মোরসালিন মিজান ॥ শুধু কথা হবে। এত কাজের মানুষ যিনি, তাকে দিয়ে কথা। আসলেই হবে তো! শঙ্কাটা ছিল। অনুষ্ঠান শুরুর আগ পর্যন্ত ছিল। আর যখন শুরু, পাল্টে গেল সব। মমতা শংকর বললেন। বলাটা প্রাঞ্জল। উপভোগ্য। বাহুল্যহীন। কী বলবেন? কতটা? কেন? সবই যেন আগে থেকে ঠিক করা ছিল। আদতে এটা তার বাড়তি গুণ। ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের মেয়ে মমতা শংকর নাচ জানেন। খ্যাতিমান তারকা। নাচেন। শেখান। অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনসহ কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে। আর তার পর শোনা হলো বক্তৃতা। শুনতে শুনতেই বোঝা গেল, এখানেও অসাধারণ মমতা। উপস্থিত শ্রোতা তাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন। তাকে শুনতে গিয়ে শোনা হলো নৃত্যকলার সেকাল। আজকের কাল। সমকালীন যত ভাব-ভাবনা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরলেন তিনি। বাবার কথা হলো। মমতার বর্ণনায় বিশ্লেষণে আরও সহজ হলেন উদয় শংকর। সহজবোধ্য হয়ে ধরা দিলেন। সব মিলিয়ে অনবদ্য একটি আয়োজন।
আয়োজক শিল্পকলা একাডেমি। শনিবার দুপুরে একাডেমির সেমিনার কক্ষে আয়োজিত প্রীতি সম্মিলনীতে যোগ দেন নাচের সংগঠন সাধনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসা মমতা শংকর। বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী লায়লা হাসান, লুবনা মরিয়ম, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপা খন্দকার, মুনমুন আহমেদ, আনিসুল ইসলাম হিরু, তামান্না, ওয়ার্দা রিহাবসহ এ প্রজন্মের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পীরা আপনজনের মতোই ঘিরে বসেছিলেন মমতাকে। ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীসহ অন্যরা।
আয়োজকরা এদিন মমতা শংকরকে নিজের মতো করে বলার আহ্বান জানান। সেভাবেই বলে যান তিনি। খুব সহজ করে বলা। অথচ গভীর। তিনি বলেন, নৃত্য জীবনেরই আরেক রূপ। ছন্দ নষ্ট হয়ে গেলে তাল কেটে গেলে নৃত্য যেমন নৃত্য থাকে না, মানুষের জীবনে ছন্দপতন হলে তাল কেটে গেলে সে জীবনও তছনছ হয়ে যায়। এভাবে বহু কাল ধরে জীবন আর নাচ সমান্তরালে চলছে। নাচকে নাচের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি। নাচের ভাষা নিয়েও চমৎকার ব্যাখ্যা দেন শিল্পী। বলেন, এর ভাষা অত্যন্ত শক্তিশালী। ইউনিভার্সেল ল্যাংগুয়েজ। ভাষাটির প্রতি যতœবান হতে পারলে সবার কাছে পৌঁছা যায়। এ পর্যায়ে ভিসা পাসপোর্ট প্রথার প্রতি চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন শিল্পী। বলেন, আমি চাই ভিসামুক্ত বিশ্ব। আর তা সম্ভব নাচের মাধ্যমে। গোটা পৃথিবীকে এক করতে পারে নাচ। কথার কথা বলে মনে হয় না।। বেশ জোর দিয়েই বলছিলেন শিল্পী। এমন বলার মধ্য দিয়ে নাচের প্রতি তার প্রেম এবং আনুগত্যটুকুও প্রকাশিত হয়ে যায়। সারা দুনিয়ার নাচের খবর রাখলেও, মমতা শংকর শেকড় সন্ধানী। নিজের মাটি থেকে প্রকৃতি পরিবেশ থেকে প্রাণশক্তি নিয়ে বাঁচেন। জানান, এ শিক্ষা তিনি পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। বলেন, বাবা নিজের শেকড় খুব ভাল করে চিনতেন। বুঝতেন। ভারতীয় নাচটা বড় ভালবেসে করতেন তিনি। কিন্তু উদয় শংকরের নাচে ইস্টার্ন ওয়েস্টার্নের মিশেলে এক ধরনের ফিউশন খুঁজে পান কেউ কেউ। সে প্রসঙ্গও নিজ থেকে তুলেন কন্যা। তার জবাবÑ বাবার নাচের ধারা নিয়ে কখনও কখনও ভুল ব্যাখ্যা আসে। প্রকৃতপক্ষে তিনি লম্বা সময় বিদেশে কাটালেও, মাটি আঁকড়ে ছিলেন। তবে কট্টর ছিলেন না। সব সময় বলতেন, যার যা ভাল তা দেখ। নাও। তা না হলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। একইসঙ্গে সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, অন্ধের মতো নিও না। অন্যের নাচে যা দেখলে নিজের নাচে তা হুবহু তুলে এনো না। নিজ দেশের নাচের বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে গর্ব করার কথা জানিয়ে মমতা শংকর বলেন, আমাদের কত কত ক্ল্যাসিকাল ফর্ম। ফোক ফর্ম। এগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
উদয় শংকরের নাচের সৌন্দর্য বলে শেষ করার সাধ্য কারও নেই। তবে এদিন মমতা যা বললেন তাতে মন ভরে গেল। উদয় শংকরের ছবি আঁকার গুণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বাবার কাছে মঞ্চটা ছিল ক্যানভাস। এখানে ছবিই আঁকতেন তিনি। ক্যারেক্টার কীভাবে ইন্ট্রুডিউস করাতে হবে, প্রতিষ্ঠা দিতে হবে, তিনি খুব ভাল জানতেন। সেভাবেই কাজ করেছেন। নাচের ক্ষেত্রে উদয় শংকর শরীর মন ও আত্মাকে এক সুতোয় গেঁথে নিতেন বলে জানান তিনি। উদয় শংকরকে বুঝতে মা অমলা শংকর সাহায্য করেছেন জানিয়ে শিল্পী বলেন, তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। বাবার নাচের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ধরতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। মমতা বলেন, প্রায়শই আমার নাচ দেখে মা বলতেন, ভাল হয়েছে। তবে উদয়ের ফর্ম এটা নয়। এখন আমি বুঝি, বাবার নাচের নিজস্ব ফিলসফি ছিল। তিনি ভাসা ভাসা কিছু করেননি। সে কারণেই কেউ চট করে ধরে ফেলতে পারেন না।
উদয় শংকর থেকে উদ্ধৃত করে কিছু পরামর্শও দেন মমতা। বলেন, নাচ ভাল করতে হবে। কিন্তু খুব লম্বা করা যাবে না। দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো যাবে না। নাচ থেকে আলাদা করে ম্যাসেজ দেয়ারও প্রয়োজন নেই। আর দিলে তা হতে হবে সহজবোধ্য। শিল্পীদেরকে বিনয়ী হতে হবে। আমিই সব জানিÑ এমনটি ভাবা যাবে না। বর্তমান সময়ের নাচের কিছু মন্দ প্রবণতাও তার আলোচনায় একাধিকবার ওঠে আসে। শিল্পী বলেন, আমাদের ছেলে মেয়েরা খুব সুন্দর নাচে। ভাল কাজ করে। কিন্তু অনেকেই দেখছি ওয়েস্টার্ন দ্বারা বাজেভাবে প্রভাবিত। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নৃত্য শিল্পীদের টাকা পয়সার দিকে না ছতার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তাল ও সুরের জ্ঞান ভগবানের আশীর্বাদ। টাকা দিয়ে হয় না। মন দিয়ে কাজ করলে টাকা খ্যাতি শিল্পীর পেছনে ছুটে। আর শিল্পী নিজে ছুটলে সব হারায়। ভাল মনের মানুষ হওয়ার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ভাল মন হলে ভাল মানুষ হবে। ভাল মানুষ হলে ভাল নাচও হবে। এভাবে অনেক প্রসঙ্গে কথা হয়। কথা এগিয়ে যায়। এক সময় শেষ হয়। এবং তারপরও কিছু যেন বাকি থেকে যায়। রেশটা কাটে না। এমন একটি আয়োজনের জন্য প্রশংসা পেতে পারে শিল্পকলা একাডেমি।