ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাসিয়ারছড়ার হিন্দুরা জমি ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৪ আগস্ট ২০১৫

দাসিয়ারছড়ার হিন্দুরা জমি ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন

রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে ॥ দাসিয়ারছড়ার দেবিরপাঠ গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ কৃষ্ণকান্ত বর্মণ। কয়েকদিন পর নিজ দেশে চিরদিনের মতো চলে যাবেন। ‘মনে মনে ভয়-অজানা, অচেনা পরিবেশ। তারপরও নিজ দেশের মাটি তো। জন্মের পর থেকে এখানকার আলো বাতাসে বড় হলেও পরাধীনের মতো বন্দী জীবন কাটিয়েছি। মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারিনি। পায়নি কোন নাগরিক সুবিধা। তবে কৃতজ্ঞ এখানকার পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের কাছে। তারাই তাদের বুকে আগলে রেখেছে। কোন সমস্যায় পড়তে দেয়নি। এদের কথা কোন দিন ভুলতে পারব না।’ কথাগুলো বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন কৃষ্ণকান্ত বর্মণ। শুধু তিনি নন, কালীরহাট গ্রামের খোকন (৩৩), নগেন (২৫), সাধনসহ (৩৫) ১৫৮ হিন্দু নাগরিক দাসিয়ারছড়া ছিটমহল থেকে ভারতে তাদের মূলভূখ-ে ফিরে যাবেন। এরা সবাই ভারত যাবার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা। যেকোন সময় বাংলাদেশ ছাড়তে হবে তাদের। ১ আগস্ট থেকে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত ভারতে যাবার সময়। এ সময় একটি পাস দেয়া হবে তাদের। তাদের যাতায়াতের যাতে কোন সমস্যা না হয়। শত বছরের বাপদাদার ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে এসব হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের। এজন্য আয়োজন করা হয়েছে পুজো-অর্চনার। পাঁচদিন চলবে এ অনুষ্ঠান। রবিবার সন্ধ্যার আগে দাসিয়ারছড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষ্ণকান্ত বর্মণ বাড়ির উঠানে বড় আকারে মনসা পুজোর আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে সকল বয়সের নারী-পুরুষ-শিশুদের অংশগ্রহণে চলছে উৎসব। উপস্থিত শতাধিক ভক্তকুল। রাত যত গভীর হয়, আশপাশের হিন্দু গ্রাম দেবিরপাঠ, কালীরহাট, রাসমেলা গ্রাম থেকে আরও অনেক ভক্তকুল আসেন এ অনুষ্ঠানে। দেবিরপাঠ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্ধশতাধিক মানুষ ভারত যেতে মত দিয়েছেন। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভারতে যাবার। এই গ্রামের লিটন চন্দ্র বর্মণ বলেন, এতদিন আমরা ভারতের ভূ-খ-ে ছিলাম। কিন্তু সে দেশে যেতে পারিনি। এবার নিজ দেশে যেতে পারব বলে ভীষণ খুশি লাগছে। তিনি জানান, নিজেদের যাত্রার মঙ্গল এবং বাংলাদেশে রেখে যাওয়া পাড়া-প্রতিবেশীদের মঙ্গলের জন্য যাবার আগে ছিটমহল স্বাধীনের একদিন পর পুজো-অর্চনার আয়োজন করেন তারা। পুজো শেষে কীর্তন শুরু হয়। কীর্তন পাঁচদিনব্যাপী চলবে। রাসমেলা গ্রামের বিধবা রতœা দেবী জানান, আমাদের আর এ সরকারের কাছে চাওয়ার কিছু নাই। সরকার যেভাবে নিয়ে যাবে, তাতেই তারা খুশি। শান্তিতেই যেতে চায় তারা। যে কয়েকটা দিন এখানে থাকব কোন গ-গোল যাতে না হয়, এতটুকু নিরাপত্তা চায় বাংলাদেশ সরকারের কাছে। দেবিরপাঠ গ্রামের মনমোহন রায় (৫৪) জানান, বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় ভূ-খ- যুক্ত হওয়ায় শেষবারের মতো পুজো-অর্চনা আর কীর্তন করতে পেরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আনন্দে থাকলেও ভিটেমাটি আর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত রয়েছেন তারা। তিনি জানান, তাদের জমি বিক্রির ক্রেতা পাওয়া গেলেও তারা এ মুহূর্তে কম দাম বলছে। একই গ্রামের অনুকুল বর্মণ ও ধীরেন্দ্রনাথ জানান, এখন পর্যন্ত দু’রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কিছু বলা না হলেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দ্রুত স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান এই বাসিন্দারা। এছাড়া অল্প সময়ের মধ্যে জায়গা-জমি বিক্রি না হওয়ায় সরকার কর্তৃক একটি মূল্য নির্ধারণের কথা বলেন তারা। জেলা প্রশাসক খাঁন মোঃ নুরুল আমিন জানান, যারা ভারত যেতে নিবন্ধন করেছেন তাদের আগামী ৩০ নবেম্বরের মধ্যে চারটি পয়েন্ট দিয়ে ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পাঠানো হবে। তিনি আরও জানান, সদ্য বাংলাদেশী হওয়া ভূ-খ-ে জমিজমা বেচাকেনা করতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে করা যাবে। পুলিশ সুপার মোঃ তবারক উল্লাহ জানান, কোনপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, এজন্য আমরা দাসিয়ারছড়া ছিটমহলসহ জেলার ১২ ছিটমহলে পুলিশ টহল বাড়িয়েছি। দাসিয়ারছড়ায় অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি করা হয়েছে। এ ছাড়া সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মানুষ ছিটমহলগুলোতে নজর রাখছে।
×