ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের মাস

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২ আগস্ট ২০১৫

শোকের মাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো/ যদি বাঙালী হও নিঃশব্দে কাছে এসো, আরও কাছে/... এখানেই শুয়ে আছেন অনন্ত আলোয় নক্ষত্রলোকে/ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/ মৌমাছির গুঞ্জনের পাখির কাকলিতে করুণ সুর বাজে/ গভীর অরণ্যে পুষ্পের সুগন্ধে/... অনেক রক্তের মূল্যে পাওয়া এ স্বাধীনতা/ এখানে ঘুমিয়ে আছে, এইখানে দাঁড়াও শ্রদ্ধায়...।’ কবি রবীন্দ্র গোপ তাঁর ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো’ কবিতায় এভাবেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রক্তাক্ত-কলঙ্কিত আগস্টের ৪০ দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচীর সূচনা দিন শনিবার ঢাকাসহ দেশব্যাপী ছিল শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ। সর্বত্র শোকের কালো পতাকা। হাতে হাতে জাতির জনকের ছবি। বুকে কালোব্যাজ। স্বেচ্ছায় রক্তদান করে স্বাধীনতার স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা। আলোক শিখা প্রজ্বলন করে দৃপ্ত শপথে পলাতক খুনী, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-ধিক্কার, অসংখ্য শোক মিছিলের মাধ্যমে পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর এবং খুনীদের মদদদাতাদেরও বিচারের আওতায় আনার সোচ্চার দাবি। ঢাকায় প্রতিকৃতিতে ফুল দেয়ার পর টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিতে সব পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে আগস্টের দীর্ঘ কর্মসূচী সূচনা করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। আওয়ামী লীগসহ অগণিত সংগঠন নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করেছে শোকের কর্মসূচীর প্রথম দিন। ‘দ্রোহের আগুনে পুড়ে হোক ছারখার, যতসব বঙ্গবন্ধুর খুনী-যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার’Ñ এই সেøাগানে আগস্টের প্রথম প্রহর ১২টা ১ মিনিটে ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে হাজারো মোমবাতি প্রজ্বলন, আলোর মিছিলের মাধ্যমে শোকের মাসব্যাপী কর্মসূচীর সূচনা করে আওয়ামী লীগসহ তার সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের পর জঙ্গী-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ গঠনের দৃপ্ত শপথে হাজারো নেতাকর্মী প্রজ্বলিত আলোক শিখা নিয়ে মিছিলও করেছেন। অসংখ্য সংগঠন প্রথম প্রহরেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের গৃহীত ৪০ দিনব্যাপী কর্মসূচীর প্রথম দিন ভিন্নমাত্রার কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। শনিবার প্রথম প্রহরে ধানম-িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে এবং প্রতিকৃতিতে ফুল দেয়ার পর সকালে দলীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে টুঙ্গিপাড়ায় রওনা হন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সকল সদস্য, উপদেষ্টাম-লীর সদস্য এবং মন্ত্রী-এমপিরা। দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছে প্রথমে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ফুল দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও। কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে আয়োজিত মিলাদ মাহফিলেও অংশ নেন। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আগস্টের প্রথম দিন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানম-ির ৩২ নম্বর বাসভবনের সামনে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী ও আলোচনা সভার আয়োজন করে কৃষক লীগ। আর এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশবাসীর অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন। আলোচনা সভার পর কৃষক লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজের দেহ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান জানিয়ে এক ব্যাগ করে রক্তদান করেন। বঙ্গবন্ধুর মুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শোকের মাস আগস্টের কর্মসূচী শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মসূচীর প্রথম দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে শিক্ষক, চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর মুরালে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কর্মসূচী পালন শেষে ঘোষণা করা হয়, শনিবার থেকে আগস্ট মাসজুড়ে সন্ধ্যায় ৪০টি করে মোমবাতি বঙ্গবন্ধুর মুরালে প্রজ্বলন করা হবে। একই সঙ্গে আলোচনা সভা, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল্লাহ সিকদার, অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রুহুল আমিন মিয়া, ডিন অধ্যাপক ডাঃ শারফুদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ডাঃ আলী আসগর মোড়ল, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডাঃ আসাদুল ইসলাম, প্রক্টর অধ্যাপক ডাঃ হাবিবুর রহমান দুলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও সংক্ষিপ্ত শোক র‌্যালি করেছে জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট। সংগঠনের সভাপতি সালাউদ্দিন বাদলের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑ বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল কাদের, আলিমুজ্জামান আলম প্রমুখ। বক্তারা সমাবেশ থেকে জ্বালাও-পোড়াও, বোমা মেরে মানুষ হত্যা বন্ধ এবং শোকাবহ ১৫ আগস্টে মিথ্যা জন্মদিন পালন না করার জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বই ছিল ঘটনাবহুল - আনিসুজ্জামান ॥ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বই ছিল ঘটনাবহুল। প্রথমে বিপ্লবী দলের প্রতি ছিল তাঁর সম্মোহন এবং পরবর্তীতে সুভাষ বসুর রাজনৈতিক পন্থার প্রতি আগ্রহ ক্রমান্বয়ে মোড় নিয়েছে বাংলা ও বাঙালীকে ঘিরে স্বতন্ত্র-স্বাধীন কর্মপন্থায়। ১৯৪৮ সালে ভাষা সংগ্রামের প্রথম পর্যায় থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাঙালীর মুক্তির দাবি সংযোজনের সংগ্রাম, সামরিক শাসন প্রত্যাহারের আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ, সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়, একাত্তরের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি সকল কর্মপ্রবাহে আমরা দেখব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সব সময় বাঙালীর জাতির সার্বিক মুক্তির পথকে প্রশস্ত করতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শনিবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বক্তৃতায় এসব কথা বলেছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ওই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, বস্তুত ৭ই মার্চের ভাষণেই ব্যক্ত ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৬ মার্চে তিনি যে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন তার ঐতিহাসিক প্রমাণাদি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যারা তা মানতে চায় না তারা ইতিহাসের সত্যকেই অস্বীকার করে। স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ের ক্ষমতাকালে একটি আদর্শ সংবিধান প্রণয়ন এবং শিক্ষা-শিল্পবাণিজ্য-পররাষ্ট্র ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। ঘাতকের গুলিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হয় তেমনি পরিত্যক্ত হয় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমির পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে এই বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার বিকেলে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু স্মরণে একক বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধু এবং পনেরোই আগস্টের সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারের কণ্ঠে ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমপি এবং ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু। সভাপতির বক্তৃতায় অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁর চেতনাপথেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের উন্মোচনে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা সময়ের দাবি। স্বাগত বক্তৃতায় শামসুজ্জামান খান বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির রাষ্ট্রস্বপ্নের সার্থক রূপকার। বাঙালী জাতির হাজার বছরের স্বাধীনতার বাসনাকে তিনি ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ দান করেছেন। দেশ-বিদেশের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ সঙ্গত কারণেই তাঁকে রাজনীতির কবি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী এবং বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
×