ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছিটমহলবাসীদের গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১ আগস্ট ২০১৫

ছিটমহলবাসীদের গল্প

রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম ॥ উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ের সীমান্ত এলাকায়। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম,লালমনিরহাট ও নীলফামারী ছিল ব্রিটিশ জেলা রংপুরের অন্তর্ভুক্ত, আর পঞ্চগড় ছিল ব্রিটিশ জেলা দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, ভারতীয় ভূখন্ডে বর্তমানে ছিটমহল রয়েেেছ পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলায়। ছিটমহলগুলোর কোনোটিরই প্রাথমিক উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক করে তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও ছিটমহল নামের বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডগুলোর প্রাথমিক উৎপত্তি হয়েছিল প্রাক বৃটিশ সময়েই, তবে এই বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডগুলো প্রকৃত অর্থে ছিটমহল হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের হাত দিয়েই। প্রাথমিকভাবে এসবের উৎপত্তি হয়েছে অনিয়মিতভাবে, নানা পরিপ্রেক্ষিতে। জনশ্রুতি আছে, এ অঞ্চলের রাজন্যবর্গ ভ্রমণ বা শিকারের উদ্দেশ্যে রাজকীয় অতিথি হিসেবে প্রতিবেশী কোনো রাজ্যের অভ্যন্তরে গিয়ে কোনো স্থানে তাঁবু খাটালে তার প্রতি সম্মাান দেখিয়ে সেই এলাকাটি তাকে উপঢৌকন দেওয়া হতো। সুতরাং, উপঢৌকনের মতো বিভিন্ন ঘটনাবলির মাধ্যমেও এসব বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে ছিটমহলে পরিণত হয়েছে। কুচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্থানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কুচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখন্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখন্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হচ্ছে ছিটমহল। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল অখন্ড ভারত বিভক্ত করে ভারত এবং পাকিস্থান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লগ্নে ১৯৪৭ সালে রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব ছিটমহলের। এক দেশের ভূখন্ডে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। এতে এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার উদ্ভব হয়। ১৬২ টি ছিটমহল আছে দুই প্রতিবেশী দেশে। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে। এসব ছিটমহলে বসবাসকারী জনসংখ্যা সংখ্যা ৫১ হাজার। ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী ভারতের ছিটমহলে বসবাসরত লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার এবং বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ১৪ হাজার। ২৪২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দুই দেশের ছিটমহল। তার মধ্যে ভারতের ১৭ হাজার ১৫৮ একর। বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ সবের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ ও নীলফামারিতে চারটি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কুচবিহার ও চারটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। ছিটমহলের পরিসংখ্যান ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত প্রান্তসীমার মাত্র কয়েক মিটার দূরত্ব থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবচেয়ে ছোট ছিটমহলের আয়তন শূন্য দশমিক ২৭ একর, যেখানে কোনো জনবসতি নেই। অন্যদিকে, সর্ববৃহত ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার আয়তন ৩৮৭৭ দশমিক ০৫ একর এবং এখানকার জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক ছিটমহল একই সঙ্গে অবস্থিত। যেমন: পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জের চারটি ছিটমহল শালবাড়ী, নাটকটোকা, বেওলাডাঙ্গা ও কাজলদিঘি একই সঙ্গে অবস্থিত। এসব ক্ষেত্রে একাধিক ছিটমহল একটি মৌজায় অর্ন্তভূক্ত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি বড় ছিটমহল একাধিক মৌজায় বিস্তৃত। বাংলাদেশের ভূখন্ডে ১৩০টি ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতের ভূখন্ডে ৯৫টি বাংলাদেশি ছিটমহল দাবি করা হয়। সেসব তালিকায় অবশ্য ছিটমহলগুলোর জটিল আকার, আয়তন ও মিশ্রণ-সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। ছিটমহল-অধ্যুষিত মৌজাগুলোর ম্যাপ ও ছিটমহলের প্রাপ্ত তালিকা বিশ্লেষণ করে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত বেশ কিছু ভারতীয় ছিটমহল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, যেসব ছিটমহল একাধিক মৌজায়বিস্তৃত, সেগুলোর ক্ষেত্রে একটি ছিটমহলকে প্রতিটি মৌজার নামে আলাদাভাবে একাধিক ছিটমহল হিসেবে গণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় ছিটমহলের প্রাপ্ত তালিকায় অনেক কোচবিহার ছিটমহলের নাম রয়েছে, যেগুলো আসলে জলপাইগুড়িতে অবস্থিত ছিল এবং ১৯৫২ সালে জলপাইগুড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় পাওয়া এমন কয়েকটি ছিটমহল হচ্ছে শাখাতি (জে এল নম্বর ৬৮), শাখাতি (জে এল নম্বর ৬৩), শাখাতি (জে এল নম্বর ৬২), বিন্নাগুড়ি (জে এল নম্বর ৬১), বিন্নাগুড়ি (জে এল নম্বর ৮১), দৈখাতা (জে এল নম্বর ৩৯) ও দৈখাতা (জে এল নম্বর ৪০)। অহস্তান্তরযোগ্য প্রতি ছিটমহলের ধারণাও ছিটমহলের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যেভাবে শুরু হয়েছিল আন্দোলন ভারতীয় ভুখন্ডে রয়েছে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল। এই ছিটমহলের অবস্থান পশ্চিম বঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীন হলেও কোচবিহার ভারতের অন্তভুর্ক্ত হয়নি। কোচবিহার ছিল রাজ্য শাসিত পৃথক রাজ্য। ১৯৪৯ সারের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহারের রাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারকে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তভুর্ক্ত করার একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯৫০ সালের ১জানুয়ারী কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ভারত স্বাধীন হলেও ছিটমহলের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে থাকে। বারবার এই ছিটমহল বাসীর নানা সমস্যার কথা তোলা হলেও তৎকালীন পাকিস্থান সরকার এ ব্যাপারে কোনো যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়নি। সমস্যা সমাধনের লক্ষ্যে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে তিনটি চুক্তি করলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ছিটমহলবাসীর মুক্তির একমাত্র পথ ছিটমহল বিনিময়- এই শ্লোগান তুলে ছিটমহল বিনিময়ের প্রথম দাবী তোলেন দিনহাটার সাবেক বিধায়ক প্রায়ত দীপক সেনগুপ্ত। তিন্ইি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি। ২০০০ সাল থেকে এই দাবীর সমর্থনে গড়ে তোলেন তীব্র আন্দোলন। দীপক সেনগুপ্ত ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ফরোয়ার্ড ব্লোকের বিধায়ক ছিলেন কোচবিহারের সিতাই কেন্দ্রের। এর পর এই আন্দোলনের হাল ধরেন তার পুত্র দীপ্তিমান সেন গুপ্ত। তিনি এখন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির যুগ্মসম্পাদক (ভারত অংশের)। বাংলাদেশ অংশে ভারত- বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা। এর পর দু দেশের নেতারা ছিটমহল বিনিময় আন্দোলন জোরদার করেন। আনন্দে ভাসছে ছিটবাসী বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরের ১৬২ ছিটমহলে এখন আনন্দের বন্যা। বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দে উদ্বেলিত অর্ধ লক্ষাধিক ছিটমহলবাসী।দীর্ঘ দিনের বন্দি জীবনের অবসানের আনন্দে আতœহারা ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সম্বšয় কমিটির কেন্দ্রীয় অফিসের কেন্দ্রীয় নেতারা তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় জানান তাদের ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ ছিটমহলবাসী মুক্তির স্বাদ পেল। তারা বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা এবং ভঅরতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানান কি ভাবছেন ছিটবাসীরা ভারতীয় ১৫০ দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের কালীরহাট গ্রামের পঞ্চাশ উর্ধ্ব কৃষক মনির উদ্দিন সোমবার দুপুরে বাড়ী থেকে বাজার যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তার সাথে দেখা। তিনি জানান দীর্ঘদিন পর আমাদের এ দাশিয়ারছড়া ছিটমহল বাংলাদেশ হওয়ায় ভীষণ খুশি তিনিসহ সকল ছিটবাসী। তিন তার জীবনের করুন কাহিনী বলেন। তখন ১৯৭০ সাল। তার বাবা সরিয়ত উল্লা এই ছিটের অধিবাসী হওয়া সত্বেও পাকিস্থান বিরোধী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষকে সংগঠিত করতেন। এটি ছিল তার অপরাধ। এ কারণে দুষ্কৃতরা তাকে জবাই করে হত্যা করেছিল। তখন তার বয়স ছিল ১০ বৎসর। কিন্তু ছিটেরবাসী হবার কারনে তার বাবার হত্যার বিচার আজও পায়নি। এখন আমরা আইনের শাসন পাব। পাশে দাড়িয়ে ছিলেন রাসমেলা গ্রামের কৃষক আবদুস সামাদ (৫৬)। তিনি জানান এতদিন পর মনে হচ্ছেআমাদের মাথা গোজার ঠাঁই হলো। আমাদের সন্তানরা এখন শিক্ষা পাবে। গড়ে উঠবে চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। তিনি আক্ষেপ করে বললেন এক মাস আগেও আমার ভাইএর স্ত্রীকে এক প্রতিবেশী বিনা অপরাধে আহত করে ছিল। শুধু ছিটের নাগরিক বলেই ফুলবাড়ী হাসপাতালে ভর্তি নেয়নি। বাধ্য হয়ে ঠিকানা গোপন রেখে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে চিকিৎসা করি।
×