মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নানামুখী জালিয়াতির মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক ও ক্যাডেটদের ভুয়া সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) ইস্যু ছাড়াও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব লোপাটের সঙ্গে জড়িত চট্টগ্রামের সরকারী শিপিং অফিসের শিপিং মাস্টারসহ ৬ জনকে অবশেষে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। শিপিং মাস্টার শামীম আহমেদকে ডিজি শিপিং অফিসের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৩ জনকে বদলি করা হয়েছে খুলনা শিপিং অফিসে ও একজনকে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম নাবিক হোস্টেলে। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে আসা শেখ আলী আম্বিয়া নতুন শিপিং মাস্টার হিসেবে যোগদান করেছেন।
উল্লেখ্য, গত ৩০ মে দৈনিক জনকণ্ঠে ‘দুর্নীতি জেঁকে বসেছে শিপিং দফতরে ॥ সাত খাতে অনিয়ম, রাজস্ব ফাঁকি’ শিরোনামে জালিয়াতি ও দুর্নীতি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ডিজি শিপিং অফিস এর তদন্তে নামে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সরকারী এ শিপিং অফিসের দুর্নীতিবাজ চক্রটি তদন্ত কমিটিকে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের শিপিং অফিসে ঢুকতেই দেয়নি। ওই তদন্ত কমিটি পরে ঢাকায় গিয়ে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট তুলে ধরার পর গত ৩০ জুলাই ডিজি শিপিং অফিস থেকে এই ৬ জনকে সরিয়ে নেয়ার আদেশ জারি হয়। কিন্তু এরপরও অভিযুক্তরা বদলিকৃত স্থানে যোগ না দিয়ে নানা তদবির চালায়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গত ৪ আগস্ট ডিজি শিপিং অফিস থেকে এ সংক্রান্তে আবারও জরুরী নির্দেশনা প্রদানের পর ওইদিনই তা কার্যকর হয়। অভিযুক্ত শিপিং মাস্টার শামীম আহমেদসহ ৬ জন তাদের কর্মস্থল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
উল্লেখ্য, জনকণ্ঠে প্রকাশিত ওই রিপোর্টের পর সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর তড়িঘড়ি করে এ সংক্রান্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন ফয়সল আজিমকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অপর দু’সদস্য হলেনÑ সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের ফাওজিয়া রহমান ও জসিম উদ্দিন পাটোয়ারি। তদন্তের জন্য চট্টগ্রামে আসার পর তাদেরকে কোন ধরনের তদন্ত কাজে সহায়তা না করায় তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। সরকারী এ শিপিং অফিসে সাত খাতে যে ব্যাপক অনিয়ম ও জালজালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে রয়েছে শত শত ভুয়া সিডিসি ইস্যু, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভুয়া নাবিক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়া, অবসরপ্রাপ্ত নেভাল রেটিংদের সিডিসি প্রদান ও ভুয়া সার্টিফিকেট বাবদ জনপ্রতি ১ লাখ ২০ হাজার করে উৎকোচ গ্রহণ করা, জাহাজে কর্মরত নাবিকদের বিভিন্ন খাতে জমাকৃত ২০ লাখ টাকা দীর্ঘ দুই বছর এফডিআর করে তা সাধারণ এ্যাকাউন্টে রেখে সুদ বাবদ প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি সাধন করা, বিদেশী সিডিসিধারীদের বাংলাদেশী সিডিসি ইস্যুতে ন্যূনতম ১ লাখ টাকা হারে উৎকোচ গ্রহণ করে শিপিং অফিসের কর্তারা প্রায় ১২০টি অনুরূপ সিডিসি গ্রহণ করার ঘটনা। এছাড়াও মেরিন একাডেমিসহ অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা নাবিক প্রতি ২০ হাজার থেকে একলাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া সীম্যান আইডিধারীদের সমুদ্রগামী জাহাজে না ওঠার নির্দেশ সত্ত্বেও অনুরূপ আইডিধারীদের কাছ থেকে ন্যূনতম ২ লাখ টাকার বিনিময়ে শিপিং অফিস কর্মকর্তার মনোনিত ৫টি ম্যানিং এজেন্টের মাধ্যমে জাহাজে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করা। যাতে সরকার বছরে ১০ লাখ টাকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি প্রকৃত নাবিকরা জাহাজে ওঠার সুযোগ হারিয়েছে এবং বর্তমানেও হারাচ্ছে।
ক্যাডেট ও অফিসারদের ভয়েজ এন্ডোর্সমেন্ট করার প্রক্রিয়ায় জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করে এ পর্যন্ত অনুরূপ যে এন্ডোর্সমেন্ট প্রদান করা হয়েছে, তাতে সরকার হারিয়েছে ৭ লাখ টাকার রাজস্ব।
ভুয়া সিডিসিধারী নাবিকদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের জন্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে সরকারী প্যাড ব্যবহার করে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে এ অফিসের কর্তারা অবৈধভাবে জনপ্রতি প্রায় ৩ লাখ টাকা করে আয় করেছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ ভুয়া সিডিসিধারীদের অনুরূপ ক্লিয়ারেন্স দিয়ে প্রকৃত সিডিসিধারীদের চাকরির বাজার নষ্ট করা হয়েছে, যা বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হয়েছে।