ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু

পল্লী জনপদ- এক টুকরো শহরে বহুতল ফ্ল্যাট, থাকবে গ্রামের মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৮ আগস্ট ২০১৫

পল্লী জনপদ- এক টুকরো শহরে বহুতল ফ্ল্যাট, থাকবে গ্রামের মানুষ

সমুদ্র হক ॥ মোটেও স্বপ্ন নয়। নিভৃত গ্রামের মানুষ থাকবে শহরের মতোই বহুতল ফ্ল্যাট বাড়িতে। যেখানে থাকবে গ্যাস ও বিদ্যুত। ফ্ল্যাট কিনতে বেশি অর্থেরও দরকার নেই। সাধ্যের মধ্যে খুব কম ডাউন পেমেন্টে ঘরে ওঠা যাবে। তারপর কিস্তির অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেবে ফ্ল্যাট বরাদ্দের সরকারী কর্তৃপক্ষ। এই পর্যন্ত পাঠ করে কেউ অবাস্তব মনে করতে পারেন। তবে এটাই এখন বাস্তব। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে ৭ বিভাগের একটি করে গ্রামে। আগামী বছরেই ফ্ল্যাট নির্মিত হয়ে প্রতিটি চারতলা ভবনে ২শ’৭২টি করে পরিবার আশ্রয় পাবে। পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে দেয়া হবে। বহুতল ভবনে চার ধরনের ফ্ল্যাট থাকবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটেই বেডরুম, ড্রইংরুম, রান্নাঘর খাওয়ার স্পেস ও এ্যাটাচ্ড বাথরুম সুবিধা আছে। প্রথমে কাজ শুরু হয়েছে ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর উপজেলার জলিরপাড়া গ্রামে। সেখানে ৩ দশমিক ৭৫ একর খাস ভূমির ওপর নির্মিত হচ্ছে এমন ফ্ল্যাট ভবন। এভাবে সিলেট বিভাগের দক্ষিণ সুরমা, খুলনা বিভাগের রূপসা বাটিয়াঘাটা, রংপুরের সদরের নিয়ামতপুর, বগুড়ায় শাজাহানপুর উপজেলার জামালপুরে। প্রতিটি স্থানে জমি কেনা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে শীঘ্রই জমি কেনা হবে। প্রতিটি গ্রামে একই পরিমাণ জমিতে ভবন নির্মিত হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) মাধ্যমে। অধিক জনসংখ্যার চাপে পরিবারের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে বসত বাড়ি নির্মাণে দিনে দিনে দেশের আবাদী জমি কমে যাওয়া ঠেকানো রোধে বগুড়া আরডিএর গবেষণায় উদ্ভাবিত এই পরিকল্পনাটি এসেছে। গ্রামের মানুষকে রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়ে স্বল্প খরচে বহুতল ভবনে আবাসনের ব্যবস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনার পর একনেক বৈঠকে উপস্থাপিত হলে গত বছর তা পাস হয়ে বরাদ্দ মেলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এই প্রকল্পটির নাম দেন ‘পল্লী জনপদ’। এমনটি জানিয়ে বগুড়া আরডিএর মহাপরিচালক এম এ মতিন ও প্রকল্পের পরিচালক মাহমুদ হোসেন খান জানালেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেন সফরকালে সেখানে এমন ব্যবস্থা দেখে বাংলাদেশে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আবাদি জমি রক্ষা করে অধিক মানুষের মুখে আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বাস্তবায়নকারী সরকারী প্রতিষ্ঠানকে হোঁচটও খেতে হচ্ছে। বগুড়ায় এই অবকাঠামো স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি কিনতে গেলে একটি শ্রেণী বাদ সেধে সরকারের ভাল উদ্যোগকে ভ-ুল করতে চাচ্ছে। তবে গ্রামের লোক যখন বুঝতে পারছে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এতসব হচ্ছে এবং জায়গা বিক্রি করার পরও তারা ফ্ল্যাটে অগ্রাধিকার পাবে তখন ভুল বুঝতে পেরেছে। বগুড়ায় এভাবে গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে জমি কেনা হয়েছে। যেখানে কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। এ বিষয়ে আরডিএর মহাপরিচালক বলেন, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ এগিয়ে চলেছে। মন্ত্রণালয় সবকিছুই অবগত। তারপরও যদি অধিক স্বচ্ছতার দরকার হয় তাহলে সরকারের কোন সংস্থাকে কাজ দেয়া হবে। যেমন সারিয়াকান্দিতে বাঁধ নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। পল্লী জনপদের এই ফ্ল্যাটের জীবনধারা হবে শহরের মতোই। হাতের কাছেই থাকবে স্কুল, বিনোদন পার্ক, কাঁচা বাজার, কমিউনিটি সেন্টার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আরডিএর মহাপরিচালক এম এ মতিন জানালেন, পল্লী জনপদ প্রকল্প গ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নসহ দারিদ্র্য বিমোচনের নানা কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আরডিএ ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রাথমিক ব্যয় ৪শ’ ২৪ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা। যার ৭০ শতাংশ দেবে সরকার ও বাকি ৩০ শতাংশ মিলবে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে। গ্রামের সুবিধাভোগীরা যাতে খুবই স্বল্প সুদে পরিশোধ করতে পারে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা করে দেবে আরডিএ। সূত্র জানায়, দেশে প্রতিনিয়ত আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। বিশ বছর আগে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৯ মিলিয়ন (৯০ লাখ) হেক্টর বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৮ মিলিয়ন হেক্টরেরও নিচে। এই ধারা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছর পর আবাদযোগ্য জমি পাওয়া কঠিন হবে। সুদূরপ্রসারী ভাবনায় আরডিএর গবেষকগণ পল্লীজনপদের নকশা করেছেন। বহুতল ফ্ল্যাটে ২শ’ ৭২ পরিবার ঠাঁই নিলে ৪৩ একর কৃষি জমি ও ১৭ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক তারের সাশ্রয় হবে। ভবনে বসবাসকারী মানুষের টয়লেট রান্নাঘর পোল্ট্রি ক্যাটেলের বর্জ্য থেকে প্রতিদিন প্রায় এক টন জৈবসার উৎপাদন হবে, যা আবাদি জমির জৈব ঘাটতি মেটাবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, কৃষি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈবসার থাকার কথা সেখানে পাওয়া যাচ্ছে এক শতাংশের কম। ফ্ল্যাটের প্রত্যেক মালিককে গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগি পালনের জন্য ৮২ বর্গফুট জায়গা বিনামূল্যে দেয়া হবে। অতিরিক্ত জায়গা চাইলে প্রতি বর্গফুট নামমূল্যে কিনতে পারবেন। ভবনে বসবাসকারী প্রত্যেক সদস্য কমিউনিটি ভিত্তিতে ৫শ’ গরু ও ১০ হাজার মুরগির খামরের অংশীদারিত্ব পাবে। ভবন সংলগ্ন ফার্ম হাউসে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট দিয়ে গ্যাস উৎপাদিত হয়ে প্রতিটি ফ্ল্যাটে গ্যাস সংযোগ যাবে এবং বিদ্যুত উৎপাদিত হবে। জেনারেটরের বিদ্যুতের পাশাপাশি সোলার প্যানেলের বিদ্যুত থাকবে। নিরাপদ পানি ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। আরডিএর সেন্টার ফর ইরিগেশন এ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট এবং পল্লী জনপদ প্রকল্পের পরিচালক মাহমুদ হোসেন খান বলেন, শহুরে জীবনের সকল সুবিধা গ্রামের মানুষ পাবে। প্রকল্পের ভেতরেই তথ্য প্রযুক্তির সকল কর্মকা- থাকবে। যাতে বিদেশে যোগাযোগ ও রেমিটেন্সের অর্থ গ্রহণের সুযোগ থাকে। গ্রামের মানুষ ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ফ্ল্যাট পাবে। বাকি অর্থ খুবই সহজ কিস্তিতে ১৫ বছরে পরিশোধ করতে পারবে। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে দেশের সার্বিক উন্নয়নের অপার দুয়ার খুলে যাবে, এমনটি মনে করছেন গবেষকগণ। আরডিএ আশাবাদী দারিদ্র্য মোচনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনে এমন আধুনিকতা নদীর চরগ্রামেও বাস্তবায়িত হবে।
×