ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নামেই জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস ॥ অংশীদারিত্ব কমছে দেশীয় কোম্পানির

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৯ আগস্ট ২০১৫

নামেই জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস ॥ অংশীদারিত্ব কমছে দেশীয় কোম্পানির

রশিদ মামুন ॥ নামসর্বস্ব হয়ে উঠছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। জ্বালানি উত্তোলনে ক্রমান্বয়ে দেশীয় কোম্পানির অংশীদারিত্ব কমে আসছে। এমনকি দেশীয় কোম্পানির রিগ বসিয়ে রেখে বহুজাতিক কোম্পানিকে কূপ খননের ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে। দেশের তৃতীয়মাত্রার ভূকম্পন জরিপের ফল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কার্যক্রমও দেড় বছরে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য কোন অর্জনের কথা জানাতে পারেনি। আজ ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে মূল্যবান সম্পদ অপচয় রোধে যথাযথ এবং সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে সকলকে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্যাস ও কয়লার ব্যবহারের পাশাপাশি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ইআরএল-এর ২য় ইউনিট স্থাপন, তেল পরিবহন এবং খালাসে সাশ্রয়ী সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর ৯ আগস্ট জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করা হয়। সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র ৬ দিন আগে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের জ্বালানি সঙ্কট সমাধানের জন্য পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে তিতাস এবং হবিগঞ্জের দুটি গ্যাসক্ষেত্রের সব শেয়ার কিনে নেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিঃ (বিজিএফসিএল) প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের ভবিষ্যত জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতির পিতা এই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশপ্রেমের কৃতি ধরে তোলার পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তায় দেশীয় অংশীদারিত্ব বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ হতেই জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করা হয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতাÑদেশের গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে এখন দুই হাজার ৭২২ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মোট গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ ৬০ ভাগ। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো তুলছে ৪০ ভাগ। মাত্র দুই বছর আগেও দেশীয় গ্যাস কোম্পানি এবং বহুজাতিক গ্যাস কোম্পানি সমান গ্যাস তুলত। দিন দিন এই পার্থক্যের হার আরও বাড়ছে। দেশের তিনটি গ্যাস কোম্পানি ১৭টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তুলছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড প্রতিদিন তুলছে ৮২৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র। সিলেট গ্যাসফিল্ড পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে তুলছে প্রতিদিন ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এছাড়া বাপেক্স সাতটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে তুলছে ১৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। দেশীয় কোম্পানির ১৭টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট এক হাজার ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলার বিপরীতে শেভরন বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে একাই এক হাজার ২০৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তুলছে। এছাড়া জালালাবাদ থেকে শেভরন ২৫১ মিলিয়ন, মৌলভীবাজার থেকে ৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তুলছে। আরেক বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লো বাঙ্গুরা ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন গ্যাস তুলছে ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় কোম্পানির তেল-গ্যাস উত্তোলনের অভিজ্ঞতা থাকলেও বিদেশীদের তৎপরতা বেশি দেখা যাচ্ছে। সরকার তার গত মেয়াদে দেশীয় গ্যাস কোম্পানির বাইরে স্থলভাগের ব্লক ইজারা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই চিন্তা থেকে সরে আসছে। সম্প্রতি দেশের স্থলভাগের ব্লকও বিদেশী কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এমনকি দেশীয় গ্যাস কোম্পানির রিগ (খননযন্ত্র) বসে থাকার পরও বহুজাতিক কোম্পানিকে দিয়ে দেশীয় কোম্পানির কূপ খনন করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে দিয়ে পাঁচটি কূপ খনন করার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কূপগুলো হচ্ছে বাখরাবাদ-১০, রশিদপুর-৯, রশিদপুর-১০, রশিদপুর-১২ এবং শ্রীকাইল-৪। এগুলো খনন করতে মোট ব্যয় হবে নয় কোটি ৬২ লাখ ২৯ হাজার ৩৯৮ টাকা। এর আগেও রাশিয়ান গ্যাস কোম্পানিকে দিয়ে ১০টি কূপ খনন করা হয়। ওই সময় বাপেক্সের প্রত্যেকটি কূপের জন্য গ্যাজপ্রমকে দিতে হয় ১৮ দশমিক ছয় মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড এবং বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেডকে দিতে হবে ২০ দশমিক ছয় মিলিয়ন ডলার। প্রত্যেকটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রমকে গড়ে ১৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয় দেশীয় গ্যাস কোম্পানির। কিন্তু সেখানে বাপেক্স মাত্র ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকায় একটি গ্যাস কূপ খনন করে থাকে। ওই সময়ে বলা হয়, জাতীয় গ্যাস ঘাটতির কারণে গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়া হয়েছে। বাপেক্সের একার পক্ষে এত কূপ খনন করা সম্ভব নয়। বাপেক্স সূত্র বলছে, এখন মোবারকপুরে বাপেক্সের একটি রিগ কাজ করছে। সেখানে কাজও শেষ পর্যায়ে আর বাইরে বাপেক্স সালদা নদীতে রিগ পাঠিয়েছে কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। কৈলাসটিলায় কূপ খনন শেষে রিগ বসে রয়েছে। এছাড়া বাপেক্সের হাতে কূপ খননের নতুন কোন কাজও নেই। একদিকে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিকে কাজ করতে না দেয়া; দ্বিমুখী নীতি। যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিনের পর দিন অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় অভিজ্ঞ জনবল ধরে রাখতে না পারায় কার্যক্রমে বিঘœ ঘটছে। এরমধ্যে সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি তাদের একটি গ্যাসক্ষেত্রে করা তৃতীয়মাত্রার জরিপ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করে বাপেক্সকে দিয়ে ওই তৃতীয়মাত্রার জরিপ করা হয়। এছাড়া বাপেক্স সালদা নদীতে দুই হাজার ৫১১ মিটার গভীরতা থেকে গ্যাস তুলত। সেখানে তৃতীয়মাত্রার জরিপ করে বলা হয়, দুই হাজার ৮০০ মিটার গভীরতায় গেলে আরও বেশি গ্যাস পাওয়া যাবে। কিন্তু দুই হাজার ৮৩৯ মিটার গভীরতায় কূপ খনন করে আরও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। জানা যায়, একটি বহুজাতিক কোম্পানি বাপেক্সকে দিয়ে তৃতীয়মাত্রার জরিপ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন সরে এসেছে। অন্যদিকে গত দেড় বছরে উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি পেট্রোবাংলা। ক্রমেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ছে। স্থলভাগের পাশাপাশি বিশাল সমুদ্রসীমা বিজয়ের পরও পেট্রোবাংলা ওই এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। উপরন্তু যেসব বিদেশী কোম্পানি সাগরে তেল -গ্যাস অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছিল তারাও চলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেল অয়েলের কাছ থেকে তিতাস এবং হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র কেনার সময় এতে মোট ছয়টি কূপ ছিল। এর মধ্যে তিতাসে ৪টি এবং হবিগঞ্জে ছিল ২টি কূপ। ’৭৫-এ ছয়টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১ দশমিক ৮৯১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হতো। টাকার অঙ্কে এর দাম ছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৪৮৪ টাকা। এছাড়া উপজাত হিসেবে সাত হাজার ২৯৯ টাকার ৯৪ বিবিএল কনডেনসেট পাওয়া যেত। তখন তিতাসে ২ দশমিক ১০ টিসিএফ এবং হবিগঞ্জে ১ দশমিক ৯০ টিসিএফ গ্যাসের আনুমানিক মজুদ নির্ধারণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করতে যাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।
×