ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যৌতুকের শিকার রিপা রানী ॥ ঢাকা মেডিক্যালের বেডে কাতরাচ্ছেন ॥ স্বামী-শ্বশুরবাড়ির লোকজন এ্যাসিড খাইয়ে কণ্ঠ শব্দহীন করে দিয়েছে

কথা ফোটে না মুখ থেকে, ইশারা-ইঙ্গিতে যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৪ আগস্ট ২০১৫

কথা ফোটে না মুখ থেকে, ইশারা-ইঙ্গিতে যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা

শর্মী চক্রবর্তী ॥ প্রচ- যন্ত্রণা। অনেক কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কিছুই বলতে পারছেন না। বিভিন্ন রকম শব্দ করে তার ভিতরের কথাগুলো বুঝানোর চেষ্টা করছেন আর ছটফট করছেন রিপা রানী প-িত (২২)। যৌতুকের টাকা না দেয়ায় স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনই এ্যাসিড খাইয়ে তার কণ্ঠ শব্দহীন করে দিয়েছে। কথা বলতে পারছেন না এমনকি মুখে কোন খাবারও খেতে পারছেন না। শরীরে শুধু স্যালাইন চলছে। দু’হাতে বিয়ের চিহ্ন শাঁখা নিয়ে রিপা রানী প-িত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২ নম্বর ভবনের ৮০১ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩ নম্বর বেডে কাতরাচ্ছেন। পাশে বসে থাকা ছোট ভাইকে বারবার ডেকে তার যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। হাতের ইশারায় বোঝাচ্ছিলেন তার গলা ও পেট জ্বলছে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করার জন্য। এতো কষ্ট সইতে না পেরে চোখ দিয়ে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। এ্যাসিডের প্রভাবে তার কণ্ঠনালী, পাকস্থলী ও মুখের আংশিক অংশ ঝলসে গেছে। সঙ্গে থাকা রিপার ছোট ভাই অপু প-িত ও অপুর বন্ধু আরিফের ভাষায়Ñ কথা ফুটে না তার মুখ থেকে, পছন্দের খাবার খাওয়া, গা-গোসলের বিষয় বোঝায় শুধু ইশারা-ইঙ্গিত আর শব্দহীন ধ্বনিতে। গত ২৬ জুলাই শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির আদমপুরে রিপার ভাগ্যে এই ঘটনা ঘটে। আহত অবস্থায় সেদিন রাতে তাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনই নেন বাজিতপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। খবর পেয়ে ২৭ জুলাই রিপার ভাই অপু নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তখন থেকেই শ্বশুড়বাড়ির লোকরা পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মা-বাবার একমাত্র মেয়ে রিপা রানী প-িত। ৯ মাস আগে পারিবারিকভাবে দেখা শুনার মাধ্যমে রতন প-িতের সঙ্গে বিয়ে হয়। রবীন্দ্র প-িত ও কল্যাণী প-িতের ছেলে রতন নরসিংদীর একটি টেক্সটাইল মিলসে চাকরি করেন। রিপার বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বিশেষ করেÑ বছর খানেক আগে নিজ এলাকা নেত্রকোনা সদরে কাপড়ের ব্যবসায় আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আরও বেকায়দায় পড়েন। এর মধ্যেও বেশ কষ্ট করে বিয়ের সময় তিনি নগদ দেড় লাখ টাকা ও দুই ভরি স্বর্ণ দেন রতনকে। মূলত আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান রিপার মামারাই বিয়ের সময় বড় ধরনের সহযোগিতা করেন। বিয়ের পর সুখেই কাটছিল তাদের সংসার। কিন্তু, বিয়ের ছয় মাস যেতে না যেতেই তাদের সংসারে অশান্তি দেখা দেয়। আর সেই অশান্তির কারণ ছিল যৌতুকের টাকা। রতন রিপার পরিবারের কাছে অতিরিক্ত ৩ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে বসে। রিপার পরিবার নিম্নবিত্ত। বিয়ের সময় অনেক কষ্ট করে যৌতুকের টাকা দিয়েছিল। আবার দাবিকৃত যৌতুকের টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তারা। তখনই ক্ষিপ্ত হয় রতন। রতন রিপার হাত বেঁধে ফেলে। বোতলে থাকা এ্যাসিড রিপাকে জোর করে খাইয়ে দেয়। বুকের মধ্যে এ্যাসিড ঢেলে দেয়। এতে পুড়ে যায় খাদ্যনালী। পুড়ে যায় মুখের ডানপাশ। ঝলসে যায় বুক। খাদ্যনালী পুড়ে যাওয়ায় জীবন শঙ্কায় ভুগছেন তিনি। গত রবিবার দুপুরে শ্বশুরবাড়িতে রিপাকে মারধরের পর রতন একটি বোতলে থাকা এ্যাসিড তাকে খাইয়ে দেয়। এ সময় রিপা চিৎকার ও কান্নাকাটি করলে পাষ- স্বামীর কোন দয়ামায়া হয়নি। বরং এ্যাসিড খাইয়ে তার হাত বেঁধে মেঝের ওপর ফেলে রাখে। তখন অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে রিপা। এ্যাসিড খাদ্যনালীতে যাওয়ার পর থেকে তার প্রচ- কাশি হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে তিনি কিছুই খেতে পারছেন না। রিপার বামপাশের একটি খালি বেডে তার ভাই অপু প-িত তার বন্ধু আরিফ বসে আছেন। রিপার এমন বিপদে তারা সবাই নির্বাক। রিপার ভাই অপু প-িত কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার সদর থানার ছত্রসী এলাকায়। তারা এক ভাই এক বোন। রিপা বড়। গত ৯ মাস আগে রতন প-িতের সঙ্গে রিপার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় যৌতুক বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২ ভরি স্বর্ণ ও প্রায় ১ লাখ টাকার আসবাবপত্র দেয়া হয়। গত দুই মাস ধরে রতনের আচার ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটে। কারণে অকারণে রিপাকে মারধর করা হতো। মুখ বুজে সহ্য করতো রিপা। রতনের নির্যাতনের সে আমাদের বাড়ি এসে পড়ে। নির্যাতনের ভয়ে যেতে চাইতো না। পরে পারিবারিক সমাধানের মাধ্যমে আবার শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হয়। তিনি আরও জানান, এ ঘটনার কিছুদিন আগেও আমার বোন ফোন করে বলে ভাই এখান থেকে আমাকে নিয়ে যা ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। এরপর রতন রিপাকে বলে তাকে আরও ৩ লাখ টাকা যৌতুক দেয়ার জন্য। কিন্তু ওই টাকার কথা বলতে রাজি হননি তিনি। এ ক্ষোভ থেকেই রবিবার দুপুরে শ্বশুরবাড়িতে রতন বোতলে থাকা এ্যাসিড রিপাকে জোর করে খাইয়ে দেয়। এ সময় রিপা চিৎকার চেঁচামেচি করলে রতন ও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মধ্যে কোন মায়া জাগেনি। এরপর রিপা অচেতন হয়ে পড়ে যায়। এক সময় তারা ভাবে বাড়িতে মরে গেলে সমস্যা হবে তাই হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওইখানে তাকে রেখে চলে যায় সবাই। পরে তার শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়ির লোকজন আমাদের মোবাইলে খবর দেয়। তখন আমরা সেখানে গেলে চিকিৎসকরা রিপাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় আমরা এখনও কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারিনি। রিপা একটু সুস্থ হলেই আমরা আইনী ব্যবস্থা নেব। তবে বিষয়টি মীমাংসার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে চাপ আসছে বলে জানান তিনি। অপুর বন্ধু আরিফ বলেন, ঘটনার ৭ দিন হয়ে গেল। কিন্তু, রিপা কিছুই খেতে পারছেন না। পানি পর্যন্ত পান করলে তার পেটে জ্বালা-পোড়া শুরু হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে আছেন তিনি। এজন্য তাকে শুধু স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। প্রচ- কাশি হচ্ছে তার। কোন খাবার না খাওয়ায় তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। রিপা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ শরিফুজ্জামানের অধীনে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, তার খাদ্যনালী পুড়ে গেছে। তার এক্সরে করা হয়েছে। পুড়ে যাওয়া খাদ্যনালীতে যেন কোন ইনফেকশন না হয় এজন্য পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এছাড়া ২১ দিন যাবৎ ইনজেকশন ও স্যালাইন দেয়া হবে।
×