গাফফার খান চৌধুরী ॥ চলতি বছরের ১১ এপ্রিল গরুচোর ভেবে চার ঘণ্টা নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঞ্জের বালু নদীতে ফেলে দিয়ে ষোলো বছর বয়সী কিশোর নিজাম উদ্দিনকে হত্যার অভিযোগে আরও দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এ নিয়ে সাতজন গ্রেফতার হলো। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর কাহিনী। যে কাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনাকেও হার মানিয়েছে।
বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে নিজাম উদ্দিন গরুচোর সন্দেহে জনতার হাতে আটক হয়। এরপর তার ওপর চার ঘণ্টা অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। মৃত ভেবে পানিতে ফেলে দেয়। পানিতে নিজাম উদ্দিন নড়েচড়ে উঠলে জনতা তাকে আবার ডাঙ্গায় তুলে আনে। এরপর হাত-পা বেঁধে তাকে নদীতে ফেলে দেয়। ঘটনার পাঁচ দিন পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানা পুলিশ নিজাম উদ্দিনের গলিত লাশ
অজ্ঞাত হিসেবে নদী থেকে উদ্ধার করে। নিজাম উদ্দিনের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা। জনকণ্ঠকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ) বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক জিয়াউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, চলতি বছরের ১১ এপ্রিল নিজাম উদ্দিন তার এক বন্ধুর সঙ্গে রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন আরেক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গরু চুরি হচ্ছিল। এ নিয়ে সেখানকার স্থানীয়রা গরুচোরদের ওপর খুবই ক্ষিপ্ত ছিল। কিশোর দুই বন্ধু বালু নদীর পাশে বেড়াচ্ছিল। এ সময় স্থানীয়রা তাদের দেখে গরুচোর ভেবে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। একপর্যায়ে স্থানীয়রা বিষয়টি অন্যদের জানায়। এরপর স্থানীয়রা গ্রামের মসজিদ থেকে এলাকায় গরুচোর ঢুকেছে বলে মাইকে ঘোষণা দেয়। তারা নিজাম উদ্দিনকে গরুচোর সন্দেহে আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করে। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে নিজাম উদ্দিনকে নানাভাবে মারধর করে জনতা। নিজামকে মৃত ভেবে দক্ষিণখান থানার অদূরে বালু নদীতে ফেলে দেয়। ফেলে দেয়ার খানিকপর নিজাম উদ্দিন জীবিত অবস্থায় হাত-পা নেড়ে বাঁচার চেষ্টা করে। এ সময় জনতা আবার নিজাম উদ্দিনকে পানি থেকে তুলে আনে। এবার হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দেয়। গত ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানা এলাকায় নিজামের লাশ ভেসে ওঠে। অজ্ঞাত লাশ হিসেবে নিজামের মরদেহ নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়। পরে নিজামের পরিবার লাশ শনাক্ত করে। এ ব্যাপারে গত ১৭ এপ্রিল নিজামের পিতা আব্দুল জলিল রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডিকে।
তদন্তের ধারাবাহিকতায় ইতোপূর্বে গ্রেফতার হয় রাজন, নাছির, জাহাঙ্গীর আলম, শরিফ ও সাইফুল ইসলাম। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত হিসেবে নাম প্রকাশ পায় ইউনূস ও ফিরোজ নামে আরও দুইজনের।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, সেই তথ্যের ভিত্তিতেই বৃহস্পতিবার গাজীপুর জেলার কাশিমপুর এলাকার শৈলডুবি গ্রাম থেকে আসামি ফিরোজের এক চাচাত ভাইয়ের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় ইউনূসকে (২৭)। পরে ইউনূসের তথ্যমতে শুক্রবার রাতেই দক্ষিণখান থানা এলাকায় অবস্থিত মামাবাড়িতে আত্মগোপনে থাকা আরেক আসামি ফিরোজকে (২৫) গ্রেফতার করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৭ জুলাই পবিত্র শব-ই-বরাতের রাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলাচর বালুর মাঠে ডাকাত সন্দেহে ধানম-ি মাস্টার মাইন্ড স্কুল এ্যান্ড কলেজের এ লেভেলের ছাত্র সামাম (২২), মিরপুর বাঙলা কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল (২৪), একই কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর প্রথম বর্ষের ছাত্র কান্ত (২৪) ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের (অনার্স) ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম পলাশ (২৬), তেজগাঁও কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান (২৩) ও মিরপুর কমার্স কলেজ সংলগ্ন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) ছাত্র মনিরকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় জনতা। এ ঘটনায়ও স্থানীয় মসজিদের মাইকে এলাকায় ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আর তাতেই কপাল পুড়ে ছয় ছাত্র আর তাদের পরিবারের।
তদন্তকারী কর্মকর্তা বলছেন, নিজাম উদ্দিনের বেলায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বেড়াতে গিয়েই কপাল পুড়ে নিজাম উদ্দিন ও তার পরিবারের। নিজাম মূলত লেগুনার হেলপার। সে কাওরানবাজার এলাকায় লেগুনার হেলপারি করত। পাশাপাশি অবসরে বেড়াতে যেত। অনেক সময় কাওরানবাজারে ছোটখাটো কাজ করে বাড়তি টাকা রোজগারের চেষ্টা করত। নিজাম উদ্দিন চোর ছিলÑ তদন্তে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি যেদিন নিজাম উদ্দিনকে গরুচোর সন্দেহে ধরে পেটানোর পর হাত-পা বেঁধে বালু নদীতে ফেলে দেয়া হয়, সেদিনও ওই গ্রামে কোন গরু চুরি বা অন্যকোন চুরির ঘটনা ঘটেনি। ওই দিন সাপ্তাহিক বন্ধের দিন থাকায় আরেক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল নিজাম। আর তাতেই কপাল পুড়ে তার। নিজাম উদ্দিনের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন এবং তাকে হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত সিলেটের রাজন হত্যার নির্মমতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।