ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী

সেনাশাসকদের সঙ্গে থাকার সময় কোথায় ছিল তাদের চেতনা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৩ আগস্ট ২০১৫

সেনাশাসকদের সঙ্গে থাকার সময় কোথায় ছিল তাদের চেতনা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের ক্ষতি করে এমন তথ্য প্রচার না করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সম্প্রতি ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে নাগরিক সমাজের একদল নেতার বৈঠক থেকে সংবিধান সংশোধনে সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, যারা এই কথাগুলো বলেন তাদের চেহারা আমি যখন দেখি তখন দেখতে পাই এরাই এক সময় ঐ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী মিলিটারি ডিকটেটরদের উপদেষ্টা হয়েছেন, কেউ তাদের সঙ্গে চাকরি করেছেন, কেউ তাদের পদলেহন করেছেন, তাদের কাছ থেকে একটু করুণা ভিক্ষার জন্য ধর্ণা দিয়ে পড়ে থেকেছেন। তখন কিন্তু তাদের এই চেতনাগুলো ছিল না। মনে হচ্ছে, চেতনার দুয়ারটা যেন তখন বন্ধ ছিল। বুধবার রাজধানীর রমনায় সার্কিট হাউস রোডে ১৬ তলাবিশিষ্ট তথ্যভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যখন ক্ষমতায় এসে সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছি, মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ করে দিয়েছি তখন যেন ওনাদের (সমালোচক) বুদ্ধির দুয়ার খুলে যাচ্ছে, যতই ওনারা গণতন্ত্র পাচ্ছেন, আরও চাই আরও চাই, করতে থাকেন। আর এই আরও চাইয়ের যে ক্ষতিকারক দিকটা সেটা তারা চিন্তাও করছে না। এটা করতে যেয়েই কিন্তু মাঝখানে আরেকটা ধাক্কা এসেছিল। তিনি বলেন, আমরা চেয়েছি, সমালোচনা হোক। সেই সমালোচনা গঠনমূলক হবে। সেই সমালোচনা যেন কেউ বিকৃত না করে। মানুষকে বিভ্রান্ত না করে। যতটুকু ভাল কাজ করেছি, সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে সেটুকুও বলার যেন সাহস থাকে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিকর তথ্য প্রবাহ বন্ধে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় ক্ষতিকর তথ্য প্রবাহ বন্ধে বিশেষভাবে খেয়াল রাখবে। বেসরকারী টেলিভিশনে টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সরকারের সমালোচনা করেন, কিন্তু জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না। আজ অনেকেরই মুক্তবুদ্ধির দুয়ার খুলেছে। কিন্তু সামরিক শাসক ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তাদের মুক্তবুদ্ধির দুয়ার বন্ধ ছিল। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসের ক্ষতিকর দিক প্রচার করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে সারা বিশ্বে জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশেও এক সময় জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের উত্থান ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে কঠোরহস্তে দমন করেছে। জনগণের কাছে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের নামে ভয়াল নাশকতা ও সহিংসতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত যাতে আবারও দেশে কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালাতে না পারে সেজন্য জনগণকে সচেতন করতে হবে। আর এ গুরু দায়িত্ব পালন করতে পারে গণমাধ্যম। সরকারের সমালোচকদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে আলোচনা করতে গিয়ে গণতন্ত্র নাকি দেখেনই না, কেউ সংবিধান সংশোধনের জন্য আবার সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলে, কেউ নানাভাবে নানা কথা বলে। এটা করতে গিয়েই কিন্তু মাঝখানে আবার একটা ধাক্কা এসেছিল। আমরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কিন্তু আবার গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছি এবং সেটা করে যাচ্ছি। যখনই যতটুকু সুযোগ পাচ্ছে এতে যেন তাদের চাহিদার মাত্রাও আরও বেশি বেড়ে যাচ্ছে। তবে চাহিদা থাকা ভাল, তাতে আমরা আপত্তি করব না। আমরাও চাই গণতন্ত্র আরও বিকশিত হোক, আরও সুসংহত হোক। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে গণতন্ত্রের ওপর বার বার আঘাত এসেছে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে। সেখান থেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পালা শুরু হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকৃত করা হয়। স্বাধীনতার সময় যারা নারী ধর্ষণ, লুটপাট করেছে তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধশক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের উন্নতি ব্যহত হয়েছিল। ২১ বছর বাংলাদেশের জনগণ বিকৃত ইতিহাস শুনেছে। পরাজিত শক্তির দাপট ছিল। শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমরা যখন সরকার চালাচ্ছি তখন সকলের কিন্তু কথা বলার অধিকার আছে এবং সকলে কিন্তু কথা বলেও যাচ্ছে। যা মনে আসছে, মুখে আসছে বলে যাচ্ছে। সে বলার সুযোগ যে তারা পাচ্ছে, আমি আশা করি যারা বলছেন তারা অন্তত এই কথাটুকু তারা মনে রাখবেন। ’৯৬ সালের আগে এবং ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কী অবস্থা ছিল, ওই সময় কতটুকু বলতে পেরেছেন সেটুকুও তারা যেন একটু চিন্তাভাবনা করেন। বর্তমান সরকারের দু’মেয়াদে এ পর্যন্ত ৩২টি বেসরকারী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ২৪টি এফএম বেতার কেন্দ্র এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও পরিচালনার অনুমোদন দেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কথা বলার সুযোগটা কিন্তু আমরাই করে দিয়েছি। বাংলাদেশে একটামাত্র টেলিভিশন ছিল সেটা হলো বিটিভি, তাও সরকারের। আমরাই প্রথম বেসরকারী খাতে টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দেই। অন্য কেউ তো সাহসই পায়নি টেলিভিশনকে বেসরকারী খাতে দিতে। শুধু টেলিভিশনই নয়, বেসরকারীখাতে রেডিও কেউ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমার কাছে মজা লাগে যখন দেখি আমরাই দিলাম বেসরকারী টেলিভিশন আর সেখানে বসে আমাদের সমালোচনাটাই যেন সবচেয়ে বেশি। সুযোগটা যে আমরা করে দিয়েছি, কথা বলার সময় যারা বলেন তারা এই কথাটা মনে রাখেন না। তাই তাদের কাছে অনুরোধ করব, বলার সময় যেন মনে রাখেন আওয়ামী লীগ সরকারই এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের কর্ণধারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সমাজে বিত্তবান ব্যক্তি যারা আছেন, ব্যবসাবাণিজ্য করে মোটা টাকা কামাই করছেন। তারা একটা টেলিভিশন কিনে নিয়ে বসে থাকলে আর ব্যবসার কথা চিন্তা করলে চলবে না। তার মাধ্যমে সমাজকে উন্নত করার, জনগণের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাঙালী। বাঙালী হিসেবে আমাদের যে চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতি রয়েছে, শিক্ষা রয়েছে সেগুলো আরও যাতে বিকশিত হয়, সেই বিষয়গুলোর দিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্ম নিয়ে লেখালেখি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলে যার যার ধর্ম নিয়ে চলবে। সকলের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে। কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কোন কাজ করবে না বা বলবে না। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ভোগ করবে। সেইভাবেই আমরা বাংলাদেশকে গড়তে চাই। মাদকের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাদক ব্যাধির মতো সমাজে প্রবেশ করেছে। যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সমাজের জন্য মাদক বিরাট ক্ষতি। মাদক সেবন করলে কী কী ক্ষতি হয় তা ব্যাপক হারে প্রচার করা দরকার। অর্থাৎ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা জরুরী। আর মিডিয়াই পারে সেই সচেতনতা তৈরি করতে। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের জন্য অষ্টম ওয়েজবোর্ডের ঘোষণা করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য বেতন কাঠামোর নীতিমালা করা দরকার। তথ্য সচিব মর্তুজা আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবাহান চৌধুরী ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান। উল্লেখ্য, ৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয়ে ১৬ তলা তথ্য ভবনের নির্মাণ কাজ ২০১৬ সালে শেষ হবে। এ ভবনে অফিস স্থাপনের পাশাপাশি আধুনিক লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র, ফিল্ম প্রজেকশন হল, অডিটরিয়াম, ডিজিটাল তথ্যভা-ার থাকবে।
×