ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব অর্থনীতির বিপদ আমাদেরও বিপদ

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৭ আগস্ট ২০১৫

বিশ্ব অর্থনীতির বিপদ আমাদেরও বিপদ

রোজার আগে মাত্র একদিনের জন্য সিলেটের শ্রীমঙ্গলে যাই জীপে। যাত্রার দিন ভোরবেলা থেকে প্রবল বৃষ্টি, এমন বৃষ্টি যে, সেদিন ঢাকা শহর জলের তলে ডুবে যায়। শান্তিনগর থেকে জল ঠেলে এবং ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে হানিফ ফ্লাইওভার যেতে লেগে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা। শ্রীমঙ্গলে গিয়েও বিপত্তি। সেখানে আরও বৃষ্টি। ফেরার পর থেকে আজ অবধি আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টির আর বিরতি নেই। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি কখনও অঝোরে, কখনও ঝিরঝির বৃষ্টি। এরই মধ্যে হয়ে গেল ঈদ এবং পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা, যা ঐতিহাসিকভাবে ছিল বৌদ্ধদের উৎসব। খবরের কাগজে কত ছবি এই বৃষ্টির, তার অনুষঙ্গ বৃষ্টিজাত বন্যা। দীর্ঘায়িত বন্যার ছবি দেখে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ছেলে-বুড়োরা বৃষ্টির জলে, বন্যার জলে মাছ ধরছে, গ্রামবাসী ভেলায় মালপত্র সরিয়ে অন্যত্র যাচ্ছে। লোকজন রাস্তায় অস্থায়ী আস্তানা পেতেছে। সেই যেন পুরনো ছবি। সবচেয়ে ভাল লাগে আমার মাছ ধরার দৃশ্য। কিন্তু আমার ভাল লাগলে কী হবে, খবর তো পরে দেখছি খারাপ। বৃষ্টিজাত বন্যায় কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, বরিশাল, খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকদের ভারি ক্ষতি হয়েছে। আউশ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এখন আউশ ঘরে তোলার সময়। পাশাপাশি আমনের প্রস্তুতির সময়। এ সময়ে গ্রামের কৃষকরা বীজতলা তৈরি করে, বীজতলা যতœ করে ধানের চারা বড় করে। অথচ বন্যার জলে বীজতলা তলিয়ে গেছে। ক্ষেতের ধান জলে ভেসেছে। যাদের মাছের চাষ আছে তাদের মাছের ক্ষতি হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই ক্ষতির হিসাব কার কাছে আছে? গড়ের হিসাব হয়ত কৃষি মন্ত্রণালয় দেবে; কিন্তু কত গরিব ও মাঝারি কৃষককে যে এই প্রলম্বিত বন্যা ও বৃষ্টি নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে তার হিসাব কে দেবে? যত জায়গায় ভেঙ্গেছে বেড়িবাঁধ, কত জায়গায় ডুবেছে সড়ক, জনপদ তার হিসাবইবা কোথায়? কত বাড়িঘর বন্যার জলে তলিয়ে গেছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, এবার মৌসুমী বন্যা মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তানের কৃষিরও প্রচুর ক্ষতি করেছে। খবরের কাগজে এসবের রিপোর্ট প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। এই যখন বন্যা, বৃষ্টি ও কৃষির খবর তখন অর্থনীতির সার্বিক খবরও খুব বেশি আরামদায়ক নয়। রেমিটেন্স ও রফতানি আমাদের অর্থনীতির বড় দুটো স্তম্ভ। এই দুটো ক্ষেত্রে খবর বেশি আশাপ্রদ নয়। রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে দেখা যায় তা ক্রমশই নিম্নমুখী। একটি দৈনিকের খবরে দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালে মোট রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৪২৭ কোটি ডলার। ২০১৩ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৩৮৩ কোটি ডলার। সেই স্থলে ২০১৪ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৩৭১ কোটি ডলার। মাসভিত্তিক হিসাবে ওঠানামা আছে; কিন্তু সার্বিক খবর আশাপ্রদ নয়। এদিকে রফতানির খবরও সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ৩০১৭ কোটি ডলার। সেই স্থলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩১১৯ কোটি ডলারে। বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র তিন দশমিক ৩৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রফতানির আয় কম হওয়ার কারণে সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য নিচু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। রফতানি বাজারের আরেক সমস্যা হলো বাজার সীমাবদ্ধতা। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে চার-পাঁচটি দেশেই আমাদের রফতানি সবচেয়ে বেশি। এ দেশগুলো হচ্ছেÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ফ্রান্স। এদিকে দেখা যাচ্ছে রফতানি বৃদ্ধি কম হলেও আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি এবং তা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য কম হওয়া সত্ত্বেও। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রফতানি বেড়েছে তিন দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর বিপরীতে আমদানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ কারণে আমাদের ‘ব্যালেন্স অব ট্রেড’ আরও প্রতিকূল হচ্ছে দিন দিন। সরকারের ঋণ প্রথম মাসেই বেশ পরিমাণে বেড়েছে। অবশ্য প্রতিবছরই বাজেট শুরুর আগে সরকারের ঋণ বাড়ে, পরে ধীরে ধীরে তা কমে। এবার সরকার ঋণ করছে ব্যাংক থেকে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি সরকার নিরুৎসাহিত করেছে। একটি কাগজে দেখলাম ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৬ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৯ ভাগ। এই দৃষ্টিতে সরকারের ঋণের পরিমাণ মারাত্মক কিছু নয়। ত্রিশ শতাংশের মধ্যে থাকলেই তা সহনীয়। সেই তুলনায় কিছুটা বেশি। কিন্তু সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে বিদেশী ঋণ পেতে আগ্রহী বলে খবর ছাপা হচ্ছে। চীন, জাপান ও ভারত থেকে সরকার ঋণ প্রস্তাব পাচ্ছে। এর মধ্যে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট আছে। এসবের শর্ত নিয়ে নানা কথা আছে। তার চেয়ে বড় কথা ঋণের মাত্রা। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছে, সরকারের বড় ধরনের বিদেশী ঋণ বাংলাদেশের ঋণ ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অবশ্য ঋণ যদি ভালভাবে ব্যবহার করে ঋণের টাকা পরিশোধের ক্ষমতা অর্জন করা যায় তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু দেখি না। উপরে বর্ণিত চিত্র নতুন অর্থবছর শুরুর চিত্র। ফসলের ক্ষতি হয়েছে, আমনের ফসল বিলম্বিত হবে। রফতানি আশানুরূপ বাড়ছে না, বাড়ছে না আশানুরূপ রেমিটেন্স। সরকারের ব্যাংক ঋণ এক মাসেই অনেক বেড়েছে। রাজস্ব যদি টার্গেট অনুযায়ী না বাড়ে আর নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। আমদানি বাড়ছে বেশি হারে, রফতানি বাড়ছে কম হারে। ফলে ‘ট্রেড ডেফিসিট’ ক্রমবর্ধমান। এই চিত্রের বাইরে বিশ্ব অর্থনীতির খবর কী? সেখানকার খবরও সবিশেষ ভাল নয়। একদিনের কাগজেই দেখতে পাচ্ছি কয়েকটি খবর। খবরগুলো চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির। চীনা অর্থনীতি একটা সংশয়ের মধ্যে আছে। জুলাই মাসে চীনে ম্যানুফেকচারিং খাতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। মনে রাখতে হবে চীন হচ্ছে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সেই অর্থনীতিতে শুধু ম্যানুফেকচারিং শিল্পই ভুগছে না। চীনা স্টক এক্সচেঞ্জে চলছে এক অস্থিতিশীলতা। ইতোমধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের ‘মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন’ হ্রাস পেয়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। চীনের কারখানাগুলো বিদেশী ক্রেতার কাছ থেকে ক্রয়াদেশ আগের মতো পাচ্ছে না। চীনের বাজার সঙ্কুচিত হওয়ায় সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। চীনের অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭-৮ মাসের মধ্যে ‘ব্যাংক রেট’ কমিয়েছে মোট চারবার। মোটকথা, চীনের দুর্বল জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। চীন যেমন অনেকের জন্য বড় বাজার, তেমনি চীন বিশ্বের প্রথম কাতারের রফতানিকারক। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই। চীন হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ট্রেডিং পার্টনার। ওই দেশ থেকেই বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করে। তারপরই ভারতের স্থান। চুন থেকে পান সবই আসে চীন থেকে। এমন একটি দেশের দুর্বল প্রবৃদ্ধি সবার জন্যই দুশ্চিন্তার বিষয়। এদিকে ভারতের খবর মিশ্র। ভারত এই প্রথম চীনের প্রবৃদ্ধির হারকে ধরতে যাচ্ছে। খবরে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ম্যানুফেকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে উৎপাদন সূচক কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা রয়েছে। লোকের চাকরি যাচ্ছে, শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। এতে অভ্যন্তরীণভাবে চাহিদা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে ভারতের রফতানি জুলাই মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের অর্থনীতি ভাল অবস্থায় গেলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানি কিছুটা বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা। দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু আমদানিমূল্য কমায় ওই দেশের ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্ট’-এ উদ্বৃত্ত হচ্ছে সর্বোচ্চ। দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি হ্রাসের পরিমাণ ১০ শতাংশের ওপর। বিপরীতে আমদানি হ্রাসের পরিমাণ ১৮ শতাংশ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এদিকে মার্কিনীরা ভুগছে অন্য রোগে। এক সময় মনে হয়েছিল মার্কিন ডলারের মূল্য হ্রাস পাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে আতঙ্কিত মার্কিন ব্যবসায়ীরা এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই বিদেশে অনেক রোজগার করে। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় ওই সব কোম্পানির ১০০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে। ইউরোপ এখনও গ্রীস সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়নি। গ্রীসের ‘বেল আউট’ সমস্যা সমগ্র ইউরোপকে নিয়ে টান মারে। আপাতত সেই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেলেও এর জের এখনও চলছে। মার্কিন নির্বাচন সামনে। প্রার্থীরা প্রচারে নেমেছেন। তাদের প্রচারাভিযানের ভাষা এবার ভিন্ন। তাদের বেশিরভাগেরই কথা মধ্যবিত্তকে নিয়ে। মধ্যবিত্তকে বাঁচাতে হবে। প্রার্থীদের অনেকেই বলছেন, গণতন্ত্র মানে ‘কর্পোরেট গণতন্ত্র’ নয়, বেতন বৃদ্ধি মানে প্রধান নির্বাহীদের বেতন বৃদ্ধি নয়। দরকার সাধারণ মার্কিনীদের গণতন্ত্র এবং সুযোগ-সুবিধা। সার্বিকভাবে বলা যায় যে, বিশ্ব সঙ্কট আজ থেকে ৮-১০ বছর আগে শুরু হয়েছিল; তার জের এখনও চলছে। পৃথিবীর দেশগুলো এখনও কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। সঙ্কটের পর সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে অবাধ বাণিজ্য নিয়ে, কথা উঠেছে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে, কথা উঠেছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিয়ে। বিশ্বের অগণিত লোক এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে। অথচ বিশ্বের সকল সম্পদ এক শতাংশ লোকের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। বিশ্ব ব্যবস্থায় আরও সঙ্কট আসতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার তো দূরের কথা, এখন আশঙ্কা আরেকটা ধসের। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। কারণ আমরা এখন দুই পণ্যের দেশ। এক হচ্ছে ‘গার্মেন্টস’ এবং দুই হচ্ছে ‘জনশক্তি’ রফতানি। দুটের জন্য আমরা নির্ভরশীল ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। চীন আমাদের বাজার নয়, নয় ভারতও। অতএব ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাগা থাকলে আমরাও জাগতে পারব। আবার তারা নির্ভরশীল চীনের ওপর। চীন মরলে তারাও মরবে, মরবে বিশ্ব। এই প্যাঁচে আছি আমরা। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×