ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

উত্তরে খরায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত, দক্ষিণে বন্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৪ আগস্ট ২০১৫

উত্তরে খরায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত, দক্ষিণে বন্যা

শাহীন রহমান ॥ আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। ফলে দেশের কোথাও খরা আবার কোথাও ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে এ বছর মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে স্বল্পস্থায়ী বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঠিক একই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহতও হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ বছর অধিক বৃষ্টিপাত হলেও নদীতে পানির প্রবাহ তুলনামূলক কম থাকায় সারাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকেও রক্ষা পেয়েছে দেশ। বিশেষ করে এই বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণে বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হলেও উত্তরের বেশিরভাগ জেলায় খরার প্রকোপের কারণে নদীতে পানির প্রবাহ ছিল অনেক কম। বৃষ্টিপাতের অভাবে উত্তরাঞ্চলে ফসলের উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে ১৯৯৮ সালে দেশের ভয়াবহ মৌসুমী বন্যার সৃষ্টি হয়। ওই বছরে নদীর পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশে দেশের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকা দুই মাসের অধিক সময় বন্যাকবলিত হয়। এর আগে ১৯৮৮ সালেও অনুরূপ বন্যার মুখোমুখি হয় দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে দুটি বন্যার ব্যাপ্তি ছিল এক রকম। ব্যাপক বৃষ্টিপাত, একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ ঘটার ফলে ও ব্যাক ওয়াটার এ্যাফেক্টের কারণে ওই বন্যা সৃষ্টি হয়। তাদের মতে এবার বর্ষাকালে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হলেও প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ কম থাকায় বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বন্যা একটি বারবার সংঘটিত ঘটনা। ১৭৮৭ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত সংঘটিত পুনরাবৃত্ত বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের পুরানো গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ১৯২২ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী বন্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও উত্তরবঙ্গে ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বন্যার ওপরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় ব্যাপক বন্যা প্রতি সাত বছরে একবার এবং মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা প্রতি ৩৩-৫০ বছরে একবার এই জনপদে হানা দিতে পারে। ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত বন্যার ওপর অধ্যাপক পিসি মহলানবীশ প্রণীত রিপোর্টটিতে দেখানো হয়েছে মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দু’বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ৬-৭ বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে। এবারে প্রথম থেকেই বৃষ্টিপাতের আধিক্যের কারণে বন্যার আশঙ্কা করেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলম এর আগে বলেন, সিজনাল প্যাটার্ন অনুযায়ী এবার বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী এবার দেশের ব্যাপক বৃষ্টিপাত হলেও বেশিরভাগ নদীতে পানি প্রবাহ ছিল বিপদসীমার অনেক নিচে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সময়ে সময়ে দেশের কোন কোন নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেও তা স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসে। এ কারণে বৃষ্টিপাতের আধিক্য থাকলেও তা দ্রুতই নেমে যায়। ফলে আশঙ্কা অনুযায়ী বড় বন্যার সৃষ্টি করতে পারেনি। দক্ষিণের যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যার সৃষ্টি হয় নদীতে পানি কম থাকায় তা দ্রুত নেমে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তুলনামূলক কম হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী এ বছর জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী জুন মাসে বাংলাদেশে তিন হাজার ৪৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশে জুন মাসে গড়ে ৪৫৯.৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু এর বিপরীতে জুনে বাংলাদেশের সাত বিভাগে গড়ে বৃষ্টি হয়েছে ৪৯৩.৭১ মিলিমিটার। তবে সব বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলেও রংপুর বিভাগের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ একেবারেই কম ছিল। অপর দিকে জুলাই মাসেও বৃষ্টিপাত হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি। এ মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি হলেও রংপুর বিভাগে স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাদের মতে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় বন্যার আশঙ্কা থাকলেও এবার নদীতে প্রবাহ কম থাকায় তা হয়নি। অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চল যখন পানির নিচে তলিয়ে যায়। ঠিক একই সময়ে উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটে প্রচ- দাবদাহে আমন ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যায়। যার প্রভাব এখনো রয়েছে। এমনকি পানির অভাবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আমন চাষ নিয়ে বিপাকে পড়ে জেলার কৃষক। শ্রাবণের মাঝামাঝি সময় আমন চাষের মুখ্য মৌসুম হলেও পানির অভাবে চারা নষ্ট হচ্ছে। পাট পচাতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। একদিকে বৃষ্টি না হওয়া অপরদিকে প্রচ- দাবদাহে কৃষকরাও পড়েন মহাবিপাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যা তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোন নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়। তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত হয়ে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিমি অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখ- বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সারা দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখ- বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮ লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। আর শুধুই বৃষ্টির পানিতে একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১ লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদীর প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বন্যার সংজ্ঞায় বর্ষাকালে নদী, খাল, বিল, হাওড় ও নিচু এলাকা ছাড়িয়ে সমস্ত জনপদ পানিতে ভেসে ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সহায় সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে তখন তাকে বন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাদের মতে দেশে যে বন্যা হয় তা সাধারণ তিন শ্রেণীর বৈশিষ্ট থাকে। মৌসুমী বন্যা বা ঋতুগত বন্যায়, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে। বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পাহাড়ী ঢল, স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও রয়েছে জোয়ারে সৃষ্ট বন্যা। সংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে। তাদের মতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বাৎসরিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানির আভিকর্ষিক নিষ্ক্রমণ শুধুমাত্র বন্যার উপরে জেগে থাকা ভূমিতেই সীমাবদ্ধ। নিষ্ক্রমণ প্রতিবন্ধকতার কারণে সৃষ্ট বন্যা দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের উঁচুভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া প্রায় সর্বত্রই একই প্রভাব পড়ে। কিন্তু এবারে আশঙ্কা করা হলে পানির প্রবাহ কম থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তাদের মতে দেশের বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সাধারণভাবে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান যার ওপর দিয়ে প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে। দেশের বাইরে নদনদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারি বৃষ্টিপাত এবং হিমালয় পর্বতে তুষার গলে নদীতে বেয়ে আসা এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তরে কারণে হয়ে থাকে। পলি জমার ফলে নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে এবং প্রধান প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার, জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিগত ৫০ থেকে ৬০ বছরের বন্যার রিপোর্ট দেখা গেছে ভয়াবহ বন্যার কারণে দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। ১৯৫৫ ঢাকা জেলার ৩০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়। ১৯৫৪ সালের বন্যায় বুড়িগঙ্গার পানি প্রবাহ সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যায় ১৯৬২ দুইবার বন্যার সৃষ্টি হয়। একবার জুলাই ও আরেকবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর। বহুলোক আক্রান্ত ও মূল্যবান সম্পত্তি বিনষ্ট হয় এ বন্যায়। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় দেখা দেয় প্রলয়ঙ্করী বন্যা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় প্রলয়ঙ্করী বন্যা। এ বন্যায় ময়মনসিংহে প্রায় ১০ হাজার ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়। মানুষ ও গবাদি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি ও লাখ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ১৯৮৭ জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। প্রায় ৫৭ হাজার ৩শ’ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিপ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরনের বন্যা ৩০ থেকে ৭০ বছরে একবার ঘটে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতই বন্যার প্রধান কারণ ছিল। ১৯৮৮ সালের আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রায় ৮২ হাজার বর্গ কিমি এলাকা ওই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরনের বন্যা সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ বছরে একবার ঘটে। বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ একই সময় ঘটার ফলে বন্যার আরও ব্যাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরও প্লাবিত হয়। এ বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন। এছাড়াও ২০০০ সালে ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের পাঁচটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বন্যায় বিধ্বস্ত হয় সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পানিতে। এ বন্যায় প্রায় ৩০ লাখ লোক গৃহহীন হয়। বন্যাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাটির বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ঘটে। ২০০৪ সালে এক টানা ১০ থেকে ১২ দিনের বৃষ্টিতে ব্যাপক বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়।
×