ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুসান সাউদার্ড

বিস্মৃতপ্রায় নাগাসাকি

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৯ আগস্ট ২০১৫

বিস্মৃতপ্রায় নাগাসাকি

৯ আগস্ট, ১৯৪৫। এই দিনটিতে আমেরিকা জাপান উপসাগরের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ কিউশোর নাগাসাকি শহরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল পারমাণবিক বোমার। শুরু থেকেই তিন দিন আগের হিরোশিমা পারমাণবিক আক্রমণ থেকে এটি ছিল ভিন্ন। তবুও দুটি শহরের অত্যন্ত হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা ‘বোমা’ শব্দটিকেই কানে বাজিয়ে চলে। এই ভয়াবহ ঘটনায় নাগাসাকি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। অনেক আমেরিকানই তাদের সরকারী কর্মকর্তাদের ভাষ্যকেই বিশ্বাস করে। তাদের সেই ভাষ্য ছিল, ওই দুটি বোমাবর্ষণের কারণেই জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তই আত্মসমর্পণকে ত্বরান্বিত করেছিল। নাগাসাকি বোমাবর্ষণের মাত্র এগারো ঘণ্টা আগে দেড় মিলিয়ন সোভিয়েত সৈন্য উত্তর চীন হয়ে জাপানের পাপেট স্টেট নামে খ্যাত মাঞ্চুরিয়ায় প্রবেশ করে। এরপর তারা রণক্লান্ত জাপানী সৈন্যদের তিনদিক দিয়ে আক্রমণ করে। আমেরিকা সোভিয়েতের আক্রমণ আশা করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের বিষয়টি সোভিয়েত আক্রমণের ওপর নির্ভর করেনি। এটি ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের বিশেষ নির্দেশে। তার নির্দেশনায় আগস্টের ৮ তারিখেই দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমাটি সর্ম্পূণরূপে প্রস্তুত করা হয়েছিল। পরের দিন সকালে নাগাসাকি বোম্বিংয়ের ঠিক মিনিটত্রিশেক আগে জাপানের সুপ্রীম ওয়ার কাউন্সিল আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছিল। স্ট্যালিনের যুদ্ধ ঘোষণায় আত্মসমর্পণের জন্য অনুকূল শর্তাবলীতে সোভিয়েতের সাহায্যের সর্বশেষ আশাটিও শেষ হয়ে যায়। কাউন্সিলের সদস্যরা অতিসত্বর আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিল। প্রচ- খাদ্যাভাব দেখা দেয়ায় জাপানী সৈন্যদের জন্য তা সরবরাহ করতে না পারা, ভয়ঙ্কর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং হিরোশিমা বোম্বিং এক্ষেত্রে মূল কারণ হিসেবে দেখা দেয়। সম্রাট হিরোহিতোর যুদ্ধপরবর্তী সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সৈনিকরা মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে রাজি ছিল। যখন নাগাসাকি আক্রমণের খবর এসে পৌঁছায়, তখন এর পুনরুল্লেখ না করেই আলোচনা চলছিল। ওই রাতেই হিরোহিতো অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে আত্মসমর্পণের অনুমোদন করেন। আমেরিকায় প্রথম থেকেই নাগাসাকির ঘটনাটি হিরোশিমা ঘটনার আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। যখন প্রথম পারমাণবিক বোমা খবরের শিরোনামে থাকে, তখন নাগাসাকির সংবাদ সোভিয়েতদের অগ্রসরমানতার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছিল। আগস্টের ৯ তারিখ বিকেল বেলায় রেডিও ঘোষণায় ট্রুম্যান যুদ্ধপরবর্তী ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর দিকনির্দেশনা দিলেন। তিনি তার ভাষণে হিরোশিমা বোমা বিস্ফোরণের কথা মাত্র একবারই উচ্চারণ করেছিলেন; কিন্তু নাগাসাকির কথা একবারও উচ্চারণ করেননি। নাগাসাকির প্রায় চুয়াত্তর হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা বোমা বিস্ফোরণের পাঁচ মাসের মধ্যে নিহত হয়। এর মধ্যে কেবল দেড় শ’ ছিল সামরিক ব্যক্তি। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল পঁচাত্তর হাজার। এছাড়া রেডিয়েশনের প্রভাবে দশকের পর দশক ধরে কত সংখ্যক মানুষ অসুস্থ কিংবা মারা গেছে, তা অগণিত। প্রাথমিকভাবে তাদের শরীরে রক্তবর্ণ দাগ দেখা দিত। পড়ে যেতে থাকে তাদের চুল। এরপর মারাত্মক জ্বরে ভুগতে থাকে তারা। একটা সময় ইনফেকশন ঘটত পুরো শরীরে এবং আক্রান্ত হতো ক্যান্সারে। এভাবে অসংখ্য লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সেই বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়াদের বলা হয় ‘হিবাকুসা’, যারা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন অসুস্থতা ও মৃত্যুর ভয় নিয়েই বেঁচে ছিল। আমেরিকা ইতিহাসের এই অংশটিকে রেখে দিয়েছিল নিভৃতে। ১৯৪৫ সালের পতনের পর থেকে আমেরিকার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা রেডিয়েশনের কারণে মৃত্যু নিয়ে সংবাদপত্রের প্রকাশিত রিপোর্টের বিরোধিতা করে আসছে। বছরের পর বছর ধরে কর্তৃপক্ষ এ আক্রমণ সংক্রান্ত সংবাদ, ফটোগ্রাফ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ব্যক্তিক সাক্ষ্যর বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আসছে। এই বোমা নিক্ষেপের বিষয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে আমেরিকার নেতারা জনগণকে বলতে থাকে এই বোমা না ফেললে যুদ্ধ শেষ হতো না। এই বোমার কারণেই রক্ষা পেয়েছে দশ লাখ আমেরিকানের জীবন। এই বক্তব্য অধিকাংশ আমেরিকান মেনে নেয়। ফলে কমে যায় সমালোচনা। খুব অল্প সংখ্যক আমেরিকানই আছে যারা নাগাসাকি সম্পর্কে ভাল জানে। পনেরো শতকের পর থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছিল। এ শহরটিকে ঘিরেই আধুনিকতার গোড়াপত্তন ঘটে এবং শহরটি ছিল ক্যাথলিক মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের প্রধান কেন্দ্র। ১৬১৪ সালে জাপান অফিসিয়ালি খ্রিস্টধর্ম নিষিদ্ধ করে। এরপর ১৬৩০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারত না। কেবল নাগাসাকিতে সীমিত পরিমাণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংঘটনের অনুমতি ছিল। ফলে এই শহরে বেড়ে ওঠা মানুষজন এশিয়া ও ইউরোপের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পেরেছিল। জাপান যখন পশ্চিমাদের সঙ্গে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করে, তখন নাগাসাকি সমৃদ্ধ এক শহরে পরিণত হয়। শহরটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ শহর হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। যেসব খ্রীস্টান দীর্ঘদিন তাদের বিশ্বাসকে লুকিয়ে রেখেছিল, তা আবারও জেগে ওঠে তাদের মাঝে। নাগাসাকিতে গড়ে ওঠে পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাথলিক চার্চ। প্রায় দশ হাজারের মতো ক্যাথলিক ১৯৪৫ সালের বোম্বিংয়ে মারা গিয়েছিল। ষোলো বছরের সুমিতেরু তানিগুছি তার বাইসাইকেলে চড়ে শহরের উত্তর-পশ্চিম কোণে চিঠি বিলি করতে যাচ্ছিল। এমন সময় আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে সে ছিটকে পড়ে মাইলখানেক দূরে। বোমার তাপে তার গায়ের শার্টই শুধু ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়নি, হারিয়ে যায় তার একটি হাত। ঝলসে যায় পুরো শরীর। তিন মাস পর তাকে শহরের উত্তর দিকে বাইশ মাইল দূরের নৌবাহিনীর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিন বছরের বেশি সময় তাকে শুয়ে থেকে এমন শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল যে, নার্সদের সে বার বার অনুরোধ করত তাকে মেরে ফেলার জন্য। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সে বসতে, দাঁড়াতে এমনকি হাঁটতেও সক্ষম হয়। তানিগুছি যখনই নিজের সেই যন্ত্রণাকাতর সময়কে মনে করে, তখনই রেগে ফেটে পড়ে সেই বোমা বিস্ফোরণের বিপক্ষে। অযথাই বোমা নিক্ষেপ করে তার শহর এবং এর লোকজনকে ধ্বংস করার জন্যই তানিগুছির এই রাগ। বিগত সত্তর বছর ধরে তানিগুছি এবং তার মতো আরও দশ হাজারের মতো হিবাকুসা রোগে শোকে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। রেডিয়েশন সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে দিন পার করছে মৃত্যু ভয়কে আঁকড়ে। এমনকি তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিরা জেনেটিকভাবে এ সমস্যাগুলো ভোগ করছে। অনেকেই কখনও সেই ভয়াবহ পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ এবং ভয়াবহতার চাক্ষুস অভিজ্ঞতার কথা কখনই বলেনি, এমনকি নিজের পরিবারের মাঝেও আলোচনা করেনি। কারণ বেদনাদীর্ন সেই দুঃসহ স্মৃতিকে তারা ভুলে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। দীর্ঘ নীরবতার পর তানিগুছি এবং তার মতো আরও কয়েকজন হিবাকুসায় অল্পবিস্তর তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলা শুরু করে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে। জাপানীরা কী রকম ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হলো কিংবা পার্ল হারবারের আক্রমণের ভয়াবহতাকে মলিন করার জন্য অথবা জাপানী সৈন্যরা যেভাবে মিত্রপক্ষের মানুষদের মেরেছে তার চেয়েও এই আক্রমণ ভয়াবহÑ এমনটা তুলে ধরার জন্য তারা তাদের সেই দুঃসহ স্মৃতিগল্প বলেনি। তারা সেই দুঃসহ যন্ত্রণাকাতর স্মৃতিগুলো বলেছিল পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরার জন্য। সারাবিশ্বকে পারমাণবিক বোমার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরার জন্যই তারা তাদের সেই দুঃস্বপ্নময় স্মৃতিগুলো জনসমক্ষে বলেছিল। অফিসিয়াল বক্তব্যই দীর্ঘকাল ধরে আমেরিকানরা বিশ্বাস করত। এটা হয়ে উঠেছিল অধিকাংশ আমেরিকানেরই বক্তব্য। নাগাসাকি স্মৃতিতে মলিন। এটা আমাদের উচিত নয়। সেই ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে বেঁচে যাওয়াদের অভিজ্ঞতা আমাদের বুঝতে হবে। কেবল তারাই বলতে পারে, এটি কেমন ভয়াবহ ছিল এবং কিভাবে তাদের জীবনকে বিপন্ন, দুঃসহ করে তুলেছিল। অনুবাদ : আরিফুর সবুজ সুসান সাউদার্ড : ‘নাগাসাকি লাইফ আফটার নিউক্লিয়ার ওয়ার’-বইয়ের লেখক। সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস
×