ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তাদের কাছ থেকে পাসকার্ড নিয়ে নামতে হয় সাগরে

জলদস্যুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ জেলে

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৩ আগস্ট ২০১৫

জলদস্যুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ জেলে

নিজস্ব সংবাদদাতা, বরগুনা, ২ আগস্ট ॥ বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার শেষ নেই। একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেকদিকে জলদস্যু উৎপাত। আর জলদস্যুদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে গভীর সমুদ্রে র‌্যাব ক্যাম্প স্থাপনের জোর দাবি জানিয়েছে জেলেরা। পাথরঘাটা উপকূলের জেলেপল্লী ঘুরে জানা গেছে, ইলিশের মৌসুমে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন এলাকায় সক্রিয় থাকে কমপক্ষে ছয় দস্যুবাহিনী। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জেলেরা। তবুও শান্তিতে মাছ ধরার আশায় দস্যুদের কাছ থেকে চড়া দামে ‘দস্যু পাসকার্ড’ সংগ্রহ করে সাগরে নামে জেলেরা। লাখ টাকার এই পাসকার্ড নিয়েও পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। এক বাহিনীর কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহ করলে অন্য বাহিনীর অত্যাচার বেড়ে যায় দ্বিগুণ। আবার যে বাহিনীর কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহ করা হয় তারাই বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে চালায় নির্যাতন, জেলেদের আটকে রেখে আদায় করে মুক্তিপণ। চড়া দামের বিনিময়ে সংগ্রহ করা পাসকার্ডও তখন হয়ে যায় মূল্যহীন! বিভিন্ন সময় র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে বিভিন্ন দস্যু বাহিনীপ্রধান মারা গেলেও সেই দলের সদস্য ও নতুন বাহিনী আবারও সংগঠিত হয়ে দস্যুতা চালায় সাগরে। এর মধ্যে জিরো ভাই, শিষ্য ভাই, মাস্টার, রাজু, আকাশ, বাকিবিল্লাহ দস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। আর এ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে সাগর থেকে নগর পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ। দস্যু বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্থানীয় কিছু জেলে ও প্রভাবশালী মহল পরিচালনা করে এ দস্যুবাণিজ্য। আর এ বাণিজ্যের শিকার উপকূলের নিরীহ জেলেরা। সাগরে মাছ ধরতে আসা জেলেদের প্রতি ইলিশ মৌসুমের শুরুতে দস্যুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পাসকার্ড সংগ্রহ করতে হয়। যদি কোন জেলে এ কার্ড না করে সাগরে মাছ ধরতে যায় তাহলে তাকে প্রাণ হারাতে হয়, অন্যথায় মুক্তিপণ দিতে হয় লাখ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে মহাজনের কাছে দস্যু বাহিনী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সাগরে নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে কার্ড করার পরামর্শ দেয়। কার্ডপ্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করতে হয় মহাজনদের। আর কার্ডের মেয়াদ দেয়া হয় এক বছর। বছর শেষে আবার কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। প্রথমে দস্যুরা সাগরে বিভিন্ন ট্রলারের জেলেদের আটক করে তাদের মালিককে ফোন দিয়ে পাসকার্ড করতে বলে। পরে দস্যুদের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিলে তারা জেলেদের পাসকার্ড দিয়ে ছেড়ে দেয়। আবার কিছু দস্যু বাহিনী মহাজনদের গতিবিধির ওপর নজর রেখে ফোন করে পাসকার্ড সংগ্রহ করতে বলে। এ সময় দস্যুদের চাওয়া টাকা বিকাশ করলে তারা পাঁচ অথবা পঞ্চাশ টাকার নতুন নোটের সিরিয়াল নম্বর পাসকার্ড নম্বর হিসেবে ব্যবহার করতে বলে। বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী দস্যুদের কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহের কথা স্বীকার করে বলেন, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা জেলেদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় তারা বাধ্য হয়ে পাসকার্ড সংগ্রহ করে। নির্ভয়ে ইলিশ শিকারের তাগিদে কেউই পাসকার্ড সংগ্রহের কথা স্বীকার করে না। জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান মাঝি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাই তারা প্রাণ রক্ষায় দস্যুদের টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু তা নিয়েও শান্তিতে নেই জেলেরা। তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেলেদের নিরাপত্তার দাবি করেন এই জেলে নেতা। পাথরঘাটা কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. এফএ রউফ বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে জেলেরা কোন অভিযোগ করতে চায় না। তবে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব। কিন্তু জীবনের ভয়ে অনেক জেলে এ পাসকার্ড সংগ্রহ করেন বলে তিনি স্বীকার করেন।
×