ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বিএনপি নেত্রীর মনে হঠাৎ এই শুভবুদ্ধির উদয় কেন?

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৫ আগস্ট ২০১৫

বিএনপি নেত্রীর মনে হঠাৎ এই শুভবুদ্ধির উদয় কেন?

অবশেষে বিএনপির ভেতরে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে মনে হয়। বাংলাদেশে এ সপ্তাহের একটি বড় খবর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ত্যাগ করে বিএনপি এখন শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি। তবে তাদের কিছু শর্ত রয়েছে। সে কথায় পরে আসছি। বড় কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন দ্বারা নির্বাচন করা না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এই অবাস্তব দাবিটি তারা ত্যাগ করেছেন এবং শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালে কিছুতেই সরকার প্রধান পদে রাখা যাবে না এই অযৌক্তিক দাবি থেকেও তারা সরে এসেছেন। এখন তাদের দাবি তাদের কিছু শর্ত মেনে নিয়ে হাসিনা সরকার এখনই মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। এই শুভবুদ্ধির উদয় বিএনপির ভেতরে সহজে হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির এটা একটা বড় রকমের পশ্চাদপসারণ। আন্দোলনের নামে দু-দু’বার দেশে নিরীহ মানুষ হত্যার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করাতে পারেননি। এমনকি ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনও ঠেকাতে পারেননি। ফলে দলের ভিতরে অসম্ভব বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রবীণ নেতারা নিষ্ক্রিয় এবং দল থেকে দূরে অবস্থান করছেন। নবীন নেতাকর্মীরাও হতাশ ও উদ্যমহীন। বেগম খালেদা জিয়া সম্ভবত এতোদিনে বুঝেছেন কেবল হুঙ্কার দিয়ে রাজনীতি হয় না এবং তার হাওয়া ভবন-খ্যাত কীর্তিমান পুত্র তারেক রহমানও হয়তো বুঝতে শুরু করেছেন, দেশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে কেবল বাক্যবীর সেজে আওয়ামী লীগ সরকারকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়া যাবে না। নির্বাচনে যোগদান নিয়েও বিএনপিতে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ছিল। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী চান নির্বাচনে অংশ নিতে। দীর্ঘকাল ক্ষমতার বাইরে থাকায় তাদের অনেকের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখে। তাদের বেশির ভাগই মনে করেন, গত নির্বাচনে গেলে তারা জয়ী হতে পারতেন এবং এই জয়ের দ্বারা বিএনপি ক্ষমতায়ও যেতে পারত। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমানকে প্রতিহিংসাপরায়ণতা এমন পেয়ে বসেছে যে, দেশ এবং দলের স্বার্থও তাদের বিবেচনা থেকে লোপ পেয়েছিল এবং সেখানে স্থান পেয়েছিল উদগ্র ক্ষমতালোভ এবং জিঘাংসা। এভাবে একটি রাজনৈতিক দল কেবল ক্ষমতালোভ, বিদ্বেষ ও হিংসার রাজনীতি দ্বারা চালিত হতে পারে না। বিএনপিতেও তাই নীরব বিদ্রোহ ধূমায়িত হচ্ছে। এবং খালেদা-তারেকের নেতৃত্বও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিলাতে বসে এক অকালকুষ্মা- পুত্র দেশে রাজনৈতিক প্রেসক্রিপশন পাঠাবেন আর মাতাজী বসে সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দল চালাবেন, এটা বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরাও এখন আর মেনে নিতে পারছেন না। ফলে বিএনপিতে ভাঙনের বাঁশি বাজতে শুরু করেছিল। শোনা যাচ্ছিল, দলের প্রবীণ নেতারা এমনকি সাবেক প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীও নতুনভাবে বিএনপি পুনর্গঠনের আভাস দিচ্ছেন। তারেক রহমানের খপ্পর থেকে দলকে মুক্ত করার দাবিও ভেতরে ভেতরে গুঞ্জরিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় দাবি বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। নইলে নির্বাচনে যোগ দিতে ইচ্ছুক দলের একটা বড় অংশ দলত্যাগ করে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চায়। এই অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে বেগম খালেদা জিয়ার এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। একদিকে তার আঁচল-আশ্রয়ী পুত্র এবং অন্যদিকে দলের বিক্ষুব্ধ বৃহৎ অংশ; তিনি কোন্ দিক সামলাবেন? দলের ভেতরের এই দ্বন্দ্বে তার নিজের নেতৃত্বও আর নিরাপদ নয়। নিজের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জমুক্ত রেখে সেই নেতৃত্বে একদিন পুত্র তারেক রহমানের অভিষেক ঘটিয়ে যাবেন, সেই সম্ভাবনাও দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। সুতরাং অনেক ভেবে চিন্তেই ‘আপসহীন নেত্রী’কে ইউটার্ন দিতে হয়েছে। নইলে তার নেতৃত্ব টিকবে না। দলও টিকবে কিনা সন্দেহ। দলের আইনজীবীরাও তাকে একই পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা যায়। বিএনপি নেত্রীর দুটি জোরালো দাবি ছিল। একটি, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে রাখা যাবে না। না রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। অন্য দাবিটি হলো, তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান। বর্তমানে এই দুটি দাবির প্রথমটি পরিত্যক্ত হয়েছে। রয়ে গেছে দ্বিতীয় দাবিটিÑ মধ্যবর্তী নির্বাচন। এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারেও বেগম জিয়ার গোঁ ধরার একটা কারণ আছে বলে জানা যায়। বিএনপির ঘনিষ্ঠ মহল থেকেই জানতে পেরেছি, দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মীই গত সাধারণ নির্বাচনের (জানুয়ারি, ২০১৪) আগে মনে করতেন, নির্বাচনে যোগ দিলে তাদের জয় অনিবার্য। নির্বাচনের পর তারা ক্ষোভ পোষণ করেছেন এই ভেবে যে, নির্বাচনে যোগ না দিয়ে তারা অনিবার্য জয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং এজন্যে নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তই দায়ী। গত দেড় বছরে হাসিনা সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ এবং এই সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং প্রশংসা লাভ করায় আরও তিন চার বছর পর নির্বাচন হলে বিএনপি জয়ী হবে কিনা তা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মনে আগের বিশ্বাস অটুট নেই। বরং তারা সন্দেহের দোলায় দুলছেন। এজন্যে তারা চান আওয়ামী লীগের জনসমর্থনের ভিত্তি আরও দৃঢ় হওয়ার আগেই নির্বাচন হওয়া দরকার। বেগম খালেদা জিয়া সম্ভবত আরেকটি ব্যক্তিগত কারণে মধ্যবর্তী নির্বাচন চান। এ কারণটি হলো, তিনি এখন গুরুতর দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত। কতোদিন আর আদালতে গরহাজির থেকে বা হাজির থাকলেও সময় নিয়ে নিয়ে আত্মরক্ষা করবেন? তার হয়তো ভয়, আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে এবং আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার হারাতে পারেন। এটা তার পুত্র তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে মাতাপুত্রের নেতৃত্বের এখানেই শেষ এবং বিএনপির নেতৃত্বেও রদবদল হবে। বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য অনেক প্রবীণ ও পুরনো নেতা ওঁৎ পেতে আছেন। তারা সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। আদালতের রায় তাদের সেই সুযোগ এনে দিলে তারা তা লুফে নেবেন। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দু’জনেই এ সত্যটা জানেন। তাই আদালতে তাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলা মোকদ্দমাগুলো ঝুলে থাকা অবস্থাতেই তারা দেশে একটি নতুন নির্বাচন চান। তাদের মনে হয়তো ক্ষীণ আশা জ্বলছে, এই নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে সরকার গঠনের পর এই মামলা মোকদ্দমাগুলো থেকে অব্যাহতি লাভের ব্যবস্থা তারা করতে পারবেন। তারেক রহমানকেও সরকারী ক্ষমতাবলে মামলা মোকদ্দমার জাল থেকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে। তারেক রহমান নতুন হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবেন। চাই কি তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও খোয়াব দেখবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানকেই বিএনপি নেত্রী তাই এখন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার শেষ সুযোগ হিসেবে দেখতে চাইবেন এটা স্বাভাবিক। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণে তাদের এই সম্মতি। এজন্যে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে এ ব্যাপারে তারা সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসতে চাইছেন। শর্তগুলো হলো, নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীকে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরে থাকতে হবে। এই তিন মন্ত্রণালয়ে দুই দল আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের বসাবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেও বদলাতে হবে। এই শর্তগুলো আমাকে একটি বাংলা প্রবাদবাক্য স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ “সেইতো মল খসালি, তবে কেনো লোক হাসালি?” ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশ নেয়, তার আন্তরিক আগ্রহ দেখিয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নির্বাচনকালীন তার মন্ত্রিসভায় যে কোনো পদ বেছে নিতে বিএনপিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও তার মধ্যে ছিল। বিএনপি রাজি হয়নি, নির্বাচনেও যোগ দেয়নি। নির্বাচনের পর প্রচারণা চালিয়েছে, “আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করেছে। এই সরকার অবৈধ।” এখন সেই ‘অবৈধ সরকারের’ সঙ্গেই তারা সংলাপে বসতে চাইছেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যোগ দেয়ার জন্য হাসিনা বিএনপিকে যে ছাড় দিতে চেয়েছিলেন সেই ছাড়গুলোই নতজানু হয়ে চাইছেন। এই ছাড় দিয়ে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হাসিনা সরকার বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজি হবেন কিনা সেটা তাদের বিবেচ্য। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, সরকার এখন একটি স্থিতিশীল সরকার; জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। দেশের পরিস্থিতি শান্ত। এই অবস্থায় কেবল বিএনপির খায়েস মেটানোর জন্য তারা কি নির্বাচনে যেতে চাইবেন? যদি না যান, তাহলে কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতো আগেই মন্ত্রী-দফতর ভাগাভাগির এই প্রস্তাব কি হাস্যকর নয়? সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের নির্বাচনের আগে দেশের যে পরিস্থিতি ছিলো তা এখন নেই। হাসিনা সরকারের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়নি। এবং তারা জনসমর্থন অর্জন করে স্থিতিশীল হয়েছে। দেশে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নেই। অন্তত জনগণের মধ্যে নেই। এই অবস্থায় বিএনপির উচিত ধৈর্য ধরা এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের বিরোধিতা করা এবং পরবর্র্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। বিএনপির বর্তমানে যে অবস্থা তাতে তার ঘর গোছানোরওতো প্রয়োজন আছে। সেজন্যেও সময়ের দরকার। আর নির্বাচনের সময় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব কেন বিএনপির পছন্দমতো লোকদের হাতে ছাড়তে হবে? এটাতো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেই ক্ষমতায় ভাগ বসাবার চেষ্টা। বিরোধীদলকে ক্ষমতার ভাগ দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির কোন্্ গণতান্ত্রিক দেশে আছে? যদি বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এটা করা দরকার, তাহলে তার জবাব হলো, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সেজন্যে প্রশাসনিক কঠোর ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিএনপি চাইতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের আগেই ক্ষমতায় বসার এই আবদার কেন? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগের পরিস্থিতিতো দেশে এখন নেই। মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রশ্নে হাসিনা সরকার কি ভাবছেন তা আমি জানি না। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকার পদ্মা সেতুসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনায় হাত দিয়েছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দানের কাজও এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এসব কাজ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সরকার ভ-ুল করতে পারেন না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই হাসিনা সরকারকে এবারেও পুরো টার্ম ক্ষমতায় থাকতে হবে। বিএনপিকে এই পরিস্থিতিতে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে। তাদের বুঝতে হবে হুঙ্কার ও গর্জনের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে। ল-ন, ৪ আগস্ট, মঙ্গলবার ২০১৫
×