ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়

কল গার্ল, জাতীয় মর্যাদার প্রতি সম্মান ও শুদ্ধি অভিযান

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৩ আগস্ট ২০১৫

কল গার্ল, জাতীয় মর্যাদার প্রতি সম্মান ও শুদ্ধি অভিযান

সাদাত হাসান মান্টোর গল্পে লন্ডনের এক কল গার্ল লাথি মেরে তার খরিদ্দারকে বুকের ওপর থেকে বাথ টাবের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়। কল গার্লকে নিয়ে চূড়ান্ত আনন্দে যাবার জন্যে সে সব কিছুকে নিয়ে স্লাঙ বলতে বলতে শেক্সপিয়রকে নিয়েও স্লাঙ বলে। সাদাত হাসান মান্টোর কলমের শক্তি নিয়ে লেখার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আশ্চর্য হতে হয়, মাত্র এক লাইনের একটি ঘটনা দিয়ে একটি জাতির প্রতিটি নাগরিকের তাঁর মর্যাদার স্থানের প্রতি সম্মান বোধ কোন লেভেল পর্যন্ত থাকে সেটা প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশদের শেক্সপিয়রের মতো আমাদেরও রবীন্দ্র-নজরুল আছেন। তবে এর থেকেও বড় আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। তাই আমরা যখন কোন উচ্চাসনে বসে স্বাধীনতা শব্দটি শুনলে অসম্মানজনকভাবে উড়িয়ে দেয় কেউ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা শব্দকে তাচ্ছিল্য করে, তখন কি মনে হয় না ওই ব্যক্তিটির অবস্থান মান্টোর গল্পের ওই কল গার্লের থেকেও নিচে। যাদের অবস্থান এখানে তারা কেন সমাজে নানান অবস্থানে আছেন- আর এখান থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ কি? কেন এরা সমাজে নানান অবস্থানে আছেন, এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হওয়া দরকার। কারণ, এই গবেষণার ভিতর দিয়ে একটি সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসবে, যা থেকে স্পষ্ট হবে এদের এই বিভিন্ন অবস্থানে থাকার কারণ। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর এ দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রতিবিপ্লব হবার ভিতর দিয়ে দেশের সকল অর্জনের ওপর নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবিপ্লবীরা প্রথমেই চেষ্টা করেছে আমাদের জাতীয় মর্যাদাগুলোকে ধ্বংস করতে। এই ধ্বংস করার কাজটি তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করেছে। দেশ সৃষ্টির জন্যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা গোটা জাতিকে এক করেছিল ওই জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টির পিছনে অন্যতম শক্তি ছিল জাতীয় মর্যাদার প্রতি দেশের মানুষের মনে সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলা। জাতীয় মর্যাদার প্রতি দেশের মানুষের সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলার ফলে, একটি ইস্পাত কঠিন বাঙালী জাতীয়তাবাদ একটি নরগোষ্ঠীকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিল। এ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সব থেকে বড় শক্তি। আর ওই জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিতর দিয়ে যে মর্যাদার স্থানগুলো তৈরি হয়, তা হলো ‘স্বাধীনতা’ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘বঙ্গবন্ধু’। এই তিনটি মর্যাদার স্থানকে বাঙালী যত বেশি উর্ধে তুলে ধরতে পারবে ততই সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এটাই বাঙালীর এগিয়ে যাবার একমাত্র পথ। প্রতিবিপ্লবীরা সব সময়ই বিপ্লবীদের থেকে ধূর্ত হয়। কারণ, বিপ্লবীরা সেইন্ট আর প্রতিবিপ্লবীরা ইবলিশ। তাই এই ইবলিশরা প্রথমেই খুঁজে খুঁজে বের করেছে বাঙালীর কোন্্ কোন্্ অর্জনের স্থানগুলো, মর্যাদার স্থানগুলো নষ্ট করতে হবে। যে কারণে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে জিয়া ও এরশাদ সরকার যে কাজ করে তাহলো সকল শক্তি নিয়োগ করে, রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্থান থেকে জাতীয় মর্যাদার স্থানগুলো ধ্বংস করা ও মুছে ফেলা। এই কাজ তারা সুচারুভাবে করার জন্যে রাষ্ট্র ও সমাজে যারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে বসে নিয়ন্ত্রণ করে ওই সব স্থানে বাঙালী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ বিরোধীদের বসিয়ে দেয়। তারা একের পর এক নানাভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে এই মর্যাদাগুলো মুছে ফেলতে চায়। মর্যাদা নিয়ে বিতর্ক করা, ব্যঙ্গাত্মক কথা বলার একটি কালচার চালু করে দেয়। যে কারণে এদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা প্রভৃতি শব্দ। এমনকি এখনও সামগ্রিকভাবে বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলাকে গ্রহণ করতে পারেনি সমাজ। এমন দুর্ভাগ্যের ভিতর দিয়ে চলছে এ সমাজ। প্রতিবিপ্লবীরা প্রথমে টানা একুশ বছর ও পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও লতিফুর রহমানের সহযোগিতায় আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে আজও সমাজের ও রাষ্ট্রের নানান স্থানে শক্তিশালী এরা। এরা বড় বড় চেয়ারে বসে স্বাধীনতা শব্দ নিয়ে ব্যঙ্গ করে, ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলে, স্বাধীনতা শব্দ সবখানে উচ্চারণ করা যাবে না। যেন স্বাধীনতা একটি ফালতু বিষয়। অথচ শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে বা উচ্চারিত হলেই যে একটি শ্রদ্ধাবোধ আসবে, মনে আসবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে জড়িত ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, সাড়ে ছয় লাখ মা-বোনের আব্রুÑ এ বোধটি তাদের কাজ করে না। বোধটি যে তাদের কাজ করে না তা নয়, আসলে তাদের বিশ্বাস এখানে নয়। বরং তাদের হাত দিয়ে এখনও প্রতিবিপ্লবী জিয়া ও এরশাদের সেই কাজই বাস্তবায়িত হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের অর্জনগুলো ধ্বংস করা। কিন্তু কেন এ কাজটি ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে সমাজ। এ ব্যর্থতার মূল কোথায়। এ ব্যর্থতার মূল কিন্তু ইতিহাস সচেতনতা ও ইতিহাস শিক্ষার অভাব। আর অন্যদিকে নানান স্থানে এখনও প্রতিবিপ্লবী ও ’৭১-এর পরাজিত শক্তি বা পাকিস্তানী দোসররা বসে। তাছাড়া আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ১৯৭১-এর পরাজিত পাকিস্তান কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে এ দেশে মুক্ত হাতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে ২১ বছর ও ২০০১ থেকে আরও পাঁচ বছর। এমনকি ১৯৯৬ ও গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এদেশ থেকে পাকিস্তানী দূতাবাসে বসে এদেশে থাকা আল কায়েদা, উলফা প্রভৃতি জঙ্গী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতা করছে এমন লোককে বহিষ্কার করতে হয়েছে। নিশ্চয়ই দেশবাসীর মনে আছে ইরফান রাজার কথা। দেশের সাংবাদিকরা ইতোমধ্যে আরও অনেক জঙ্গী তৎপরতা, যাদের পিছনে আইএসআই আছে তাদের খবর প্রকাশ করেছে। তরুণ রিপোর্টাররা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে আরও খুঁজে বের করতে পারবে এখনও আইএসআই কীভাবে সিলেটসহ নানান এলাকায় উলফাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। যদিও পেরে উঠছে না। তবে তাদের যোগাযোগ ও টাকার পরিমাণ, নানান ব্যবসাসহ রাষ্ট্র ও সমাজের বড় বড় ব্যক্তির সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক; কীভাবে এখনও তারা ব্যবসা করছে এখানে, টাকা পাঠাচ্ছে কাচিন জঙ্গলে। তাদের এই অর্থ এ সমাজ থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদের অর্জনগুলো মুছে দেবার পক্ষে, বিতর্কিত করার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজ তারা করবেই। কারণ, তাদের অর্থের জোর অনেক। আর এ কাজ করার লক্ষ্যে তারা সুযোগ পেলেই গোখরার মতো ছোবল মারতে চাইবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে কোন জোরালো স্তম্ভের ওপর। এটা তাদের কাজ। এই ইবলিশ, এই প্রতিবিপ্লবী, রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির মেম্বাররা এ কাজ করবেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বাঙালীর অর্জন ও ইতিহাসের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সকল লোভের, ক্ষোভের ও ভয়ের উর্ধে উঠে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশ ও সমাজকে স্বাধীনতার চেতনায় পৌঁছাতে হলে এখনও অনেক দূর যেতে হবে। এখনও আমরা কোন্ তিমিরে বসে আছি তা শুধু একটু সাদাত হাসান মান্টোর গল্পের কল গার্লটির সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, তার খরিদ্দার শেক্সপিয়রকে উদ্দেশ করে সøাঙ বলেছিল বলে, তাকে লাথি মেরে বুকের ওপর থেকে বাথ টাবের বাইরে ফেলে দেয় আর আমাদের অনেক অনেক উঁচু চেয়ার থেকে এখনও বলা হয়, রাখেন ওসব স্বাধীনতা ! এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হবার কিছু নেই। এখান থেকে শুধু উপলব্ধি করতে হবে, দেশ ও সমাজ এখনও কোথায় আছে? এখনও কত দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। এখনও যায়নি রাতের কালো আঁধার। যে আঁধার নেমেছিল ১৫ আগস্ট এ ব-দ্বীপে। তবে এ নিয়ে শঙ্কিত হবার কিছু নেই। কারণ, এখনও দেশ মুক্তির সংগ্রামে। মুক্তির সংগ্রামের যাত্রা বড় দীর্ঘ। এই যাত্রা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করার জন্যে একটি মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম গড়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লবী চেতনা হটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার নতুন প্রজন্মের শুদ্ধি বিপ্লবের যোদ্ধারা গড়ে উঠেছে। এদের ওপরও অনেক আঘাত আসবে, সে আঘাত ব্যক্তি থেকে, স্বার্থ থেকে এমনকি রবীন্দ্রনাথের সেই রাজর্ষির পুরোহিতের পক্ষ থেকেও। কিন্তু শেষ অবধি পুরোহিতও দেবতার পিছনে লুকিয়ে রক্ষা পাবে না। শুদ্ধি বিপ্লবের তরুণ প্রজন্মই জয়ী হবে। [email protected]
×