ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পশুর হাটের ইজারা নিয়ে ভাটারায় ৩ খুন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৫ আগস্ট ২০১৫

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পশুর হাটের ইজারা নিয়ে ভাটারায় ৩ খুন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কোরবানির পশুর হাটের ইজারা, গার্মেন্টস দখল, ঝুট ব্যবসা ও এলাকার আধিপত্য বিস্তারের সূত্রধরে রাজধানীর ভাটারায় সরকার দলীয় তিন নেতাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হতে পারে। হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেয় ৩ জন। হত্যার মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা উত্তরের সহকারী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গামা। গামাকে হত্যার উদ্দেশে চালানো এলোপাতাড়ি গুলিতে অপর দুইজনের মৃত্যু হয়। আরেকজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। দৌড়ে পালানোর সময় জনতা ধাওয়া করলে রাস্তায় থাকা হত্যাকারীদের এক সহযোগী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর ধর ধর বলে জনতার ভিড়ে মিশে যায়। হত্যাকারীদের সবাই থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত ছিল। তাদের মধ্যে একজনের গায়ে হলুদ গেঞ্জি ছিল। পুলিশ ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। হত্যাকারীরা ভাড়াটে খুনী বলে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাত আটটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, হত্যাকা-ের সময় ঘটনাস্থলে ৪ থেকে ৫ জন হত্যাকারী ছিল বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে হত্যাকা-ের প্রকৃত কারণ সর্ম্পকে এখনও তেমন কিছুই জানা যায়নি। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। সোমবার রাত পৌনে ১০টার দিকে রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন মধ্যবাড্ডার আদর্শনগরের আল সামি হাসপাতাল সংলগ্ন ঢাকা ওয়াসার ৮ নম্বর মটস জোনের ভেতরে ঘটনাটি ঘটে। পাম্পের চারদিকে প্রায় ৭ ফুট উঁচু প্রাচীর রয়েছে। ভেতরে নতুন একতলা পানির পাম্পের ভবন করা হয়েছে। ভবনে দুইটি কক্ষ। একটি কক্ষে পাম্পের অপারেটর থাকেন। অপরটিতে জেনারেটর রয়েছে। ভেতরে পাম্পের মোটা পাইপগুলো বাইরে। পাম্পের ভেতরে অধিকাংশ জায়গা ফাঁকা। সামনে কোন গেট নেই। যে কেউ অনায়াসে সেখানে যাতায়াত করতে পারে। পাম্পের সামনে একটি ছোট হোটেল রয়েছে। আর পাম্পের দেয়াল ঘেঁষা চারতলা আল সামি হাসপাতাল। স্থানীয়রা বলছিলেন, বহুদিন ধরেই হতাহতরা ওয়াসার পাম্পের ভেতরে বসে আড্ডা দিয়ে আসছিলেন। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবারও সেখানে আড্ডা বসে। প্রতিদিন রাত প্রায় ১১টা ১২টা পর্যন্ত আড্ডা চলে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান করার বিষয়াদি নিয়ে সেখানে স্থানীয়রা বসে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। সেখানে ছিলেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা উত্তরের সহকারী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গামা (৪৫), তার বন্ধু যুবলীগ কর্মী ও উত্তর বাড্ডার এইচএএফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ফিরোজ আহমেদ মানিক (৪৫), ঢাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক শামসুদ্দিন মোল্লা ওরফে শামছু মোল্লা (৫৩) ও সরকার দলীয় সমর্থক আব্দুস সালাম (৪৩)। সেখানে অনেক নেতাকর্মীও ছিলেন। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নেতাকর্মীই চলে যান। রাত তখন পৌনে ১০টা। আচমকা বিদ্যুত চলে যায়। ঘটনাস্থলটি প্রগতি স্মরণীর মূল রাস্তা থেকে মাত্র ১০Ñ১৫ গজ ভেতরে। এ সময় তিন যুবক দ্রুত পাম্পের সামনের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ওই সময় হতাহতরা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান সফল করার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। থ্রি কোর্য়াটার প্যান্ট পরিহিত তিন যুবক ঢুকেই এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় শামছুদ্দিন মোল্লা ও মানিক। আহত অপর দুই জনকে দ্রুত প্রথমে পাশের আল সামি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে মাহবুবুর রহমান গামাকে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার সকালে হাসপাতালেই গামার মৃত্যু হয়। পরে গামার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায় পুলিশ। গামার মামাতো ভাই আমিনুর রহমান রিপনের দাবি, মেরুল বাড্ডায় কোরবানির পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন গামা। ইজারা সংক্রান্ত বিরোধের জেরধরেই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে। আহত স্থানীয় যুবলীগ নেতা আব্দুস সালাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার জবানবন্দী গ্রহণ করার চেষ্টা করছে পুলিশ। নিহত মাহবুবুর রহমান গামা রতœা ভিলা নামের মধ্যবাড্ডার পাঁচতলা নিজ বাড়িতেই পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। চার ভাইবোনের মধ্যে গামা ছিলেন সবার বড়। তার স্ত্রীর নাম লিনডা। ছয় বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে এই দম্পতির। পৈত্রিক বাড়ি ফরিদপুরে হলেও ছোটবেলা থেকেই তারা মধ্যবাড্ডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। নিহতের বাড়িতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। নিহত মানিক গামার বন্ধু ছিলেন। আল সামি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ জাহেদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, মানিক আল সামি হাসপাতালের ম্যানেজার হিসেবে ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন। এরপর তিনি উত্তর বাড্ডার এইচএএফ হাসপাতালে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মানিকের বাড়ি কুমিল্লা জেলা সদরের ব্রাহ্মণপাড়ায়। তার লাশ সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মানিক বিয়ে করেছেন মধ্যবাড্ডায়। মধ্যবাড্ডার আদর্শনগরের শ-২৬/১ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই গামার সঙ্গে মানিকের সুসর্ম্পক। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার রাতে মানিক পাম্পে বসে গামার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। নিহত শামসু মোল্লা বাড্ডা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়া মূল সড়কের ২৭/১ নম্বর একতলা টিনশেড নিজ বাড়িতে বসবাস করছিলেন। নিহতের স্ত্রী ছাড়াও এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মেয়ে বিবাহিত। একমাত্র ছেলে ইয়াসিন মোল্লা ব্যবসায়ী। দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে শামছু মোল্লার মরদেহ অর্ক ডেভেলপার কোম্পানির নির্মাণাধীন একটি বহুতল বাড়ির নিচে রাখা হয়। সেখানে শত শত মানুষ ভিড় করে। শুক্রবার বিকেল পাঁচ পর্যন্ত গামার লাশ বাড়িতে আনা হয়নি। স্থানীয়রা আরও জানান, তিন যুবক গুলি করে দৌড়ে মূল সড়কের দিকে যেতে থাকে। ঘটনাস্থল থেকে মূল সড়ক মাত্র ১০ থেকে ১৫ গজ দূরে। গুলির শব্দ পেয়ে স্থানীয়রা সেখানে দ্রুত ছুটে যায়। দৌড়ে পালানোর সময় তিন খুনীর পিছু নেয় জনতা। এ সময় রাস্তায় থাকা হত্যাকারীদের এক সহযোগী জনতা লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। ভয়ে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় হত্যাকারী চক্রের ৪ সদস্য ধর ধর বলে মুহূর্তেই জনতার ভিড়ে মিশে যায়। ওয়াসার পানির পাম্পের অপারেটর মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি একবছর ৩ মাস যাবত পাম্পের অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ঘটনার সময় পাম্পে ছিলেন না। পাশেই থাকা দোকানে ছিলেন। গুলির শব্দ শুনে তিনিও অন্য মানুষের মতো পাম্পে প্রবেশ করেন। দেখেন সেখানে একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। উল্টানোর পর দেখা যায় তার বুক থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। অপরজনও পাশে কাঁত হয়ে পড়ে আছে। ঘটনাস্থলেই দুই জন মারা যান। কারা কি উদ্দেশে হত্যাকা- ঘটিয়েছে এবং ঘটনার সময় হতাহতরা ছাড়াও আরও কে কে ছিলেন তা তিনি জানেন না। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির পশুরহাটের ইজারা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, একটি গার্মেন্টস দখল, আশপাশে থাকা বেশ কয়েকটি গার্মেন্টেসের ঝুট ব্যবসা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের সূত্র ধরেই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ হত্যাকা-ের পেছনে অভ্যন্তরীণ কোন কোন্দল নেই বলে দাবি করেছেন। জাতীয় শোক দিবসের এক দিন আগে বিশেষ কোন উদ্দেশেও হতে পারে।
×