ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৪ বছর নিরুদ্দেশ জীবনের পর দুর্জয় ফিরে পেল পরিবার

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৪ আগস্ট ২০১৫

৪ বছর নিরুদ্দেশ জীবনের পর দুর্জয় ফিরে পেল পরিবার

শর্মী চক্রবর্তী ॥ মা তাকে এসে নিয়ে যাবে সে খবরটা সকালেই পেয়েছিল দুর্জয়। এ খবরটা শোনার পর এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকতে পারেনি। বার বার অনাথ আশ্রমের কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে খবর নিচ্ছিল কখন মা আসবে, আর কতক্ষণ লাগবে। মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে বসে ছিল দুর্জয় মা এলে সবকথা বলবে বলে। কিন্তু তা আর হলো না। চার বছর পরে মা ও ছেলের মিলনের মধ্যে শুধু ছিল চোখের জল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে একাধারে কেঁদে চলছিল। সেই চোখের জলেই বোধহয় অনেক না বলা কথাও বলা হয়ে গিয়েছিল একে অপরকে। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটা কথাই বলছিল দুর্জয় তোমার চেহারা এমন হয়েছে কেন মা? দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর বৃহস্পতিবার অবশেষে দুর্জয় ফিরে পেল তার পরিবারকে। চার বছর পর বুধবার সকালে আনন্দবাজার খুলেই চমকে উঠেছিল ছেলেটা। ঝাপসা ঝাপসা, কিন্তু এ তো তার নিজেরই ছবি। ছবির সঙ্গে যে খবর, তাতে লেখা রয়েছে, তার মামা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে চলে এসেছেন। চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভাগ্নে দুর্জয় ভক্তির খোঁজে ঘুরছেন দ¦ারে দ¦ারে। কিন্তু কিছুতেই কোন সন্ধান পাচ্ছেন না। সেই দুর্জয়ের ঠিকানা কামালগাজির এক অনাথ আশ্রম। চেহারায় পরিবর্তন আসায় খবরের কাগজের ছবি দেখে অবশ্য আশ্রমের কর্তারাও বুঝতে পারেননি, এটা দুর্জয়ের ছবি। আরও বুঝতে পারেননি, কারণ অনাথ আশ্রমের খাতায় তার নাম তো ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী! আশ্রমের কর্তাদের এ দিন দুর্জয় বলে, দুর্জয় ভক্তি নামে ওই ছেলেটাকে আমি চিনি। যে করেই হোক ছেলেটাকে বাড়ি ফেরাতেই হবে। তার পর স্কুল সেরে বিকেলে স্কুলের পোশাকেই শিয়ালদহে স্টেশনে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে হাজির হয় সে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিচিত কর্মীকে দেখতে পেয়ে দুর্জয় জানায়, তাকে আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে। তা হলেই সে ফিরে যেতে পারবে নিজের বাড়িতে। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যশোর থেকে যখন দুর্জয়কে খুঁজতে এসেছিলেন তার মামা সুব্রত ম-ল তখন আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর। মঙ্গলবার দেশে ফেরার আগে তিনি তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন। বুধবার ওই নম্বরে ফোন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে বসেই যশোরে মামার সঙ্গে কথা হয় দুর্জয়ের। দীর্ঘ চার বছর পর প্রথম বাড়ির কারও সঙ্গে কথা হয় তার। প্রথম কথাই ছিল ‘মামা কবে আসবে আমায় নিতে বলতে বলতেই গলা ধরে আসে দুর্জয়ের। ফোন রেখে কাঁদতে থাকে পনেরো বছরের সেই কিশোর। বুধবার বিকেলে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদকের কাছে দুর্জয় নিজেই তার গল্প বলে কে দুর্জয়? কী ভাবেই বা তার ঠাঁই হলো এ পারের এক অনাথ আশ্রমে? ২০১১ সালের ঈদের আগের দিন সীমান্তের কাছে পাটবাড়িতে উৎসবে যোগ দিতে এসেছিল দুর্জয়। সেখানে লুকোচুরি খেলতে খেলতে সীমান্তের একদম কাছে এসে পড়ে। হঠাৎই সে দেখে লোকজন ছুটোছুটি করছে। সেও তখন ছুটতে থাকে। দুর্জয় বলে, একটা লোক আমাকে নিয়ে ছুটতে থাকে। অনেক ক্ষণ ছোটার পরে সে আমায় বলে, তুই ভারতে ঢুকে গিয়েছিস। আর ফিরতে পারবি না। এর পরে সেই লোকটার সঙ্গেই কলকাতায় চলে আসে দুর্জয়। ওই লোকটার সঙ্গেই থাকত সে। তাকে মাদক পাচারের কাজে লাগাত লোকটা। তার সঙ্গেই ট্রেনে চেপে নানা জায়গায় ঘুরেছে দুর্জয়। মাদক পাচারের মতো অন্যায় কাজ করতে ভাল লাগত না দুর্জয়ের। তাই ফের এক দিন পালালো সে। তখন শিয়ালদহে এসে পুলিশের কাছে যায়। এ দেশে আসার পরেই ওই মাদকপাচারকারী তাকে শিখিয়েছিল, ধরা পড়লে ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী বলে নিজের পরিচয় দিতে। ভুলেও যেন বাংলাদেশে বাড়ি বা বাবা-মায়ের কথা না বলে। তা হলে জেলে ঢুকাবে পুলিশ। সেই মতো দুর্জয় নিজের নাম ইন্দ্রনারায়ণ বলতেই তার ঠাঁই হয় হাওড়ার মালিপুকুর হোমে। সেই হোমের বিরুদ্ধে সেদিন অনেক অভিযোগ জানিয়েছিল কিশোরটি। বলল, ওখানে পচা খাবার দিত, পোকাও থাকত। নোংরা জামাকাপড় দিত। কিছু বললে মার জুটত। মারতে মারতে হাত-পা কেটে গেলে সেখানে নুন দিয়ে দিত। মার খেতে খেতে সে এক সময় ভাবে, আসল নাম বললে হয়ত বাংলাদেশে ফেরা যাবে। সেই মতো মালিপুকুর হোমের কর্তৃপক্ষকে নিজের আসল নাম বলেছিল সে। তার কথায়, আমি বাংলাদেশী শুনতেই আরও মারধর করতে থাকে ওরা। তার পরেই সেখান থেকে পালায় সে। তত দিনে অবশ্য হোম থেকে সমাজকল্যাণ দফতর মারফত দুর্জয়ের কথা চলে গিয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের কাছে। সমাজকল্যাণ দফতর বলছে, দুর্জয় পালানোর খবর হোম তাদের জানায়নি। দুর্জয় কোন দিন তাদের কাছে ছিল বলেও অস্বীকার করে তারা।
×