ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

লেটস টক ॥ সজীব ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩ আগস্ট ২০১৫

লেটস টক ॥ সজীব ওয়াজেদ

অনুষ্ঠানটির নাম ‘লেটস টক উইথ সজীব ওয়াজেদ’Ñ চলুন সজীব ওয়াজেদের সঙ্গে কথা বলি। আমি আমার লেখার শিরোনামে ‘উইথ’ শব্দটি ফেলে দিয়েছি মাত্র। সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) নামের একটি সংগঠন এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হলেন সজীব ওয়াজেদ জয়। মূলত তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে তার মতবিনিময়ের একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্ম এটি। সিআরআই অবশ্য অনেক কর্মকা-ের মাধ্যমে তরুণদের যুক্ত করার চেষ্টা করছে। তবে তাদের ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয় এবং গোছানো। ৩১ জুলাই ২০১৫, শুক্রবার ছিল তাদের ১৪তম অধিবেশন, ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। এবারের বিষয় ছিল, বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত : ভিশন ২০২১। পাঠক হয়ত জানেন যে, জুলাই মাসের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তবে এখনও মধ্যম আয়ের দেশ হতে আমাদের অনেকটুকু পথ হাঁটতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্থান করে নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। সেই ভিশন নিয়েই খোলামেলা আলোচনা করতে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২ শতাধিক নারী-পুরুষ (বিশেষত ছাত্রছাত্রী এবং তরুণ প্রজন্ম) অংশ নিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। ঢাকায় আমার খুব একটা চলাফেরা করা হয় না। যে পরিমাণ ট্রাফিক জ্যাম থাকে, তাতে কোথাও বের হলে সারাটা দিন শেষ। আমি উপলব্ধি করতে শুরু করেছি যে, আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে আমার যা প্রডাক্টিভিটি, ঢাকায় তা শতকরা ২৫ ভাগের কম। আমি আমেরিকায় ২৪ ঘণ্টায় যতটুকু কাজ শেষ করতে পারি, ঢাকায় তার খুবই সামান্য করতে পারি। এটাই বাস্তবতা। সেই বাস্তবতায় রাজপথে নামলে, আরও সময় শেষ। আমি দূর থেকে দেখেছি, ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠানটি ভাল হয়। তবে আগে কখনও যাওয়া হয়নি। এবারে সিআরআইয়ের সঙ্গে জড়িত জনৈক বন্ধু দাওয়াত দিল। অভিজ্ঞতা অর্জন এবং শুক্রবার বিকেল বলে রাজি হয়ে গেলাম। ঢাকায় মাঝে মাঝে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেইÑ ভিজিটিং শিক্ষক হিসেবে। তার মূল কারণ হলো, তরুণদের জানা, তাদের ইমোশনকে বোঝার চেষ্টা করা, তারা কিভাবে বেড়ে উঠছে সেটা দেখা। এই অনুষ্ঠানটিতে যেহেতু অসংখ্য তরুণ-তরুণী আসবে, তাদের ভাবনাগুলো দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই প্রচ- বৃষ্টির মধ্যেও যথাসময়ে হাজির হলাম। ২. আগেই বলেছিলাম, অনুষ্ঠানটির মান নিয়ে আমার বেশ উচ্চ ধারণা ছিল। মিলনায়তনে গিয়ে সেই ধারণা আরও পরিষ্কার হলো। বাইরের রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ভেতরের সাজসজ্জা, ডিজাইন, সেট, পরিবেশ- প্রশংসা করতে হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ অনুষ্ঠান খুব এলোমেলো হয়। এখানে সেটা হয়নি। এমনকি স্বেচ্ছাসেবক দলটিও বেশ চটপটে। যারা এই অনুষ্ঠানটি এতটা সময় ধরে করে আসছেন, তারা প্রশংসার দাবিদার। যথাসময়ে মূল অতিথির আসন নিলেন সজীব ওয়াজেদ। তারপর অনুষ্ঠানের শুরুতে দেখানো হলো একটি ভিডিও। ওখানে অনেক তথ্য দেয়া হলো, যার অনেক কিছু আমারও জানা ছিল না। সেই তথ্যমতে, বাংলাদেশ হলো বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতি। শতকরা ৮০ ভাগের মতো ছেলেমেয়েরা প্রাইমারী স্কুল শেষ করতে পারছে এবং গত ১০ বছরে চাকরির বাজার বড় হয়েছে শতকরা ৪০ ভাগের মতো। এগুলো নিশ্চই বড় অর্জন। আর সে কারণেই বাংলাদেশ উঠে এসেছে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। মিলেনিয়াম টার্গেটে যে পয়েন্টগুলো দেয়া হয়েছিল, তার ভেতর সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সবার আগে অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। এই তথ্যের সঙ্গে আরেকটি ব্যক্তিগত তথ্য যোগ করেন সজীব ওয়াজেদ। তিনি ইংরেজী/বাংলা মিশিয়ে যে কথাগুলো বলেন, তার অর্থ হলোÑ এই উন্নতির স্বপ্ন দেখেছিলেন মাত্র একটি মানুষ। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি হলেন তারা মা বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী। গত ওয়ান/ইলেভেন সরকারের সময় যখন শেখ হাসিনা বন্দী ছিলেন, তখন জেলখানায় বসে বসে এই সকল পরিকল্পনা করেন তিনি। তথ্যটি আমার কাছেও নতুন। তবে একটি বিষয় ভেবে কেমন যেন লাগল। রাজনীতিবিদদের জীবনÑ কখনও জেলখানা, পরমুহূর্তেই রাজপ্রাসাদ। এত বৈপরীত্য আর কোন প্রফেশনে আছে কিনা জানি না। আরেকটি বিষয় ভেবেও কোন ভাল উত্তর পেলাম না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জেলখানায় যেতে হতো যখন ভিনদেশীরা এই মাটি শাসন করত। কিন্তু স্বাধীন দেশের একজন রাজনীতিবিদকে কেন জেলখানায় দিন কাটাতে হবে, তার উত্তর এই দেশের মানুষকে অনেক দিন ধরে খুঁজতে হবে। যেমন এখনও জেলে আছেন অনেক রাজনীতিবিদ। নিজ দেশে যখন মানুষের রাজনীতি করার অধিকার তৈরি হবে, সেদিন বাংলাদেশ অনেকটা পথ এগিয়ে যাবে। তার আগ পর্যন্ত, আমাদের নিজেদের সঙ্গে নিজেদের যুদ্ধ চলতেই থাকবে, যেই যুদ্ধের কোন নিয়ম-নীতি নেই। যখন যিনি ক্ষমতায়, তখন তার নীতিই সঠিক নীতি। হ্যালো বাংলাদেশ, অনেকটা পথ তোমাকে হাঁটতে হবে। অনেকটা পথ! ৩. বাংলাদেশে যে সকল অনুষ্ঠানে ক্ষমতাশালী মানুষজন থাকেন, তাদের সামনে যাদের কথা বলতে দেয়া হয়, তাদের বেশিরভাগকেই ভাড়া করে আনা হয়। সেই ভাড়া করা মানুষগুলো কী প্রশ্ন করবে, কিভাবে কথা বলবে, সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকে। একবার একটি লাইভ অনুষ্ঠানে দেখলাম একটি স্কুলের ছাত্র কাগজে লেখা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে প্রশংসা করছে। বেচারা ছোট মানুষ। ঠিকমতো পড়তেও পারছিল না। কিন্তু তাকে দিয়ে পড়ানো হলো ৫০ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মুখের কথা, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভাষা। হয়ত এলাকার কোন সরকারী কর্মকর্তা সেই স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, এখানেও তাই হবে। এখানে যেহেতু বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়েছে, তাই তাদের হয়ত আগে থেকেই প্রশ্নগুলো ঠিক করে দেয়া হবে, যেন সজীব ওয়াজেদ সাহেব খুশি হন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই ছাত্রছাত্রীরা অকপটে কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করতে শুরু করে। দু’-একটির উদাহরণ দেয়া যাক। ক) কুড়িগ্রাম থেকে আসা এক তরুণ বলল, ওখানে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সরকার কেন এটা বন্ধ করতে পারছে না? খ) পার্বতীপুর রেলওয়েতে কিছু লোক নিয়োগ করা হয়েছে। সেই নিয়োগে প্রত্যেককে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে এবং সেটা হয়েছে সবার সামনেই। সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে কেন এভাবে ঘুষ দিতে হবে? গ) ময়মনসিংহের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে মিউজিকের ওপর লেখাপড়া করছেন এক ছাত্রী। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মিউজিক থেকে পাস করে কোথাও চাকরির জন্য আবেদন করলে চাকরি তো পাওয়া যায় না, উপরন্তু ক্ষেত্রবিশেষে অপমানের শিকার হতে হয়। সরকার কি কোন ব্যবস্থা নিতে পারে? ঘ) বাংলাদেশের ডাক্তাররা রোগীকে যত্রতত্র এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে থাকেন এবং এগুলো ফার্মেসিতে উন্মুক্ত কেনা যায়। এটা সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্ষতিকর। কিভাবে বন্ধ করা যাবে? ঙ) ঢাকার বিআরটিসি বাসে অনেক ঘটা করে ফ্রি ওয়াই-ফাই লাগানো হলো। কিন্তু এখন সেগুলো কাজ করছে না। এমন কেন? চ) বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেলে অনেক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে পারবে কিনা? ছ) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভ্যাট বসানো হয়েছে। তা তুলে নেয়া যায় কিনা? উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে অনেক মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তাদের সামনেই মন্ত্রণালয় নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। সরাসরি অভিযোগ করতে আমি আগে দেখিনি। জয় সাহেবকে দেখলাম সেগুলোর নোট নিতে। কিছু কিছু প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিলেন। যেমন, বাংলাদেশের বিশাল বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ এখন বিদেশী সাহায্যনির্ভর। তাই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেখানে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে হয়েছে, তাদের পুরো নাম, ঠিকানাসহ লিখিত অভিযোগ করতে বললেন। সেগুলো তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাসে ওয়াই-ফাই সমস্যাটিকে প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদের দিকে ছুড়ে দিলেন। সব কিছু মিলিয়ে মনে হয়েছে, তরুণদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির জন্য বেশ ভাল একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছেন তিনি। অনুষ্ঠানটি আবার দুটি টিভি চ্যানেলে লাইভ দেখানো হয়েছে এবং পরবর্তীতে ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। তাতে দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সেই বক্তব্য। অনুষ্ঠান করতে নিশ্চয়ই অনেক খরচ হয়েছে। তবে সেই খরচ করাটা তাদের কাজে আসছে বলা যায়। ৪. সজীব ওয়াজেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই। মাঝে মধ্যে কোথাও দেখা হয়, এই যা। কখনও সিলিকন ভ্যালিতে, কখনও ঢাকায়। তবে আমি তার একজন ক্রিটিক। আগে যখন নিয়মিত লিখতাম, তার অনেক সমালোচনা করেছি। তার মূল কারণটি ছিল, তিনি যা-ই বলতেন, কিংবা করতেন সেটাকে মিডিয়া দেখাত ‘প্রধানমন্ত্রীর পুত্র’ হিসেবে। এমনকি কিছুদিন আগেও তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো ‘প্রধানমন্ত্রীর পুত্র’ বলে। আমি মনে করি, এটা কারও মূল পরিচয় হতে পারে না। অনেক মিডিয়া তাকে লিখত ‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা’, ‘প্রধানমন্ত্রীর টেলিকম উপদেষ্টা’, ‘প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা’ ইত্যাদি বলে। কারণ, তিনি কখনই বিষয়টি পরিষ্কার করেননি। সম্প্রতি তিনি সরকারের একটি পদ নিয়েছেনÑ প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা। এবারে বিষয়টি অনেক সহজ হয়েছে। মানুষ পরিষ্কার করে জানতে পারছে, তার ভূমিকাটা কী। এই কাজটি আরও আগেই করা উচিত ছিল। এই কলাম যখন লিখতে শুরু করেছি, তখন ভূমিকায় একটি কথা আমি বলেছিলাম যে, বাংলাদেশের মানুষ এখনও গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। বাংলাদেশের মানুষ এখনও শেখেনি, কিভাবে সম্মান রেখে যুক্তি আর তথ্য দিয়ে বিতর্ক করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ এখনও চরম পদলেহন, নয়ত চরম বিরোধিতা- এই দুইয়ের মধ্যে আটকে আছে। দেখবেন, বেশিরভাগ মানুষ যখন কোথাও মন্তব্য করে, তারা খুবই মূর্খের মতো এসে হৈ হৈ করে নোংরা ভাষায় মন্তব্য করতে থাকে। এগুলো চরমপন্থী মানুষ। এরাই বাংলাদেশে বেশি। এটা থেকে বের হতে আরও কয়েক জেনারেশন লেগে যাবে। তার আরও একটি বড় কারণ হয়ত ব্রেইন ড্রেইন। বাংলাদেশের খুব বড় একটি মেধাবী অংশ দেশে থাকছে না। তারা এই সিস্টেম থেকে পোকা-মাকড়ের মতো ছিটকে বাইরে চলে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানটিতে বুয়েটের একটি মেয়ে এই প্রশ্নটি তুলেছিল। সে জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা যদি ব্রেইন ড্রেইন ঠেকাতে না পারি, তাহলে উন্নতি হবে কিভাবে? অনুষ্ঠান সঞ্চালক জয় সাহেবের কাছে জানতে চাইছিলেন, এই প্রশ্নটির উত্তর পরের সেকশনের জন্য বেশি প্রযোজ্য। তাই এর উত্তর পরের সেকশনে দেয়া হবে নাকি এখনই দেয়া হবে? জয় ঘরোয়া বাংলায় বলে উঠলেন, ‘এইটা এখনই বইল্যা ফালাই।’ দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলে যা হয়। ইংরেজীটা ভাল হয়ে যায়, বাংলার দখল অনেকটা কমে আসে। (আমারও প্রায় একই অবস্থা)। সজীব ওয়াজেদ জয় তার উত্তরে বললেন, ‘আমি নিজেও ব্রেইন ড্রেনের শিকার। আমি নিজে বাইরে পড়তে গিয়েছিলাম। তারপর ওখানেই থেকে গিয়েছি। ওখানে যে বেতন দেয়া হয়, আমরা এখনও তা দিতে পারি না।’ এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশ এখন সেই জায়গায় পৌঁছায়নি, যখন হাজার হাজার প্রকৌশলী কিংবা ডাক্তারকে বিদেশের মতো বেতন দিতে পারে। শুধু কি বেতন? জীবনের আরও যে বিষয়গুলো আছে, তা থেকে বাংলাদেশ এখনও অনেক দূরে। আমি মনে করি, সবচে বেশি দূরে হলো মানসিকতা। আমরা খুব সন্দেহপ্রবণ জাতি। যে মানুষের নিজের ওপর বিশ্বাস কম, বাস্তবে তারা অন্যকেও কম বিশ্বাস করে। নিজে চোর হলে, খুব সহজেই সবাইকে চোর ভেবে ফেলে; আসল নামাজীর সংখ্যা খুবই কম। আমাদের ওই মানসিকতার যখন উন্নয়ন হবে, আমরা যখন মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখব, নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখবÑ তখন হবে প্রকৃত উন্নয়ন। তখন দেশ একটি ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছবে। ৫. পুরো দু’ঘণ্টার লাইভ অনুষ্ঠানে অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। তবে পুরো অনুষ্ঠানের ভেতর সবচেয়ে শক্ত যে ম্যাসেজটি তিনি প্রচার করছেন তাহলো, উন্নয়নের গতি ঠিক রাখতে এই সরকারকে আরও কয়েক টার্ম ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে। তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই প্রসঙ্গ আনেন এবং খুব সুন্দর করে এর সপক্ষে তার যুক্তি তুলে ধরেন। যেমন তিনি একটি টিভি অনুষ্ঠানের সাক্ষাতকারের সূত্র দিয়ে বলেন, সেখানে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মালয়েশিয়া একজন মাহাথির পেয়েছে, সিঙ্গাপুর একজন লি কুয়ান ইউ পেয়েছে, বাংলাদেশ তার যোগ্য নেতৃত্ব কবে পাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তো তার যোগ্য নেতৃত্ব পেয়ে গেছে। আর সেটা হলেন আমার মা শেখ হাসিনা।’ এর সঙ্গে যুক্তি হিসেবে তিনি যোগ করেন, মাহাথির টানা চারবার ক্ষমতায় ছিলেন। লি কুয়ান ইউ ত্রিশ বছরের মতো ক্ষমতায় ছিলেন। ‘আমার মা’কে যদি এই দেশের মানুষ চারবার ক্ষমতায় রাখে, তাহলে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে।’ যুক্তরষ্ট্রে প্রবাসী সজীব ওয়াজেদ সেখানকার একটি উদাহরণও টেনে আনেন। তিনি বলেন, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট একটানা চারটা টার্মে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তখন আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। রুজভেল্টের নেতৃত্বে আমেরিকা সেই কষ্টকর সময় থেকে বের হয়ে আসে। সজীব ওয়াজেদ জয় মনে করেন, বাংলাদেশও এখন তেমন একটি অবস্থা পার করছে। তাই এই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে এ সরকারকে আরও সময় দিতে হবে। আরও কয়েক টার্ম ক্ষমতায় রাখতে হবে। ইন্টারেস্টিং! ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ছিলেন আমেরিকার ৩২তম প্রেসিডেন্ট। তিনি হলেন আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি চারটি টার্মে নির্বাচিত হন। আমেরিকায় প্রচলন হলো, এক ব্যক্তি তার জীবনদশায় দুটি টার্মের বেশির প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। বিশেষ অবস্থার কারণে সেই প্রচলন ভাঙতে হয়েছিল তাদের। ৪ মার্চ, ১৯৩৩ থেকে ১২ এপ্রিল ১৯৪৫ এই সুদীর্ঘ ১২ বছর তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন আমেরিকার চরম মন্দা ছিল। রুজভেল্ট দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে নানা ধরনের প্রোগ্রাম নিয়েছিলেন। তবে, ১৯৪৭ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান প্রস্তাব করেন যে, কোন ব্যক্তি দুই টার্মের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। সেই সময়ে অনেকেই মনে করতে থাকেন যে, দুই টার্মের বেশি ক্ষমতায় কাউকে রাখলে তা রাজতন্ত্রের মতো হয়ে যেতে পারে। ২১ মার্চ ১৯৪৭ সালে ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একই কারণে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে (৩০ এপ্রিল, ১৭৮৯ থেকে ৪ মার্চ, ১৭৯৭) যখন ৩য়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন তিনি নিজ থেকেই তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাই তিনি এমন কিছু উদাহরণ তৈরি করতে চাননি, যা পরের প্রেসিডেন্টরা অনুসরণ করবেন। এমনকি তাকে যখন ২৫ হাজার ডলার বেতন নেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল, তখন তিনি সেটাও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার নিজের চলার মতো যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে। তাই আমার কোন বেতনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে বলা হলো যে, ওয়াশিংটন যদি বেতন না নেন, তাহলে এমন একটি উদাহরণ তৈরি হয়ে যাবে যে, কেবল ধনী ব্যক্তিরাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারবে। মহাবিপদ। জর্জ ওয়াশিংটন বেতন নিতে রাজি হলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক নেতারা দলের বাইরে এসে যে কোন ইস্যুতে বিতর্ক করতে পারবেন এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মতামত রাখতে পারবেন। তাহলে বলা যেতে পারে, বর্তমানের বাংলাদেশ এখনও রুজভল্টের সময়ে (১৯৪৫) রয়ে গেছে। আর প্রশ্ন করা যেতে পারে, ১৭০০ সালের শেষ দিকে জর্জ ওয়াশিংটন রাষ্ট্র নিয়ে যেভাবে ভাবতে পেরেছিলেন, ঠিক সেভাবে আমরা কবে ভাবতে পারব? আমার ধারণা, সেটা এই শতকে নয়; ২১০০ সালে কোন এক সময় হবে। তখন আমি থাকব না। যারা থাকবেন, মিলিয়ে দেখবেন একটু! গুড লাক, বাংলাদেশ! ৩১ জুলাই ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং প্রধান নির্বাহী, প্রিয়.কম ই-মেইল : ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×