ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গান ও কথায় তাজউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১ আগস্ট ২০১৫

গান ও কথায় তাজউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের এক অনন্য চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদ। নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসাধারণ এক দেশপ্রেমিকের কীর্তিগাঁথা। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের কা-ারী হয়ে ওঠেন এই জননায়ক। নয় মাস অপরিসীম শ্রমে পালন করেন রণাঙ্গন পরিচালনার দায়িত্ব। দেশপ্রেম, সততা, মেধা ও যোগ্যতার মেলবন্ধনে বাঙালীর স্বপ্নের রাষ্ট্র বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন মহান এই নেতা। গত ২৩ জুলাই ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবিস্মরণীয় এই নেতার ৯০তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে শুক্রবার শ্রাবণের বৃষ্টিঝরা বিকেলে জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। গানের সুরে সুরে নিবেদন করা হয় জন্মবার্ষিকীর ভালবাসা। বক্তাদের আলোচনায় বলা হয় তাজউদ্দীনের বর্ণময় জীবনের কথা। পাঠ করা তাঁর ডায়েরি থেকে। সঙ্গে ছিল তাঁর মহিমান্বিত জীবনভিত্তিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এভাবেই হৃদয়ের ভালবাসায় রকমারি আয়োজনে উদ্্যাপিত হয় মহান নেতার জন্মদিন। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় গানের সুরে। তাজউদ্দীনকে নিবেদন করে সঙ্গীত-শ্রদ্ধাঞ্জলি পরিবেশন করেন নবনীতা জাইদ চৌধুরী অনন্যা। জননায়ককে হৃদয়ে লালন ও ধারণের অভিপ্রায়ে সুললিত কণ্ঠে গেয়ে শোনান মরণ সাগর পাড়ে তোমরা অমর, তোমাদের স্মরি...। সুর থামতেই শুরু হয় তাজউদ্দীনকে নিবেদিত আলোচনা সভা। সূচনা বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী। আলোচনায় অংশ নেন তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি, বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম ও বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে পাঠ করেন মহিউদ্দীন শামীম ও সৈয়দ শহীদুল ইসলাম নাজু। সব শেষে সমবেত ছিল সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সমবেত সঙ্গীত পরিবেশনা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিশিল্পী রফিকুল ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে নিজের পরিচয়ের স্মৃতিচারণ করে সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, একাত্তরের আগে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিল না। প্রথম পরিচয় হয় ঐতিহাসিক সাতই মার্চে। তখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। আমরা তখন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ নামের সংগঠন গঠন করি। ওই রাতে আমাদের করণীয় প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের জন্য আমরা তাঁর বাসভবনে যাই। বঙ্গবন্ধু তখন তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। এরপর ২৫ মার্চের পর আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এরপর মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার আমরা সবাই আবার কলকাতায় মিলিত হলাম। ওই সময় ৫ এপ্রিল আবার কলকাতায় দেখা হলো তাজউদ্দীনের সঙ্গে। তিনি তখন থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে, আমিও তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ পাঠসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নানা কার্যক্রম করছি। দুটি কার্যালয় পাশাপাশি হওয়ায় প্রতিদিনই আমাদের দু’জনের দেখা এবং কথা হতো। এ সময় বিভিন্ন বিষয়ের তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার কথা হতো। এই মহান মানুষটির আবেগ ছিল ভীষণ অন্তর্মুখী। ভেতরে অনেক আবেগ চাপা দিয়ে রাখলেও কখনও প্রবলভাবে প্রকাশ করতেন না। সেই সময়ের একটি ঘটনার উল্লেখ করে হাসান ইমাম বলেন, তাজউদ্দীন শপথ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবেন না। অথচ প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ের খুবই কাছেই একটি বাড়িতে বসবাস করত তাঁর পরিবার। তারপরও তিনি কখনই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন না। এমনকি ছেলে সোহেল তাজ অসুস্থ হওয়ার খবর জানানো হলেও তিনি যেতে রাজি হলেন না। অবশেষে চিকিৎসকের অনুরোধে মুহূর্তের জন্য ছেলেকে দেখে আবার কার্যালয়ে ফিরে এলেন। এরপর দেশ স্বাধীনের আগে পর্যন্ত আর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি। অথচ সে সময় প্রবাসী সরকারের অন্যসব মন্ত্রী কলকাতায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। দেশপ্রেমিক এমন এক মহান মানুষ আমরা আর পাবো কিনা জানি না। সাধারণের মধ্যে এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন। হাসান ইমাম আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীনের আনুগত্য ছিল অসীম। এটা বোঝা গিয়েছিল তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুর বাবা মারা গেলে তাজউদ্দীন ঠিকই সেদিন জাতির জনকের পাশে বসে তাঁকে সান্ত¡না জানিয়েছিলেন। অথচ খন্দকারের মোশতাকের মতো কিছু লোক তাজউদ্দীন সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। সিমিন হোসেন রিমি বলেন, তরুণ বয়স থেকেই ডায়েরি লিখতেন তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশিরভাগ ডায়েরি হারিয়ে যায়। বাংলাবাজার থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁর ১৯৫৪ সালের লেখা ডায়েরিটি। সেটি আমি অনুবাদ করি এবং সেটা এখন ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর সব কথা কিংবা বক্তৃতায় রয়েছে জাতির প্রতি নানা দিকনির্দেশনা। মানুষকে আকৃষ্ট করার এক অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তাঁর। হয়তো তিনি কোথাও আধা ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছেন। অনুরোধ আসতো আরও দীর্ঘ সময় বক্তৃতার অনুরোধ আসতো। এমন হয়েছে মাগরিবের নামাজ শেষ করে কোথাও হয়তো রাত সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্তও বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি কথা বলেছেন পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য নিয়ে, প্রাথমিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন ৪০ টাকা নির্ধারণ করা নিয়ে। ১৯৫৪ সালের বন্যার সময় একটি শিল্পীদল গঠন করে হাঁটুপানি নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গেছেন। যে যা সহায়তা করেছেন তা বিলিয়েছেন সবার মাঝে। সারাজীবন কাজ করেছেন মানুুষের কল্যাণে। চার নেতাসহ তাঁকে হত্যা করার পর একটি শোকবার্তা এসেছিল ফ্রান্স থেকে। সেখানে লেখা ছিল ‘এদেশ বুঝলো না কি হারালো’। রিমি আরও বলেন, তাজউদ্দীনকে আমৃত্যু সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছেন। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে তাঁর কাজকে অনুসরণ করা। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেন, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব তাজউদ্দীন আহমদ। তাই বঙ্গবন্ধুকে যদি জাতির জনক বলা হয় তাহলে জাতির চাচা বলা উচিত তাজউদ্দীন আহমদকে। তার মতো ব্যক্তিত্ব আমি আর দেখিনি। তবে তিনি এতোই ইনোসেন্ট ছিলেন যে পাশে শত্রুকে নিয়ে ঘুরেছেন বুঝতে পারেননি। আমি খন্দকার মোশতাক আহমেদের কথা বলছি। তিনি মুক্তযুদ্ধকালে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও অব্যাহত ছিল তার সেই ষড়যন্ত্র। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। সম্মেলক কণ্ঠে তিনটি গান পরিবেশন করে গানের দলটি। গানগুলো হলোÑ নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে, মুক্তির মন্দির সোপানতলে ও বরিষ ধারা মাঝে বইছে শান্তির বারি। সংবৃতার দশম প্রতিষ্ঠবার্ষিকী উদ্যাপিত ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) শুক্রবার বিকেলে আবৃত্তি সংগঠন সংবৃতা আবৃত্তি চর্চা ও বিকাশ কেন্দ্রের দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। টিএসসির অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া কক্ষে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে সংবৃতার সদস্য, শুভাকাক্সক্ষীসহ আবৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। আলোচনা সভা, গানসহ বিভিন্ন পরিবেশনা দিয়ে সাজানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন শ্রোতা-দর্শক। পাশাপাশি আবৃত্তিপ্রেমীদের সরব উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত আয়োজনে সংগঠনটির শিল্পীদের দলীয় ও একক আবৃত্তি পরিবেশনা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে অনুষ্ঠানে। চার্ম অফ কোরিয়া ॥ ঢাকায় কোরিয়ান দূতাবাসের উদ্যোগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কোরিয়ান রফতানি প্রস্তুতকরণ এলাকা, ইন্ট্রাকো, পি এইচ পি ও ইয়ংগনের সহযোগিতায় শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে কোরিয়া ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪২তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে চার্ম অফ কোরিয়া শীর্ষক সঙ্গীতানুষ্ঠান ও স্যান জাজ স্টোরি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
×