ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চে আসছে মহাকালের ‘নীলাখ্যান’

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩ আগস্ট ২০১৫

মঞ্চে আসছে মহাকালের ‘নীলাখ্যান’

সাজু আহমেদ ॥ নাটক নিয়ে সব সময়ই নীরিক্ষা ও গবেষণা করে থাকে ঢাকার মঞ্চে অন্যতম জনপ্রিয় নাট্যদল মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়। বিশেষ করে তাদের প্রযোজিত নাটকগুলোতে মানুষের মানবিক অধিকার এবং মানব প্রেমের বিষয়টি অতিব গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়। এ কারণে দলের প্রায় সবকটি প্রযোজনার মান দেশে এবং দেশের বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে ‘শিখন্ডী কথা’র মত নান্দনিক এবং ব্যতিক্রমধর্মী নাট্য নির্মাণের মাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে এই দলটির কার্যক্রম।নবতর আঙ্গিকে নাট্য নির্মাণের ধারাবাহিকতায় নতুন নাটক মঞ্চে আনছে মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়। নাটকের নাম ‘নীলাখ্যান’। এ প্রসঙ্গে মহাকালের দল প্রধান মীর জাহিদ জানান, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাপুড়ে’ গল্প আশ্রয়ে নাটকটি নির্মিত হচ্ছে। নাটকটি রচনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনন জামান। নির্দেশনা দিচ্ছেন একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক। আগামী ১৪ আগস্ট শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে এ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হবে। মীর জাহিদ আরও জানান, মানব প্রেমের অমর উপাখ্যান ‘নীলাখ্যান’ নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করবেন পলি বিশ্বাস, মনামী ইসলাম কনক, লিঠু ম-ল, জেরিন তাসনীম এশা, কোনাল আলী, চৈতী সাথী, তনু ঘোষ, আমিনুল আশরাফ, আসাদুজ্জামান রাফিন, মোহাম্মদ আহাদ, শিবলী সরকার, শাহরিয়ার হোসেন পলিন, ইয়াছির আরাফাত, তৌহিদুল রহমান শিশির, ইকবাল চৌধুরী, জাহিদুল কামাল চৌধুরী দীপু, মোঃ শাহনেওয়াজ, মীর জাহিদ হাসান প্রমুখ। এছাড়া নাটকে সুর সংযোজন ও আবহসঙ্গীত পরিকল্পনায় ইউসুফ হাসান অর্ক, আলোক পরিকল্পনায় ঠান্ডু রায়হান, পোশাক পরিকল্পনায় ড. সোমা মমতাজ, কোরিওগ্রাফি জেরিন তাসনিম এশা, প্রপস পরিকল্পনা ও নির্মাণ হাসনাত রিপন, রূপসজ্জা শিল্পী শুভাশীষ দত্ত তন্ময়, পোস্টার ও স্মরণিকা ডিজাইন পংকজ নিনাদ, মঞ্চ ব্যবস্থাপক জাহিদ কামাল চৌধুরী এবং প্রযোজনা অধিকর্তা মীর জাহিদ হাসান। নাটকের কাহিনীতে দেখা যাবে বেদিয়ার সর্দার জহরের বিষ জয় সাধনায় মনসা দ্বারা কাম নিষিদ্ধের আভাসে প্রত্যাখ্যাত ভালবাসার মানুষ বিন্তী রানী আড়ালি বিলে রাশি রাশি শাদা শাপলার বনে আত্মহত্যা করে। বেদিয়া বহরে বেড়ে ওঠা সাপে কাটা মান্দাস ভাসা বালিকা চন্দনের চুলের আড়ে বিন্তীর সুরভী পায় জহর। নারী নিষিদ্ধ বলে এ বালিকা বেড়ে ওঠে বালকের বেশে। যাকে সন্তান করেছিল জ্ঞান- ঋতুমতি হয়ে ওঠার পর তার প্রতি প্রবল রতি অনুভব করে জহর। বেদিয়া দলে তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় বিচিত্রমুখী সঙ্কট। চন্দনের যুবা সাজে তাকে প্রেম নিবেদন করে মৌটুসী আর চন্দন ঠোঁটে মালতী ফুলের লাল ডলে ঝুমরোর সামনে দাঁড়ায়। বেদিয়াদের উৎসবে চন্দনের নারিত্ব উন্মোচন হলে দলের অতিপ্রাকৃত বৃদ্ধ ঘণ্টাবুড়ো বেদিয়া দল ও জহরকে তিনটি অনিবার্য ভবিতব্যের ঘোষণা দেয়- ‘ভবিতব্যের তিনরূপ কহি- যে ভাতের পাতিল নেবার জন্য জলে ডুবেছে বিন্তী- তা অন্যরে দিতে চেয়ে পতিত হবি তুই। অথবা তোর আচরে বিন্তীর অনুগামী হবে চন্দনে। আর যদি না হয় তা- তবে আছে তৃতীয়জন- তার হবে মৃত্যু। মৃত্যু অনিবার্য- তবে তা কার হবে- তোর কার্যকরণ হবে স্থির। সামগ্রিক দৃশ্যকাব্যে ক্ষণে ক্ষণে তিনটি ভবিতব্য ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল হয়ে ওঠে। যাকে পিতা মানে তাকে পতি মেনে নিতে পারে না চন্দন। ঝুমরোর জন্য জহরের ঝাঁপিতে আছে দাঁত না ভাঙা পোষা সাপ। শাওনের অখ- চাঁদের সাঁজ বেলায় আকাশজুড়ে যেন মনসার নীল মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। জহরের অন্তরে তখন বাজে চন্দন চেয়েছিল গাঢ় নীল রঙের ফতুয়া। সে ক্ষণে একশতম সাপের দংশন নেবে জহর মন্ময় নীলের দোলাচলে সে চিত্রল ফণায় টোকা দিয়ে সাপকে ক্রোধমত্ত করে তোলে। এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনী। নতুন এ নাটকের রচনা প্রসঙ্গে আনন জামান বলেন, শব্দে সুরে ভাবের বিত্তবৈভব বিনির্মাণে বাংলা সাহিত্যে কী সঙ্গীতের ঐশ্চর্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সুরে আসরে তার গান আর কাব্যগুলো এক আকাশ শূন্যতার বেদনা মন্থিত নির্যাস। সাঁজকালি আন্ধার রাতে শিমুল মোস্তফার কাব্যকণ্ঠে কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা তার বেদনাবিধুর চিঠির শব্দপাঠ মনে হয়েছিল তার কবিভাব আর কাব্যপম শব্দপুচ্ছ যদি শাদা কুয়াশা হতো-তা যদি স্পর্শ করা যেত- তবে তা নখে মাখিয়ে ভাব এবং আবেগের প্রকাশ শিখতাম। হে দ্রোহের পুরোহিত- অভাজনের দোষ নেবেন না- আপনার ‘সাপুড়ে’ গল্প পাঠের পর বেদিয়া জহর-ই আমার কাছে যা কিছু বেদনা বলবার- বলেছিল- আপনার চরিত্রের ভাবকথা আমি অনুলিপি করেছি মাত্র। সাপুড়ে গল্পের বেদিয়াদের ঝাঁপির ভেতর যা ছিল গোপন-সেই ঝাঁপি খুলে গোপন উন্মোচনের চেষ্টায় এ নবতর নাট্য আয়োজন। ঘুম অথবা জাগরণের ভেতর ভুবন থেকে মনসা বলেছিল অখ- চাঁদের সাঁজক্ষণে যদি একশ’ সাপের দংশন শরীরে নেয় আর কাম রাখে আপন শরীরে বন্দক তবে বিষ বশ করতে পারবে জহর। একটি সাপের বিষ বুকে সয়ে- জহর হত হয় কাম আর প্রেমের দংশনে। ‘নীলাখ্যান’ নাট্য জহরের পরাণ আর চৈতন্যের গোপন পাত্রের রতি আর আরতির নাট্য। নাটক প্রসঙ্গে নির্দেশক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক বলেন, নাটকের কাহিনীটির প্রেক্ষাপট বেদে বহর হলেও কবি নজরুলের অন্তস্রোতে এমন একটি সর্বজনীন বীজ ভাসিয়ে দিয়েছেন যা স্পষ্টতই গোটা মানরজাতির সর্বকালকে ছুঁয়ে যায়। অনতিক্রম্যদুর্মর আকাক্সক্ষা আর বিরাট প্রকৃতির তুলনায় মানুষের অসহায়ত্ব তাই কবিকে এমন প্রেমাখ্যান লিখতে কলম ধরায়। কবি আর নাট্যকার তাদের মন্ময়তায়-তন্ময়তায় যে জগৎ রচনা করেন তার থেকেও ভিন্ন কোন ভাষা অনুসন্ধান করতে হলে বাঙলা নাট্যের সঙ্গীতের ঐতিহ্যের দ্বারস্থ হতেই হয়। কেননা সেখানেই অনেক কথা না বলেও বলা হয়ে যায়। ‘নীলাখ্যান’ প্রযোজনাতেও সেই প্রয়াস রয়েছে। শব্দ-সুরের শক্তিতে প্রেম আর মানুষের অসহায়ত্বের মনকথা বলবার জন্যই অভিনেতা-চরিত্রেরা অনেকটা গীতলভাবে তাদেরকে প্রকাশ করে। এ নাট্যে অভিনেতা নিজেই চরিত্র ও পরিস্থিতির বিবরণ উপস্থাপন করেন মঞ্চক্রিয়া সহযোগে। একে শুদ্ধ চরিত্রাভিনয় না বলে আমরা ‘বর্ণনাত্মক চরিত্রাভিনয়’ বলছি। এ অভিনয় আমাদের আবিষ্কার নয়। আমাদের ঐতিহ্যে পালাকার-গায়েন-বয়াতিরা এভাবেই অভিনয় করেন। তাতে কাহিনীর রসাস্বাদনে কোন অসুবিধা হয় না। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, সেখানে একজনই কাহিনী বয়ান করেন আর এখানে সকলে মিলে একটি গল্প বলার চেষ্টা। প্রযোজনাতে খুব বেশি ইমেজ তৈরি করবার চেষ্টা নেই এই কারণে যে নির্দেশকের বিশ্বাস, ‘বর্ণনাত্মক’ এমন একটি শিল্প আঙ্গিক যেখানে শ্রুতিময়তা দিয়েই দৃশ্যময়তা তৈরি হয় দর্শক চিত্তে। আর সে কারণে নাটকটির নামকরণেও ‘আখ্যান’ শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। দর্শকদের প্রেমময় মনের কাছে বলি : গীতের পালকিতে করে মহান কবির একটি কাহিনীকে আপনাদের উঠানে এনে হাজির করেছি আমরা, ‘মনে নেবেন’ না ‘মেনে নেবেন’ সে ভক্তিপূর্ণ বিনয় নিয়েই সৃজনশীলতার পথ হেঁটেছি।
×