ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ শোকাবহতার ভেতরের শক্তি ও দানবের পরাজয়

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৮ আগস্ট ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ শোকাবহতার ভেতরের শক্তি ও দানবের পরাজয়

ভারতের রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামের মৃত্যুতে আমাদের যে আকুলতা কাজকর্মে তার ছিটেফোঁটা থাকলেও আমরা অন্য ধরনের হয়ে উঠতে পারতাম। তার মতো মহতীজনরা কিভাবে সে জায়গায় পৌঁছতে পেরেছিলেন, তা নিয়ে কোন কথা নেই, আছে খালি মাতম। প্রয়াত এপিজে আবদুল কালাম যে রোজ গীতা পাঠ করতেন, তার গ্রন্থের মুখবন্ধে যে অথর্ব বেদেরুল্লেখ আছে, সেটা অনেকেই জানেন না। জানলে ভক্তিবোধে টান পড়লেও পড়তে পারত। আমি আবদুল কালামের ভক্ত। তার লেখা ও বাণী গান্ধীর পর এক নতুন জগতের নতুন আলোর মতো কাজ করে আমার ভেতর। কোনটি স্বপ্ন আর কোনটি স্বপ্ন নয়- এমন বিষয়ে তার বাণীর ওপর কথা চলে না। বলেছিলেন যা ঘুম পাড়িয়ে রাখে তা কখনই স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন হচ্ছে যা মানুষকে জাগিয়ে রাখে। এর চেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে? আমরা কি তেমন কোন মানুষ নির্মাণ বা সৃজনের কথা চিন্তায় রাখি? কিভাবে একটি দেশে একজন মানুষ সবকিছু ছাড়িয়ে কেবল জাতি ও মানুষের হয়ে ওঠেন সেটাই তো জানি না আমরা। এ লেখা যখন বেরুবে তখন আমরা শোকের মাস নামে পরিচিত আগস্টে প্রবেশ করে ফেলেছি। এই শোকাবহ মাসটি কেন বা কি কারণে শোকের- এটা যাদের অজানা নয় তাদের চেহারাটা একবার দেখুন। কোন দেশে সে দেশের জাতির জনক কিংবা তাদের পরম প্রিয় অভিভাবককে সবংশে নিধনের পর কেউ মিথ্যা জন্মদিন বানিয়ে কেক কাটতে পারে? যারা তা করে বা যারা ভাবে ভারত মানে জন্মের দুশমন ভারতের সবকিছু যাদের কাছে সাম্প্রদায়িকতা তারাই ভারতীয় দূতাবাসে লাইন দিয়ে শোক বইতে সাইন করতে যায়। এর মতো হিপোক্রেসি আর কী আছে? আবদুল কালামের মতো মানুষের জীবনবোধটাই ছিল হিপোক্রেসির বিরুদ্ধে। তাঁদের কাছে যদি দেশ ও জনগণের চাইতে ধার্মিকতার নামে বিভেদ বড় হতো রাষ্ট্র এগোতে পারত না। তিনি ছিলেন সে রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু। কিন্তু তিনি কি তা মনে রেখে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন? না সে দেশ তাকে তা বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে? খবরে যখন দেখি তিনিই ভারতের মিসাইল বা বায়ুুপথের অনন্য কারিগর, তখন আনন্দের পাশাপাশি বেদনাও কাজ করে বৈকি। আমরা কোনদিনও নিজেদের বিশ্বাস করতে শিখলাম না। সে কবে আমাদের ভেতর সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ ঢুকিয়ে ব্রিটিশ চলে গেছে, পাকিরা পরাজিত হয়েছে কিন্তু আমরা এক হতে পারিনি। এর সামাজিক ব্যাখ্যা যাই হোক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা খুব সহজ। আমাদের দেশের রাজনীতি কখনই অসাম্প্রদায়িকতা আর তার মূল্যায়নে আগ্রহী ছিল না। তাদের প্রয়োজনে ভোটের তাগিদে এর ব্যাখ্যা একেক সময় একেক রকম হয়ে গেছে। আজ সে চেহারা বিকৃত আর অন্য এক আদলে সারাদেশ এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও ছাড় দিচ্ছে না। যে কোন আড্ডা বা যে কোন সামাজিক পরিবেশে তা এখন দিনের মতো পরিষ্কার। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধ বা সামাজিক সাম্য ইত্যাদি বলেন বা এসব বিষয়ে সচেতন থাকেন তো মনে হবে আপনিই রাজাকার। মৌলবাদের এমন দাপট আগে কখনও দেখিনি। একটা পরিবর্তন অবশ্যই চোখে পড়ার মতো- এখনকার মৌলবাদ ধুরন্ধর। আগের মতো সর্বগ্রাসী ভূমিকায় নেই আর। তার আবরণে আচরণে এখন এক ধরনের ভাব আছে। সে সংস্কৃতি বা আনন্দের ব্যাপারে নীরব যতটুকু তার প্রয়োজন বা তার দরকার ততটুকুর জন্য মরিয়া, তারপর অন্যের ব্যাপারে আগ্রাসী। আগে ছিল সরলতা। যে যা বিশ্বাস করতেন অন্তরে রাখতেন। আচরণে ছিল পরিমিতিবোধ। এখন ঠিক তার উল্টো। এমন সমাজে আবদুল কালামের মতো মানুষ জন্মাবে কি করে? অবরুদ্ধ দেশে এখন মুখ খোলাও অনিরাপদ। ব্লগার নামের লেখকরা খুন হন, রাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, আগুনে যানবাহন মানুষ পোড়ানো হয়; তার পরও আমাদের সম্বিত ফেরে না। যেখানে যাই খালি আওয়ামী লীগ ও ভারত জড়িয়ে মুখরোচক গল্প। এ গল্প আমরা ’৭৫ সালেও শুনেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার আগের দিন পর্যন্ত শুনে শুনে বোকা বনে গেছি। যেই কাজ শেষ তারপর মানুষগুলো ভারতের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার পরও আর কোন উচ্চবাচ্য নেই। সে রাজনীতি কিছুকাল থমকে থাকলেও এখন আবার তার আসল চেহারা নিয়ে বেরুতে চাইছে। সাকা চৌধুরীর শাস্তি মানে মৃত্যুদ-াদেশ বহাল থাকায় প্রবাসেও আনন্দের ধারা বয়ে গিয়েছে। আমরা সবসময় চট্টগ্রাম নিয়ে গর্বিত। এমন অনুপম নিসর্গ ও দিলখোলা মানুষের জায়গা খুব বেশি নেই। ভাষা যত খিটমিটে মানুষের অন্তর বা আচরণ ততটা না। কড়া করে কথা বললেও ভেতরে নরম। দুর্ভাগ্য আমাদের এই চট্টগ্রামের ভেজাল সন্তানের নাম সাকা চৌধুরী। জীবনে কখনও মিষ্টি ভাষায় যুক্তি দিয়ে কথা বলেনি। এই যে তার ফাঁসির আদেশ বহাল থাকল তার পরও বলছেন তিনি নাকি ফালতু কেউ নন। অবশ্য ফালতু লোকেরাই তা বলে থাকে। সত্যিকার ফালতু না হলে তার জন্য মানুষই কথা বলবে। নিজের ঢাক পেটানোর দরকার পড়ে না তখন। এই সাকা চৌধুরী যে কতবড় মিথ্যুক তা তার জিভও জানে। আদেশ শোনার পর আমার চোখের সামনে শহীদ নূতন সিংয়ের ছবি ভাসছিল। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি আমার মেজদি ও বাবার সঙ্গে কু-েশ্বরী গিয়েছিলাম। দিদি তখন সবে মাস্টার্স শেষ করেছে; চাকরির ইন্টারভিউ ছিল সেখানে। ধুতি-পাঞ্জাবি আর রাশভারি চেহারার নূতন সিংকে কেউ খুন করতে পারে- এটা ভাবাও ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সাকা নিজ হাতে তাই করেছিল। আদেশের পর মনে পড়ছিল খুরশীদ ভাইয়ের কথা। সত্তরের তেজি আধুনিক কবি। আমার অগ্রজ বললে ভুল হবে, বলব আমার ভাই, দাদা। সিডনি আসার আগের দিন অবধি আমরা ছিলাম একসূত্রে গাঁথা। তারও বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তার বাবা ও ভাইকে হত্যা করেছে এই সাকা চৌধুরী। খুরশীদ ভাই ছিলেন জেলে। স্বাধীনতার কারণে সৌভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন। এতকিছুর পরও একজন মানুষ কিভাবে বলে সে নিরাপরাধ? ব্যঙ্গ তাচ্ছিল্য আর খুনের আসামি যুদ্ধাপরাধী সাকার আদেশে তাই আমরা আনন্দিত। সাকার আসল চেহারা তুলে ধরা এই কবিতাটি পাঠ করলে আমরা জানব কতবড় শয়তান ছিল এই মানুষরূপী হায়েনা। মহামান্য আদালতের প্রতি বাঙালীর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সরকারকেও জানাই ধন্যবাদ। জয় হোক বাঙালীর। [email protected]
×