃথিবীব্যাপী জরিপে তিনি যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে বিবেচিত হন তখন বিবিসি শ্রোতাদের মতামতের সংক্ষিপ্ত সার ছিল নিম্নরূপ : ‘তিনি ছিলেন বাঙালী জনগণের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের আলোর বাতিঘর। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাঙালীদের স্বার্থের জন্য আপোসহীনতা শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে নয়, সারাবিশ্বের বাঙালীদের প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ করে এবং তিনিই তাদের জাতীয়তা দিয়েছেন। সারা পৃথিবীর বাঙালী, যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লালন করেন, তারা এক ব্যক্তির নেতৃত্বের কাছে এই জাতীয়তার জন্য ঋণী এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ নন।’ এ্যারিস্টটল লিখেছেন, বিয়োগান্তের নায়ক হওয়ার কারণ তার ‘ত্রুটিময় বিবেচনা’ বা তার নেতৃত্বের ‘দুঃখজনক ত্রুটির’ কারণে। তার দৈবদুর্বিপাক, যতটুকু তার ভাগ্যে প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক বেশি। মুজিব প্রকৃতপক্ষে এক বিয়োগান্তক নায়ক। তুরস্কের জাতীয় বীর কামাল আতাতুর্ক একটি তুর্কি প্রবচন প্রায়শই উদ্ধৃত করতে অনুরাগী ছিলেন : ‘ইতিহাসে নির্মমতা ছাড়া যিনি তাকেই নির্মমতার শিকার হতে হয়’। বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব এসএ করিম তার ‘ঝযবরশয গঁলরন : ঞৎরঁসঢ়য ধহফ ঞৎধমবফু’ গ্রন্থের এপিটাফে উপসংহার টেনেছেন এভাবে, ‘মুজিব তাঁর নিজের আগে তাঁর দেশের মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন তবে তার কারণ তিনি একটি রাষ্ট্রের এক কঠিন সময়ে নির্মমতার সঙ্গে শাসন করতে পারেননি। কিন্তু শাসক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা তাঁর মানবিক সত্তার জাঁকজমককে কোনদিনও হ্রাস করবে না। তিনি তাঁর দেশের মানুষের অন্তরে অনাদিকাল ধরে বেঁচে থাকবেন।’ নোভাকের বই থেকে একটি উদ্ধৃতাংশ দিয়ে এ নিবন্ধের ইতি টানছি। নোভাকের কথায়, ‘তিনি ছিলেন সহজ-সরল একজন মানুষ, নিজের জাতির ও জনগণের জন্য যাঁর ছিল কিছু সহজ-সরল বিশ্বাস। কিন্তু তিনি তাদের জন্য যা করতে চেয়েছিলেন তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের মানুষ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, তারা তাঁর ভেতর থেকে সবসময় ভালটাই বের করে এনেছেন। তবুও তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা- না একজন নিখুঁত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নয়, তাঁর জনগণের জন্য তাঁর নিখাদ ভালবাসার জন্য। একজন মানুষ যতদূরে উঠতে পারে তিনি ততদূরই উঠেছিলেন। আমাদের ক’জন এর চেয়ে ভাল করতে পারত?’ লেখক : কানাডাপ্রবাসী অধ্যাপক
×