ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে দারিদ্র্য জয় করে ওরা সাফল্য পেল

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৪ আগস্ট ২০১৫

অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে দারিদ্র্য জয় করে  ওরা সাফল্য পেল

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ইচ্ছাশক্তির কাছে সবকিছুই হার মানে। মনের বলে এগিয়ে যেতে পারলে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিজয় আনা যায়। সেখানে দারিদ্র্য ও বয়স কোন বাধা হতে পারে না। সবকিছুকে পেছনে ফেলে স্বপ্ন জয়ে এগিয়ে যাওয়াতেই সফলতা আসে। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় এমনই সফলতা পেয়েছে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে একজন বয়সকেও হার মানিয়েছেন নিজের স্বপ্নের কাছে। নিজের ছেলের সঙ্গে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাস করেছেন মা ছেলে দুজনেই। কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেও পরবর্তী জীবনের পড়ালেখা নিয়ে চিন্তায় এসব শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই শিক্ষার্থীদের। এসব শিক্ষার্থী যদি সাহায্য সহযোগিতা পায় তাহলে তারা তাদের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যেতে পারবে। এইচএসসিতে ভাল ফল করেও উচ্চশিক্ষা নিয়ে শঙ্কায় এমনই কয়েক শিক্ষার্থীদের স্বপ্নপূরণের কথা জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। এই প্রতিবেদন লিখতে সহযোগিতা করেছেন ভালুকা ময়মনসিংহের মোঃ কামরুল এহসান চন্দন, নওগাঁয়ের বিশ্বজিৎ মনি, পাথরঘাটার খোকন কর্মকার ও লালমনিরহাটের জাহাঙ্গীর আলম শাহীন। অভাব-অনটনের মধ্যে পড়ালেখা করে জিপিএ-৫ পেয়েছে শিল্পী ॥ বাবা-মা মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরির কারিগর। অভাব অনটনের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এমন দম্পতির একমাত্র সন্তান শিল্পী রানী পাল। অভাবকে জয় করে সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলে মানবিক বিভাগ থেকে সে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। শিল্পী নওগাঁর মান্দা থানা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। একই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষাতেও সে ভাল ফল করেছে। কিন্তু ভাল ফলাফল করেও উচ্চশিক্ষা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে শিল্পী রানী পাল। ইতোমধ্যে তার বাবা-মা লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। মেয়েকে বিয়ে দেয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। শিল্পীর ইচ্ছে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সমাজের সেবা করা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভাব। শিল্পী নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নের খুদিয়াডাঙ্গা (পালপাড়া) গ্রামের নিরেন্দ্রনাথ পালের একমাত্র কন্যা। শিল্পীর মা জয়ন্তী রানী পাল এ প্রতিবেদককে জানান, মাটির হাঁড়ি-পাতিলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করে এক সময় ভাল উপার্জন হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেই অবস্থা এখন আর নেই। বর্তমানে সিলভার, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের তৈরি জিনিসপত্রের কদর অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা তেমন নেই বলেই চলে। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া এসব সামগ্রী এখন আর কেউ কিনতে চান না। তিনি আরও জানান, আগে নদী থেকে মাটি বিনা খরচায় পাওয়া যেত। এখন টাকা দিয়ে মাটি কিনতে হয়। সেই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। একদিকে চাহিদা কম, অন্যদিকে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ পেশার আয় দিয়ে বর্তমানে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। তাই ইচ্ছে থাকলেও এ অবস্থায় মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থী শিল্পী রানী পাল জানায়, অভাব-অনটনের মধ্যেও এতদূর এগিয়েছি। শিক্ষা জীবনে কোনদিন গৃহশিক্ষক পাইনি। বাবা-মার পেশায় প্রতিদিন সহযোগিতা করতে হয়েছে। এরপর রাত জেগে লেখাপড়া চালিয়ে গেছি কাক্সিক্ষত ফলের জন্য। শিল্পীর শঙ্কা, শিক্ষা জীবনের এখানেই তার সমাপ্তি ঘটতে পারে। শিল্পী আরও জানায়, ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সমাজের সেবা করার ইচ্ছে রয়েছে তার। শিক্ষক হওয়ার প্রবল বাসনা নিয়ে নিজের চেষ্টায় সে এতদূর এগিয়েছে। কিন্তু বাবা-মার অসহায়ত্বের কাছে হেরে যেতে বসেছে তার উচ্চশিক্ষার বাসনা। মা-ছেলে একসঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস ॥ ভালুকা উপজেলার মেদিলা গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক গাজী মাহাবুবুল আলমের স্ত্রী লিমা আক্তার (৪০) স্বামীর সেবা ও কলেজ পড়ুয়া ছেলের খেলাপড়ার খোঁজ খবর রাখার পাশাপাশি নিজের আগ্রহ ও নিরলস প্রচেষ্টায় এইচএসসিতে ৩.৭৮ পেয়ে সফলতা পেয়েছেন। তার একমাত্র সন্তান মোঃ শাহ আলমও চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৪.২৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। জানা যায়, ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের উথুরা গ্রামের নুরুল হক ম-লের ছয় ছেলে মেয়ের মাঝে লিমা আক্তার সবার বড়। স্থানীয় উথুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে লেখাপড়া করা অবস্থাতেই ১৯৮৮ সালে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর জন্ম হয় ছেলে শাহ আলমের। স্বামী মাহবুবুল আলম একটি এনজিওতে চাকরি করার সুবাদে পার্শ্ববর্তী জেলা টাঙ্গাইলে চলে যান। ফলে ওই সময় সংসারের কাজ, শাশুড়ির যতœ নেয়া আর ছেলেকে লালন-পালনের পর অবসর সময়টুকু বই পড়েই সময় কাটাতেন লিমা আক্তার। হৃদয়ে লালিত স্বপ্নের তাগিদে এক সময় প্রতিবেশী শিক্ষার্থীদের পড়ে থাকা ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে পাঠ্য সবগুলো বই সংগ্রহ করে পড়া শেষ করেন। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে বাড়ির পাশের মেদিলা মুসাফির মঞ্জিল দাখিল মাদ্রাসার সুপার নাজমুল আলম ২০০৩ সালে লিমা আক্তারকে তার মাদ্রাসায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলে ২০০৫ সঙ্গে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ ২.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ২০১২ সালে ভর্তি হন উপজেলার বান্দিয়া গ্রামের শহীদ স্মৃতি বিএম মহিলা কলেজের কারিগরি শাখায়। নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরবর্তী ওই কলেজের নিয়মিত ছাত্রী হয়ে ওঠেন তিনি। কখনও বাড়ি থেকে গিয়ে, আবার কখনও আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান নিয়ে ক্লাস নেন ওই কলেজে এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন এবং ইংরেজি ছাড়া বাকি নয় বিষয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। এদিকে লিমা আক্তারের একমাত্র সন্তান শাহ আলমও এসএসসি পাসের পর ভর্তি হয় উপজেলার বাটাজোর ডিগ্রী কলেজের বিএম শাখায়। চলতি বছর কারিগরি বোর্ডের আওতায় ওই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় শাহ আলম। অপরদিকে লিমা আক্তারও চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন আগের বছর তার ফেল করা এক বিষয়ে। পরীক্ষা কেন্দ্র একই হওয়ায় ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষার দিন বাড়ি থেকে একই সিএনজিতে করে মা-ছেলে গেছেন ওই পরীক্ষা কেন্দ্রে। ফল ঘোষণার পর জানা গেছে ছেলে শাহ আলম জিপিএ ৪.২৫ এবং মা লিমা আক্তার জিপিএ ৩.৭৮ পেয়ে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়েছেন। লিমা আক্তার জানান, কলেজে ক্লাস করার সময় অন্য মেয়েরা তাকে নানি বলে সম্বোধন করত। আর স্যারেরা খুবই উৎসাহ দিতেন তাকে। কাজের চাপে সেলাই মেশিনের ওপর বই রেখে সেলাইয়ের কাজ ও পড়া একসঙ্গে চালিয়েছেন তিনি। এইচএসসি পাসের পর তার অনেক ভাল লাগছে। দরিদ্র মেধাবী শাওন গাজী অক্লান্ত পরিশ্রম করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ॥ অভাব ওর নিত্যসঙ্গী। দিনমজুর পিতার সন্তান শাওন গাজীর তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জোটেনি। ছিল না ভাল পোশাক। প্রয়োজনীয় বই খাতাও অন্যের কাছ থেকে ধার করে চলতে হয়েছে। এসব বাধা সত্ত্বেও দমে যায়নি ও। অক্লান্ত পরিশ্রম করে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সাফল্য জিপিত্র-৫ পেয়েছে। ফলে ওর জীর্ণ কুটিরে চাঁদের আলোর ঝলক। এমন সফলতার পরও অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ কিভাবে হবে তা নিয়ে ওর পরিবারে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। দারিদ্র্যের কষাঘাতে এই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে ভাবছে তার পরিবার। শাওন গাজী বলে, দিনের পর দিন উপোষ করার যে কী কষ্ট তা বলে বুঝানো মুশকিল। তারপরও সান্ত¡না এতদূর আসতে পেরেছি। এখন দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, অর্থাভাবে আমার উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শাওন গাজীর পিতার পৈত্রিক বসতভিটার জায়গা না থাকায় শাশুড়ির দেয়া এক খন্ড জমিতে একটি কাঠের ঘর ছাড়া আর কোন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। পিতার দিন মজুরির আয় দিয়েই ৪ ভাই ও মাকে নিয়ে সংসার চলে। একমাত্র বাবার আয়ের ওপর এত বড় সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খায় বাবা নুরুল ইসলাম গাজী। তবুও বহু কষ্টে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন বাবা নুরুল ইসলাম গাজী। তার সেই কষ্ট সার্থক করেছে পুত্র শাওন গাজী। পাথরঘাটা মহাবিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে শাওন গাজী। শাওন গাজী এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৯৪ পেয়ে ভাল ফল করেছে। শাওন গাজীর এ ফলে শিক্ষক ও প্রতিবেশীরাও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বাবা নূরুল ইসলাম গাজী ও মা শাহিদা বেগম (বুলি) আনন্দে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের ছেলেকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছি। নিজেরা না খেয়েও ওকে খাইয়েছি। তারা আরও বলেন, অনেক কষ্টের সংসার, তিন বেলার জায়গায় কোন দিন এক বেলায় রান্নার জন্য চুলোয় আগুন ধরাতে পারিনি। আমাদের ছেলে তা দেখে না খেয়েও স্কুল-কলেজে গেছে। ও আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। শাওন গাজীর ছোট মামা সফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, বোন-দুলাভাইর সংসারে অভাব অনটন থাকায় আমরা সকলেই কিছু না কিছু সহযোগিতা করেছি। যার ফলে শাওন আজ আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। রবিউল ইসলাম রুবেল জিপিএ-৫ পেয়েছে ॥ অদ্যম মেধাবী রবিউল ইসলাম রুবেলের সাফল্যে দারিদ্র্য বাধা হতে পারেনি। এবারের এইচএসসি বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার এসএস টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি বাণিজ্য বিভাগ থেকে রবিউল ইসলাম রুবেল এই সাফল্য পায়। রুবেলের তিন মাস বয়সে তার বাবা-মাকে ফেলে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। মা ও নানী অন্যের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে। বাড়ি বলতে একটি ঝুপড়ি ঘর অন্যের জমিতে। রাতে তেল কিনে বাতি জ্বালিয়ে পড়ার সামর্থ্য ছিল না। তাই অন্যের বাড়ির পেছনে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলে উঠলে, সে তখন সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করত। রুবেল এখন স্বপ্ন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু সেই স্বপ্নে পথে বড় বাধা দরিদ্রতা। সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা চায় রবিউল ও তার পরিবার।
×