ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আর কত রক্ত? আর কত প্রাণ? শান্তি কোথায়-কতদূর?

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১০ আগস্ট ২০১৫

আর কত রক্ত? আর কত প্রাণ? শান্তি কোথায়-কতদূর?

এভাবে খুন করা যদি স্বভাবে পরিণত হয়, তো অচিরেই খাঁচায় বসবাস করতে হবে। মানুষ তো রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। খুনের সঙ্গে বসবাসের এই অভ্যাসের পরিণাম কী হবে সরকার কি ভেবে দেখছে? এমন না যে সরকার চাইলেই এর সমাধান মিলে যাবে। কিন্তু সরকারী উদ্যোগ আর আন্তরিকতা থাকলে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি আসবে। সেটা যদি না থাকে ভবিষ্যত কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। ব্লগার নিধনের পাল্লায় সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জটিলতাও বাড়ছে। নিজেদের গিনিপিগ ও অসহায় ভাবতে অভ্যস্ত এই মানুষগুলো এখন আবার হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। এমন না যে তাদের দুর্ভাবনা অযৌক্তিক। ফলে সরকার একদিকে যেমন সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি লঘুরাও এখন আস্তে আস্তে আস্থাহীনতার দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পুরনো ও ঝানু আওয়ামী লীগার। তিনি নিজেই কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই কঠোরতা যে কত কঠোর হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একটা কথা জানানো দরকার, বিদেশে বাঙালীর ভেতর এই সরকারের জনপ্রিয়তা বেশ নিম্নগামী। কতিপয় নেতা নামধারী আওয়ামী লীগারকে বাদ দিলে মানুষের মনে জাগে অস্বস্তি। এ সুযোগে বিএনপি আর জামায়াতীদের পোয়াবারো। তারা দিব্যি বলে বেড়ায় যা কিছু অর্জন বা উন্নতি তার পেছনে আছেন সাধারণ মানুষ। আর যা কিছু ভোগান্তি বা নষ্টামি তার পেছনে সরকারের লোকজন। এই প্রচার এখন বেশ পোক্ত। স্থানীয় বিদেশী আওয়ামী লীগাররা এগুলোর কোন জবাব তো দিতে পারেনই না, বরং তাদের হাবভাবে মনে হয় তারাই মন্ত্রী-মিনিস্টার। এদ্দিন এই জাতীয় অপপ্রচার রাজনৈতিক বা আদর্শিক বৃত্তে থাকলেও এখন আর নেই। এখন এর সঙ্গে জীবন-মরণের সমস্যা জড়িয়ে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক ও করুণ হয়ে উঠছে। যে জায়গাটায় সমস্যা প্রকটতর সেটাই আসলে বুঝে উঠতে পারছে না বা আমলে নিচ্ছে না তারা। যখন নেবে তখন হয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে। নিলয় হত্যার পর জাতিসংঘ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দেখার বিষয় জামায়াতীরাও তার মৃত্যুতে প্রতিবাদ বা শোক জানিয়েছে। খবরে দেখলাম নিলয় নাকি মুসলমান ছিল তাই এই শোকবার্তা। তাই যদি হবে তো এর আগে নিহত মুসলমান ব্লগারদের বেলায় তারা চুপ ছিল কেন? আসলে সবাই যার যার দৃষ্টিকোণ আর ধান্দা থেকে ঘটনা দেখতে ব্যস্ত। জামায়াতের রাজনীতি যাতে নিষিদ্ধ না হয়, যাতে তার গায়ে সন্ত্রাসী বা খুনীর ছাপ না লাগে, সে জন্য এই বিবৃতি দেয়া। ঘটনাটি উল্লেখ করার কারণ তাদের কৌশল বা ধারণা কতটা কার্যকর আর সুদূরপ্রসারী সেটা বোঝানোর জন্য। সে জায়গায় আওয়ামী লীগের বা তাদের জোটভুক্ত দলগুলোর কোন খবরই নেই। এই সিংহাসন কি পার্মানেন্ট কিছু? এখন তারা যদি ভাবে তারা গেলেও তাদের কোন সমস্যা হবে না সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু পেছনে ফেলে যাওয়া মানুষদের কথাও ভাবতে হবে। গণজাগরণ শাহবাগ বা মুক্তচিন্তার ফসল কারা ভোগ করেন? কাদের পকেটে যাবে এসব আন্দোলনের ফলাফল? সেটাকে অস্বীকার করা বা বিদেশের সহানুভূতি ও জঙ্গীবাদবিরোধী সমর্থনের আশায় খুনের বিচার ত্বরান্বিত না করা কিন্তু সময়ের কাছে টাইমবোমা জমা রাখার মতো এক বিধ্বংসী কাজ। সমাজ বা দেশ এমনিতেই বেশ অন্ধকারে। এ দেশকে যারা অন্ধকারে রাখতে চায়, আবার আঘাত হেনেছে তারা। রাজপথে নিরাপদ নয়। বাইরে নিরাপদ নয়। মাতৃগর্ভে নিরাপদ নয়। ঘরে নিরাপদ নয়। তবে কি খাঁচায় থাকতে হবে মুক্ত মানুষদের? এ যেন এক ধারাবাহিক খেলা। ওয়ান ডে টাইপের নয় । সিরিজ জাতীয় কিছু। এ কারণেই সরকার বা প্রশাসন এর দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আজকাল কিছু বললেই মতামত কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। এক ভাগে আছে আওয়ামী লীগ আরেক ভাগে বিএনপি-জামায়াত। বাকিটা উচ্চকণ্ঠের না হলেও নানা মতে বিভক্ত। প্রথম দু’দলের জ্বালায় বাকিদের কোন কথা টেকে না। কেউ শুনতেও পায় না। সংখ্যাধিক্যের এই আরেক জ্বালা। আমরা আছি ঘোর সঙ্কটে। আওয়ামী লীগ যদি বলে এটা খুন, অন্য দলের লোকেরা বলবেন : না তো। এর চেয়ে সহজ স্বাভাবিক মৃত্যু হতেই পারে না। তারা যদি বলেন খুন, তো সরকার তা হেসে উড়িয়ে দেবে। মানুষের জীবনের মতো পরম সম্পদ নিয়ে এমন তামাশা একমাত্র আমাদের দেশে, আমাদের সমাজ ও জাতিতেই সম্ভব। পুলিশ আর নিরাপত্তার নামে নিয়োজিত কিছু সরকারী কর্মচারী ঘটনা ঘটার পর ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতো এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করেন। কেউ কেউ ক্যামেরার সামনে কড়া কড়া কথা বলেন। তারপর সব সুনসান। রক্তের দাগ শুকানোর আগেই আবার তৈরি হয়ে থাকে বইমেলার রাজপথ। নদীর পানি আবারও ভাসতে ভাসতে খুঁজতে থাকে আর সাতটা লাশ আসল কিনা। এখন তো ঘরের দরজা-জানালাও আতঙ্কে দিন গুজরান করবে। তালা নিজেই হয়ত খুলে গিয়ে বলবে : ভেতরে যাও টার্গেট ফিক্সড কর। আমাকে মেরো না। মানুষ আসলে কী করবে? তাঁর আদর্শের দল যদি তাদের বাঁচাতে না পারে কোন্ দিকে যাবে তারা? আমরা জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লড়ছেন। অনেক সংস্কার আর জরুরী কাজ তিনি করে দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। কিন্তু এখন যে এদিকেও নজর দেয়ার সময়। না হলে বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দেবে আমাদের শত্রু, জাতির দুশমন মৌলবাদ। সে জায়গাটার কথাই মনে করিয়ে দিয়ে গেল নিলয় নীল। একের পর এক ব্লগার নামধারী মুক্তচিন্তার তরুণদের খুন হতে দেখে যারা ভড়কে যাবে, ভয় পাবে, আর সত্য বলবে না, সে তারুণ্যকে অভয় দিতে না পারলে এ দেশ যে দেশ থাকবে না এটাও কি বলে বোঝানোর বিষয়? বিদেশেও আমরা আজ আতঙ্কিত। ঘরে ঢুকে খুন করার এই কালে কেউ কোথাও নিরাপদ নয়। সরকার একা কেন মোকাবেলা করবে? এখন নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সংগঠন আর কৌশল আছে, আছে সাধারণ জনগণ। তাদের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা নিলে কাজ হবেই। আমরা কি তা প্রত্যাশা করতে পারি না?
×