ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য

প্রকৃতি থেকে নেয়া ফর্ম- পুরনো থেকে নিপুণ শিল্পভাষা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১২ আগস্ট ২০১৫

প্রকৃতি থেকে নেয়া ফর্ম- পুরনো থেকে নিপুণ শিল্পভাষা

মোরসালিন মিজান মৃত, এমনকি অচ্ছুৎ যে বৃক্ষ, তার কাছে না গেলেও চলে। কে যায়? পরিত্যক্ত ডালপালা পায়ে মাড়িয়ে চলাই যে নিয়ম। সে নিয়ম ভাংতে আছে? অথচ তাই করে চলেছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তাঁর চেনাপথের বাইরে চলা পথ। পথটি ধরে নীরবে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছেন। বহুকাল। মাটির সঙ্গে অর্ধেক মিশে যাওয়া বৃক্ষশাখা, এক টুকরো কাঠ, শুকনো ফসিলÑ কোনটিই চোখ এড়ায় না তাঁর। বরং অন্তর্নিহিত রূপ ও ভাষা নিয়ে সামনে আসে। ফেরদৌসী তাদের অবয়ব দেন। ভাষা দান করেন। আর তখনই ভাস্কর্যের মর্যাদা পায় ‘আঁকাবাঁকা শুকনো কতকগুলো কাঠির কঙ্কাল।’ ভূমিতে লুটিয়ে পড়া বুড়ো বৃক্ষ অনন্য উচ্চতা পায়। সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষ তাই মুগ্ধ হয়ে দেখেন। নতুন চোখে পুরনো আর ফেলে আসাকে দেখেন। ঠিক এই মুহূর্তে ধানম-ির বেঙ্গল গ্যালারিতে গেলে সেই দেখাটা হয়ে যাবে আরও একবার। গত শুক্রবার থেকে এখানে চলছে খ্যাতিমান শিল্পীর একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। শিরোনামÑ নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা। প্রতিদিনই কৌতূহলী মানুষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁর কাজ। শিল্পী প্রতিদিন থাকেন না। তাঁর হয়ে কথা বলছে এক একটি সৃষ্টি! বেঙ্গল গ্যালারির আয়োজন বলেই হয়ত, অপেক্ষাকৃত বড়। সংখ্যায় বেশি। তার চেয়েও লক্ষ্যণীয়Ñ সুনির্বাচিত ভাস্কর্য। বিশালায়তন গ্যালারি যেন ভরে ওঠেছে। বড় কাজগুলো সহজেই চোখে পড়ে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাস্কর্যে চোখ আটকে যায়। জীর্ণ রুক্ষ শুষ্ক গড়নের গভীর থেকে ফর্ম খুঁজে নিয়েছেন ভাস্কর। নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন। কিচ্ছুটি বলার ক্ষমতা যার ছিল না, সে-ই কথা বলে চলেছে অবলীলায়। কত কত কথা! কান পাতলে শোনা যায়। শিল্পী ফর্মের মধ্যে কল্পনার যোগ করেছেন। নিজের ভেতরের আবেগটুকু সযতেœ সঞ্চারিত করেছেন। কেমন যেন সচলতা পায় ভাস্কর্যগুলো। বিশিষ্টার্থক গঠন-নৈপুণ্যে নবরূপার জন্ম হয়। শিল্পী যা দেখছেন তার একটি নতুন ধরনের সংযোজিত বা সংস্থাপিত সমগ্রতা খুঁজে পাওয়া যায় ভাস্কর্যগুলোতে। হত্যা খুন অপমৃত্যুর এই কালে শিল্পী ভালবাসার বোধ দ্বারাই বেশি তাড়িত। শাশ্বত প্রেমের ভাষায় কথা বলতে প্রয়াসী হয়েছেন। একাধিক ভাস্ককর্যে প্রেমের শিল্পভাষা। শুকনো গাছের কা- থেকে গড়া ‘প্রণয় পাশা’র কথাই যদি ধরা যায়, এখানে দুটি পাখির ঠোঁট লম্বা হয়ে পরস্পরকে ছুঁয়ে দিতে চায়। কী যে নিখুঁত নির্ভুল এই চাওয়া! এমন আরও কিছু চাওয়া পাওয়া মূর্ত হয়েছে কামিনীর শুকনো ডালে। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্যে গভীর চুম্বন। ভালবাসার যুগল শ্রোতে ভেসে যাওয়া। চারপাশের প্রকৃতি থেকে খড়কুটো নিয়ে কখনো পুষিক্যাট, কখনো ভোঁদড়ের আকৃতি গড়েন শিল্পী। তীক্ষè দৃষ্টি দেন হুতুম পেঁচার চোখে। আছে মানবিক মানুষের অবয়ব। শিল্পী মায়ের মুখটি গড়েছেন দারুণ যতœ নিয়ে। এমনকি গর্ভবতী মা তাঁর প্রসব বেদনা নিয়ে উপস্থিত। ছোট্ট কিন্তু অসাধারণ কাজ। মাদার তেরেসার মুখের বলিরেখা শিল্পী খুঁজে নিয়েছেন বৃক্ষের বয়স্ক শেকড় থেকে। অন্য একটি শেকড়ে গড়েছেন ‘ভবঘুরে’। শহুরে দৃশ্যায়নের পাশাপাশি এসেছে গ্রামের ভুলতে বসা প্রতিদিন আর বন্ধনের গল্প। ‘কেশবিন্যাস’ শিরোনাম করা ভাস্কর্যে এক নারী সামনে বসা অপর নারীর চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন। জটিলতর দৃশ্যায়ন। তবে সহজেই করে দেখিয়েছেন প্রিয়ভাষিণী। তাঁর দেখার চোখ এবং সৃষ্টির ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেয় এই শিল্পকর্ম। আজীবন সংগ্রামী প্রিয়ভাষিণী একাত্তর ভুলেননি। প্রায়শই বলেন ইতিহাসটি। এ প্রদর্শনীতে অল্পবিস্তর আছে। ক্ষুদ্র ভাস্কর্যে তিনি শরণার্থী জীবনের কথা বলেছেন। মিছিলের প্রতিবাদী মুখগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। সমকালীন ভাবনার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে কোন কোন ভাস্কর্যে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মৃত স্বদেশী ভাইয়ের মুখটিও এখানে দিব্যি দেখে ফেলা যায়। আরও কিছু রিলিফ ওয়ার্ক সত্যি দেখার মতো। মিক্সড মিডিয়ার কিছু কাজও দেখার মতো। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্যে ভরপুর প্রাণ। এর পরও তিনি এখানে ওখানে কিছু সবুজ গুঁজে দেন। বনসাই রেখে দেন। এভাবে প্রকৃতির নানা অনুসঙ্গ একত্রে মিলেমিশে যায়। শিল্প সুষমা নিয়ে প্রকাশিত হয়। অনন্য সুন্দর এ প্রদর্শনী ২২ আগস্ট পর্যন্ত চলবে।
×