ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

সব দলের অপরাজনীতির বিচার আনবে সুশাসন

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৪ আগস্ট ২০১৫

সব দলের অপরাজনীতির বিচার আনবে সুশাসন

সুশাসন, গুড গবর্নেন্স প্রতিষ্ঠা লাভ করুক- তা এক কথায় দলমত নির্বিশেষে সবারই কাক্সিক্ষত। কিন্তু সুশাসন কিভাবে আসবে বা কাকে সুশাসন বলা যাবে, সেসব বিষয়ের গভীরে অধিকাংশ মানুষ প্রবেশ না করে কোটি কোটি মানুষের এই দেশে দু-চারটি বর্বরতা, নির্মম হত্যাকা-ের বা নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে সার্বিকভাবে একটি দেশের সুশাসনের অভাব বা সুশাসনহীনতার প্রতিফলন বোঝায় কিনা তা ভালভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তবে সুশাসনের প্রধান সূচকগুলো কী কী মনে হয় এগুলো সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত সূচক হিসেবে গণ্য হওয়া প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে আমরা কতগুলো হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনাকে সুশাসনের অভাবের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করি। এর মধ্যে সাগর-রুনী হত্যা, নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র খেলাঘরের প্রগতিশীল কর্মী ত্বকী হত্যা, র‌্যাব কর্তৃক ছাত্র লিমনকে গুলি করা, নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব কর্তৃক প্রকাশ্য দিবালোকে ৭ খুন সংঘটন, সিলেটে রাজীবকে বলাৎকার করতে না পেরে বর্বর নির্যাতন করে হত্যা, যৌতুকের জন্য স্ত্রীর চোখ উৎপাটনের মতো বীভৎস ঘটনা, যৌতুকের জন্য নববধূ থেকে শুরু করে নিজ সন্তানের মা, ১২-১৪ বছরের সংসার করা স্ত্রীকে হত্যা, এসিড-আগুনে দগ্ধ করার মতো প্রাত্যহিক ঘটনা, শিশু-বালিকাকে ধর্ষণ ও হত্যা, এর পাশাপাশি বিদেশে লোভনীয় চাকরির ফাঁদ পেতে হাজার হাজার নারী-পুরুষের মানবপাচারের শিকার হয়ে সমুদ্রে, থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে খাদ্য, পানির অভাবে এবং চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা, অপরদিকে ধনী হচ্ছে এই পাচারকারী চক্র, যাতে যুক্ত আছে দেশী-বিদেশী অপহরণকারী। অথচ সম্প্রতি জানা গেল, মালয়েশিয়ায় দুই সরকার মিলে যে পাঁচ লাখ যুবকের চাকরি হওয়ার চুক্তি হয়েছিল সেটি ওখানকার চাকরিদাতাদের অসহযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে যায়। এর নেপথ্যে অবশ্যই বাংলাদেশী মানবসম্পদ প্রেরণকারীদের যোগসাজশ থাকাটা অসম্ভব নয় বলেই মনে হয়। এর একটি দুঃখজনক ফল হলো, মানবপাচারকারীদের হাতে গ্রামগঞ্জের মানুষ তাদের জমি, পশু বিক্রির অর্থ এবং একইসঙ্গে প্রাণও তুলে দিল প্রতারক দালাল চক্রের হাতে। হাজার হাজার মানুষকে প্রতারিত হতে দেখেও ওই দালাল চক্রের হাতে সহায়-সম্বল তুলে দেয়। ফলে তারা দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হয় আর প্রতারক চক্রের দালান-কোঠা ওঠে। এসব ঘটনা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে, তা বলাই বাহুল্য। এর পাশে আছে গ্রামগঞ্জে গজিয়ে ওঠা দ্বিগুণ লাভ পাবার লোভে দরিদ্রের কষ্টের জমানো অর্থের সামান্য কিছু সুদ দিয়ে হঠাৎ একদিন কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় প্রতারক। গ্রামীণ অর্থনীতির লাভ এভাবে শুষে নিচ্ছে নানা শ্রেণীর ঠক, প্রতারক, মানবপাচারকারী একটি দেশ ও জাতিবিরোধী বড় চক্র। শহরগুলোতে আছে ব্যাংক ঋণের নামে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিশাল অঙ্কের অর্থ লোপাট, এ ছাড়াও প্রশাসনের নানা স্তরে প্রকল্পের অর্থ লোপাটকারী মন্ত্রী-আমলা-প্রকৌশলী, আদালতকে ঘিরে অপরাধ, জামিন, কেনাবেচাসহ রয়েছে আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দল যারা আইনের শাসনকে বিঘিœত করে। উপরোক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অপরাধদমনকারী বাহিনী, জনসেবা খাতগুলোতে, বিশেষত বিদ্যুত, টেলিফোন, গ্যাস বিতরণ, রাস্তা, সেতু নির্মাণে যে বিশাল ঠিকাদার বাহিনী রয়েছে তাদের সঙ্গে ওইসব সংস্থার অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সেবাগ্রহীতাদের কত অর্থ ঘুষ হিসেবে দিতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। এত সব বৃত্তান্ত, উদাহরণের পর বাকি থাকে সুশাসন বা শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যানকারী রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চা, যাকে যে কোন সরকারের কুশাসনের প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করতে হবে। কয়েকটি উদাহরণ নেয়া যাক- ক. ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫-এ হবিগঞ্জে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক শাহ্ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫-৬ জনের ওপর বোমা হামলা করা ও হত্যা। এই দুটি হামলা রাষ্ট্রের স্ব-উদ্যোগে পরিকল্পিতভাবে অপরাজনীতি শুরু“ও জঙ্গীরাষ্ট্র হয়ে ওঠার অন্যতম উদাহরণ। এই দুটি হামলা পরিকল্পিত হয়েছে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানের দ্বারা, মন্ত্রী, ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীদের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, যা এক কথায় পৃথিবীতে হিটলারের পর দুটি দুর্লভ ঘৃণ্য ঘটনা। স্মরণ করতে হবেÑ এ ঘটনাগুলোতে রাষ্ট্রশক্তি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল এবং ’৭১-এর ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী এই রাষ্ট্রশক্তির ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল ও ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা সৃষ্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশবিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। এই দুটি হামলারই উদ্দেশ্য ছিল ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের নেতাদের হত্যা করে দলটির চিরবিনাশ নিশ্চিত করা, যা আইএসআই-এর বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অব্যাহত প্রচেষ্টার অংশ মাত্র। খ. দ্বিতীয় উদাহরণ, ২০১৩-এর মে মাসে বিএনপি-হেফাজতে ইসলামের নিজ দেশ ধ্বংসের, সরকার পতনের এক বর্বরতম ঘটনা। এরই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ২০১৫-এর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ও নির্দেশে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমা ছুড়ে নিরীহ-নিরপরাধ দেশবাসীকে বাসে, ট্রাকে, রেলগাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা! এত বিশাল মাপের বর্বরতার তুলনা চলে হিটলারের দ্বারা গ্যাসচেম্বারে মানুষ পুুড়িয়ে মারার ঘটনা এবং সম্প্রতি আইএস জঙ্গীদের নিরীহ বেসামরিক-সামরিক নারী-পুরুষ-শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পৈশাচিক ঘটনার সঙ্গে! গ. সম্প্রতি সরকারী দলের দু’পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে গর্ভস্থ শিশুর বুলেটবিদ্ধ হওয়ার আরেক বর্বর ঘটনাও অপরাজনীতির একটি উদাহরণ। ঘ. বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে যেখানে আমরা ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষায় আছি যদি মহাবিশ্বে পৃথিবীর মতোই আরেকটি প্রাণপূর্ণ গ্রহের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে তারা কি মানুষের মতো হবে? তখন একদল প্রাচীনপন্থী মানবজ্ঞানে অজ্ঞ, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মুরতাদ, নাস্তিক ঘোষণা দিয়ে প্রগতিশীল তরুণদের হত্যায় নেমেছে! জ্ঞানের এরকম অপচয় আগে আমাদের বাবারা দেখেননি, কল্পনাও করেননি! তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে খুনী, হত্যাকারী জন্ম নেবে, নিরপরাধ তরুণদের হত্যা করবে, এটা জামায়াতও আগে ভাবেনি। বলা বাহুল্য, এখন একদল অপরাজনীতিকের হাতে খুনের চাপাতি উঠছে, যা আরেক ধরনের অপরাজনীতি চর্চার বিকাশ ঘটাচ্ছে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় প্রতিবন্ধক। শুধু তাই নয়, তরুণদের যখন বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ করার কথা, তখন কিছু তরুণ ভূতের মতো আলো ছেড়ে অন্ধকারের দিকে যাত্রা করছে! তাদের উচ্চশিক্ষা তাদের ক্ষেত্রে অপচয় হয়ে উঠছে। নিজেরা শুধু জাতি, দেশ, পরিবারের জন্য বোঝাস্বরূপ হচ্ছে তা নয়, নিজেরা নিজেদের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। রাজীব, দীপ, অভিজিৎ, অনন্ত, হুমায়ুন আজাদ তাদের বিজ্ঞানমনস্কতার জন্য আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে চিরকাল! যতদিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, বাঙালী বেঁচে থাকবে। অন্যদিকে খুনীরা হারিয়ে যাবে অন্ধকারে। যাই হোক, ফিরে আসি সুশাসনের প্রশ্নে ও আলোচনায়। সমাজে বা রাষ্ট্রে যদি ওপরের আলোচনা থেকে পাওয়া রাষ্ট্র ধ্বংসকারী শক্তির অবস্থান থাকে, রাষ্ট্রকে যদি প্রতি মুহূর্তে রাষ্ট্রধ্বংসকারী রাজনৈতিক দলের অপরাজনীতির মোকাবেলা করে শাসন পরিচালনা করতে হয়, তখন তাকে নির্ভর করতে হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর। যাদের মধ্যে আবার রাষ্ট্রবিরোধী উপাদানও থাকে। সেজন্য মাঝে মাঝেই দেখা যায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় এমন কাজ তারা মাঝে মাঝেই করে বসে। সমাজে ওপরে আলোচিত স্বার্থান্ধ লুটেরা দলগুলো, যারা দেখা যাচ্ছে কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের বিষয়ে মোটেও সচেতন বা অচেতন কিছুই নয়, যাদের একমাত্র লক্ষ্য অর্থলুট, তাদের অপরাধকে সামাল দেয়া, প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ সবসময় দ্রুততার সঙ্গে বা দীর্ঘ সময়েও সম্ভব হচ্ছে না। হয়ত ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাবান কেউ তাদের প্রোটেকশান দিচ্ছে, যা শুধু একা সরকারপ্রধানের পক্ষে উপেক্ষা করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। সরকারী দলের ভেতরে সরকারবিরোধী অনুপ্রবেশ থাকবে। তাদের অন্যায় কর্মকা-গুলোকে যে কোন উপায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের সুশাসনের প্রতি অবস্থানকে দৃঢ় করবে। অন্যকিছু করার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার নিজ দলীয় অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাকে অনেকগুলো হত্যা মামলা- ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সাগর-রুনী, ত্বকী, ব্লগারদের হত্যা, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলা, অনেক আগের সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যা, রতন সেন হত্যা, হুমায়ুন কবির বালু হত্যা, শাহ্্ কিবরিয়া হত্যা, রাজীবসহ সব শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য হত্যা, শেয়ারবাজার লুটেরাদের বিচার এবং সর্বশেষ ২০১৩-এর রাষ্ট্রবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও এবং ২০১৫-এর পেট্রোলবোমার দ্বারা শতাধিক মানুষ হত্যা মামলার সুষ্ঠু এফআইআর এবং পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ও দ- কার্যকর করা হলে, এর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করার পর আশা করা যায়, বর্তমান সরকারও সুশাসনের পথে অনেকটা অগ্রসর হবে। তাছাড়া এসব অপরাধের অপরাধীদের সম্পদ, বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং হত্যার দ- ফাঁসি হতে হবে। পাশ্চাত্যের চাহিদা নয়, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে হত্যার মতো অপরাধের দ- ফাঁসি দেখতে চায় অপরাধের শিকার পরিবার-স্বজন, তাদেরই ন্যায়বিচার ও সুশাসন দিতে হবে, পাশ্চাত্য দেশকে নয়। তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিচার ও দ- দান করে থাকে, সেখানে আমাদের বলার কিছু নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক
×