ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জনকণ্ঠের আইনী লড়াই সাংবাদিকতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৫ আগস্ট ২০১৫

জনকণ্ঠের আইনী লড়াই সাংবাদিকতার  অধিকার প্রতিষ্ঠায়  মাইলফলক

বিকাশ দত্ত ॥ দৈনিক জনকণ্ঠের আদালত অবমাননা মামলায় ক্ষমা না চেয়ে মামলা মোকাবেলা করাটা সংবাদপত্রের জন্য ইতিবাচক দিক। সত্য লিখেও এর আগে সবাই ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু জনকণ্ঠ আইনী লড়াই করার মাধ্যমে সাংবাদিকতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এদিক থেকে জনকণ্ঠের আইনী লড়াইটা সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য একটি মাইলফলক। এমনটিই মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, জনকণ্ঠের মামলা মোকাবেলা করাটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। আদালত নিয়ে কথা বলার লিমিটটা কতখানি তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিস্তারিত পাওয়া যাবে। আদালত একটা গাইডলাইন দেবে। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সেখানে সাংবাদিকদের জন্য কী ধরনের গাইডলাইন থাকে সেটা দেখার পর সাংবাদিক সমাজ বসবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের পাশে গণমাধ্যমই চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। গণমাধ্যমের ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রের অগ্রগতি কল্পনাই করা যায় না। সাংবাদিকদের কতগুলো জায়গা আছে তেমনি বিচার বিভাগেরও কতগুলো দিক আছে। জনকণ্ঠের পক্ষের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন বলেছেন, আমরা আদালতকে বলেছিলাম, সত্য লেখায় আদালত অবমাননা হয়নি। তারপরও যেহেতু আদালত রায় দিয়েছেন, সেহেতু রায় মানতেই হবে। আমরা এ রায় মেনে নিয়েছি। এদিকে, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, বিচার, আইন ও নির্বাহী বিভাগ হলো রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ঠিক তেমনি গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এগুলোর সকলকেই কিন্তু দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকতে হবে। সকলকেই কোড অব কন্ডাক্টের মধ্যে চলতে হবে। কেননা কেউ জবাবদিহিতার উর্ধে নয়। সুপ্রীমকোর্টে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কনটেম্পট কেস এটাই নতুন নয়। কিন্তু এই প্রথম কেস, যা কনটেস্ট হয়েছে। এর আগে কনটেম্পট হলেই অভিযুক্তরা কোর্টে উঠে দু’হাত তুলে বলতেনÑ হুজুর ভুল হয়েছে, মাফ করে দেন। সুপ্রীমকোর্টের ইতিহাসে এই প্রথম মানহানি মোকদ্দমা মামলা কনটেস্ট হলো। এটা একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সাকার পরিবারের তৎপরতা/ পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয় লেখেন নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়। ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর আপীলেও মৃত্যুদ- বহাল রাখার রায়ের পর পরই জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে তলব করে আদেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ৩ আগস্ট জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (এম এ খান মাসুদ) এবং নিবন্ধের লেখক নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় আদালতে উপস্থিত হন এবং তিন মাসের সময়ের আবেদন করেন। পরে আদালত এক সপ্তাহের সময় দেন। পরবর্তীতে গত রবি ও সোমবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে ১৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার আদেশ প্রদান করেন। আদেশে আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন এজলাসে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে বসে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। তাঁরা তা পালন করেন। একই সঙ্গে আদালত তাঁদের দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন, যে জরিমানার টাকা যে কোন দাতব্য সংস্থাকে দান করতে বলা হয়েছে। আদেশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে এই জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে হবে। জরিমানা অনাদায়ে জনকণ্ঠের সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে সাত দিন কারাভোগ করতে হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপীল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেনÑ বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী এবং বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার রায়ের এক প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, প্রথমত আমি মনে করি যে, এখানে সাংবাদিকদের বিজয় হয়েছে এ কথাও বলব না এবং আদালতের যে অধিকার প্রয়োগ করেছেন সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। এখানে আমি শুনানিতে গিয়েছিলাম একাডেমিক ইন্টারেস্টে। আমি দেখতে গিয়েছিলাম যে, অবমাননার নিরিখটা কী হবে। এখানে আমার কাছে মনে হয়েছে দু’পক্ষই আবেগ আক্রান্ত ছিলেন। এমন কী সরকারপক্ষও। এখানে প্রশ্নটা ছিল যে, আমি মনে করি আদালতের ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা এবং আমার ধারণার সঙ্গে আদালতের ধারণা মিলবে বা আদালত যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে চিন্তা করতে হবে এটি যথার্থ নয়। প্রশ্নটা উঠেছে যে, যে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে তাতে বিচারকদের সম্পর্কে একটি প্রচ্ছন্ন অভিযোগ ছিল। বেঞ্চ ক্ষুব্ধ হয়েছিল তাতে এবং এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, যদি সঠিক তথ্য থাকে এবং এটার ভিত্তিতে লেখা হয়, তা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য কিনা? জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় ওই ভিত্তিতে লিখেছিলেন। আদালত সেটি গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ আমরা যতটুকু বুঝেছি আত্মপক্ষ সমর্থনার্থে সত্য সব সময় গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে প্রশ্ন আসে কী গ্রহণযোগ্য। বিকল্প সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত। আবার ফৌজদারি আইনে সত্য তথ্য হিসেবে বিবেচনা হবে কিনা সেটি বিবেচ্য বিষয়। তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় প্রশ্ন বেঞ্চ নিয়ে। প্রধান বিচারপতি যে কথা বলেছিলেন সাংবিধানিক দিক দিয়ে ঠিকই আছে। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে দেখি, বিভিন্ন কমিটিতে ব্যক্তির বিষয় উঠে তিনি সেই কমিটির সদস্য হলেও সেখানে থাকেন না। যদিও তার অধিকার আছে সেখানে থাকার। কিন্ত তখন বিবেচনা করা হয় নৈতিকতার মানদ-ে। কেননা এই যে উদাহরণ ভবিষ্যতেও অপব্যবহার হতে পারে। এই ধরনের অনেকগুলো একাডেমিক প্রশ্ন করা যায়। আমি একটি খবরের কাগজে দেখলাম বিচারক-আদালত সম্পর্কে কোন কটূক্তি করা যাবে না। কিন্তু কোন বিচারপতি যদি এমন কোন কর্মকা- করেন যা বিতর্কিত, তাহলে সে বিষয়ে লেখা যাবে কি-না। নাকি তা কটূক্তি বলে বিবেচিত হবে। নির্বাহী আইন ও বিচার একই সমান্তরালে চলবে। কেউ কারও উপরে নয়। কিন্তু কোন একটি বিভাগ যদি মনে করে তার স্থান সর্বোচ্চ তাহলে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় কি-না। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, সাধারণ মানুষ সবার উপরে। তাদের ইচ্ছার প্রতিফলই সংসদ অথবা আইন, নির্বাহী এবং বিচার। সুতরাং তাদের অধিকারের কথা সবার আগে চিন্তা করা বাঞ্ছনীয়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, এক্ষেত্রে বর্তমান বিচারিক ক্ষেত্রের এই প্রশ্নগুলো উঠেছে এবং আইনবিদ, বিশ্লেষক ও একাডেমিশিয়ানদের এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। কারণ তর্ক-বিতর্কেই জ্ঞানকে এগিয়ে নেয়। মানুষ আইন সৃষ্টি করে। সুতরাং আইনের অবস্থান এবং প্রয়োগ এমন হতে পারে না, যা সর্বসাধারণকে প্রটেক্ট করবে না। আরেকটি প্রশ্ন উঠবে বিচারপতিরা যখন তাদের অধিকার প্রয়োগ করেন এবং বিতর্কিত হলে আদালত অবমাননা হবে কি-না সেটিও কিন্তু আমাদের আলোচনার মধ্যে আনতে হবে। তবে সব ভাল হয় সংসদকে এ বিষয়ে অধিকতর ভাবনা-চিন্তা করে এ বিষয়ে নতুন আইন তৈরি করা। মনে রাখা উচিত, আদালতের এসব আইন ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি, যার মূল লক্ষ্যই ছিল অধিকার নিশ্চিত করা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যত বেশি বলি না কেন আদালত তো একটা শাস্তি দিয়েছে। জনকণ্ঠ একটি স্ট্যান্ড নিয়েছে। তারা কোন ক্ষমা চেয়ে আসেনি। সাংবাদিকদের কতগুলো বিষয় আছে। তাদের এ বিষয়ে স্ট্যান্ড নিতে হয়। আবার আদালতেরও কিছু দিক আছে। আমার মতে, উভয়পক্ষই এ্যাভোয়েট করলে ভাল হতো। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল জনকণ্ঠকে বলেছেন, জনকণ্ঠ আদালত অবমাননায় কোন ক্ষমা চায়নি। তারা আইনী লড়াই করেছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। আমরা অপেক্ষা করছি পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য। সেখানে বেশকিছু গাইডলাইন থাকবে। আমি পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই জায়গাটা দেখতে চাই যে, জনকণ্ঠের অবস্থান এবং উচ্চ আদালতের রায়ের সমন্বয়। প্রধান বিচারপতি একজন বিবাদী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছেন, সেই কথোপকথন স্বীকার করেছেন। এটা দেখার বিষয়। আদালত শুনানিতে অনেকগুলো বিষয় বলেছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে সবকিছু জানা যাবে। বিস্তারিত রায় পাওয়ার পর বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যমের কিভাবে সহযোগিতার সম্পর্ক রাখা যায় সেটা দেখব। তখন সাংবাদিক সমাজ বসে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগের পাশে গণমাধ্যমই চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। গণমাধ্যমের ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রের অগ্রগতি কল্পনাই করা যায় না। বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক বিষয়টি আইনজীবীদের বটেই, আমাদের সবাইকে বেশ বিব্রত করেছে। বিচার বিভাগের মর্যাদা এবং স্বাধীনতা যেমন জরুরী ঠিক তেমনি গণমাধ্যমের যে দায়িত্ব তা যথাযথভাবে পালন করা গণতন্ত্রের জন্য জরুরী। আমরা কোন একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটিকে নিয়ে উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারব না। আমি আশা রাখি, খুব শীঘ্রই গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে মেঘ পুঞ্জীভূত হয়েছে তা দূর হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি জনকণ্ঠ গণমাধ্যমের জায়গা থেকে যে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে সেটি বিচার বিভাগের জন্য বিব্রতকর হলেও এই মামলায় অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সত্যের জন্য লড়াইয়ে এটি একটি মাইনফলক হয়ে থাকবে।
×