স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় জাতির কাছে সরকারের ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে বারোটায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ শিশু ও তার মাকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। এদিকে শিশুটি মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে পারছে। শিশুটির অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। মাও সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে।
সারাদেশে একের পর এক শিশু নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে দোষীদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন এরশাদ। তিনি বলেন, এসব দেখে অবাক হয়ে যাই, মানুষ কত বর্বর হতে পারে। মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ, এটা কিভাবে সম্ভব! এই ঘটনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ২৩ জুলাই বিকেলে মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ায় সাবেক ছাত্রলীগকর্মী কামরুল ভূঁইয়ার সঙ্গে সাবেক যুবলীগকর্মী মহম্মদ আলী ও আজিবরের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় কামরুলের বড় ভাই বাচ্চু ভূঁইয়ার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজমা বেগম (৩০) ও প্রতিবেশী মিরাজ হোসেন গুলিবিদ্ধ হন, নিহত হন কামরুলের চাচা আব্দুল মোমিন ভূঁইয়া।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই রাতেই মাগুরায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নাজমার গুলিবিদ্ধ শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়। দু’দিন পর তাকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যালে। বর্তমানে মা ও শিশু দু’জনই অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
এরশাদ বলেন, এত গেল একটা ঘটনা। পত্রপত্রিকা খুললেই শিশু নির্যাতনের খবর দেখা যায়। গত তিন বছরে সারাদেশে ৭৬৭টি শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কেন এসব হচ্ছে? কারণ যারা করছে তারা জানে তাদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। আমার আবেদন, এদের কঠোর শাস্তি দিন, ফাঁসি দিন, দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিন। অপরাধীদের উপযুক্ত বিচার না হওয়ার কারণেই বার বার শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বলেও মনে করেন তিনি।
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ বলেন, কারা এসব করছে তা আমরা জানি। যদি সুবিচার হতো তাহলে এর প্রকোপ অনেক কমে যেত। তবে আমার মনে হয় না এরকম (সুবিচার) কিছু হবে। এই বিচারহীনতার জন্য দায়ী কে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, বিচারহীনতার জন্য দায়ী সমাজ। এই সমাজ এ রকম ছিল না। আমরা কখনও নিষ্ঠুর ছিলাম না। সমাজে পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন আনতে পারে জাতীয় পার্টি।
তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলী কম দেখা যাচ্ছে। মানবিকতার স্তরগুলো দিন দিন কেমন যেন লোপ পেতে চলেছে। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরী। কারণ মানবতাবোধ না থাকলে সমাজ টিকে থাকবে না। শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অপরাধ করলে বিচার হয় এমন দৃষ্টান্ত বার বার স্থাপন করতে হবে। তা না হলে এসব জঘন্যতম অপরাধে মানুষ উৎসাহিত হবে। কোন অবস্থাতেই অপরাধীদের ছাড় দেয়া যাবে না।
মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশু ও গুলিবিদ্ধ মাকে সুস্থ করায় ঢামেক হাসপাতালের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের তিনি ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ শিশু ও মাকে সুস্থ করতে চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালে এরশাদের সঙ্গে ছিলেনÑ পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, যুগ্মমহাসচিব এ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, শাহ আলম তালুকদার, নূরুল ইসলাম নূরু, মনিরুল ইসলাম মিলন, সবুজ দে, ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান প্রমুখ।
সুরাইয়ার হৃদপি-ে ছিদ্র ॥ গুলিবিদ্ধের পরই মায়ের গর্ভ থেকে সুরাইয়া দুনিয়ার নিঃশ্বাস নেয়। অসময়ে জন্ম নেয়া কচি দেহ কাটাছেঁড়া; সুঁই দিয়ে স্যালাইন, নল দিয়ে নাকের মাধ্যমে মায়ের দুধ গ্রহণ, রক্ত গ্রহণ; পাশাপাশি জন্ডিসও মোকাবেলা করেছে। এরই মধ্যে ধরা পড়ল তার হƒদপি-ে ছিদ্র। যদিও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে হƒদপি-ে ছিদ্র থাকার কোন সম্পর্ক নেই। দুর্ভাগ্যবশত সুরাইয়া জন্মগতভাবে হƒদরোগে আক্রান্ত। চিকিৎসকরা জানান, ভর্তির সময় নবজাতকের বয়স খুবই কম থাকায় (মাত্র তিন দিন) সমস্যাটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। যখন তার বয়স ১০ দিন তখন তার হƒদপি-ে ছিদ্র থাকার ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত হন। যখনই তার হƒদস্পন্দন পরীক্ষা করা হতো, তখনই অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যেত বলে জানান চিকিৎসকরা। ঢামেক হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ কানিজ হাসিনা শিউলী জানান, হƒদপি-ে ছিদ্র থাকার বিষয়টি নিয়ে তারা গত বুধবার পর্যন্ত খুবই চিন্তিত থাকলেও বৃহস্পতিবার থেকে খুব একটা চিন্তিত নন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছিদ্র এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে বলে তাদের আশা। বৃহস্পতিবার সেই অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যায়নি বলে জানান তিনি। চিকিৎসকরা জানান, সুরাইয়ার শারীরিক অবস্থার আরও উন্নতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি এতদিন তার শরীরে যে স্যালাইন দেয়া হচ্ছিল বৃহস্পতিবার তা খুলে ফেলা হয়েছে। এদিন থেকে তাকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হবে।
গুলিবিদ্ধ নবজাতক সুরাইয়া আক্তার মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ও বিকেলে দু’বার মায়ের বুকের দুধ টেনে খেয়েছে শিশুটি। বৃহস্পতিবার শিশুটির মা নাজমা বেগম জানান, তিনি দুপুরের দিকে একবার ও বিকেলে একবার সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। ২-৩ মিনিট টানার পর কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। এটি অনেক আনন্দের-সুখের। কেবল মা-ই এটি অনুভব করতে পারে। শিশুটির উন্নত চিকিৎসায় গঠিত ১০ সদস্যবিশিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ও এনআইসিইউ-নবজাতক ওয়ার্ড নিওনেটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডাঃ আবিদ হোসেন মোল্লা বৃহস্পতিবার জানান, শিশুটি মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে পারছে, এটা খুবই ভাল দিক। এ সময় মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, শিশুটির উন্নতি হচ্ছে, মাও সুস্থ হয়ে উঠছেন। শিশুটিকে আরও কয়েকদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করা হবে বলেও তিনি জানান। শিশুটির বাবা বাচ্চু ভূঁইয়া জানান, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পেরে তার স্ত্রী অনেক খুশি। সারাক্ষণ অস্থির থাকেন কখন আইসিইউর ভেতরে গিয়ে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার তার স্ত্রীর জন্য তৃতীয় তলায় একটি কেবিন বরাদ্দ হয়েছে। কাল (শুক্রবার) কেবিনে উঠবেন তার স্ত্রী। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২৩ জুলাই মাগুরা জেলা শহরের দোয়ারপাড়ার কারিগরপাড়ায় ছাত্রলীগর দু’পক্ষের সংঘর্ষের সময় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নাজমা খাতুন গুলিবিদ্ধ হন। রাতেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন নাজমা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে মেয়ে ও কয়েকদিন পর মা নাজমাকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ১৬ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুমনসহ কয়েক আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: