ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

র‌্যাডক্লিফ থেকে হাসিনা-মোদি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১ আগস্ট ২০১৫

র‌্যাডক্লিফ থেকে হাসিনা-মোদি

কাওসার রহমান ॥ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য মোগল আমলে কোচবিহারের রাজা ও রংপুরের মহারাজা নিজ নিজ এলাকার ছিটমহল নিয়ে তাস খেলায় বাজি ধরতেন। সে সময়ে কোন রাজা বাজিতে হেরে গেলে ছিটমহলের মালিকানাও ওই রাজার কাছ থেকে অন্য রাজার কাছে চলে যেত। এভাবে একদিনের তাসের বাজির জয় পরাজয়ে ছিটমহলের মালিকানার পরিবর্তন হতো। কোচ রাজা ও রংপুরের মহারাজা ছিলেন মূলত সামন্ত। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, ছিল ঋণ পরিশোধের উদ্দেশে মহলের বিনিময়। সেই মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই ক্ষুদ্র রাজ্যের মহারাজা মিলিত হতেন তিস্তার পাড়ে তাস খেলার উদ্দেশে। খেলায় বাজি ধরা হতো বিভিন্ন মহলকে যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। খেলায় হারজিতের মধ্য দিয়ে এই কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতো। সঙ্গে সঙ্গে বদলাতো বিনিময় করা ছিটের মালিকানা। এভাবেই প্রতিনিয়ত একের রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিট মহল বিনিময় হতো। আর সেই মহলের বাসিন্দারাও অন্য রাজার অধীনে চলে যেতেন। ‘ছিট’ শব্দের শাব্দিক অর্থ খ- বা টুকরা। বিভিন্ন মহলকে এক একটি খ-ে বিভক্ত করার পরে এর নাম হয় ছিটমহল। মোগল আমল থেকেই দুই রাজার এসব জমিকে ছিটমহল বলা হতো। তবে দেশ ভাগের পরে এসব এলাকারই আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ হয়ে যায় ছিটমহল। আর ওই এলাকার মানুষেরা বাইরে পরিচিতি পায় ‘ছিটের মানুষ’। ছিটমহলের ইতিহাসের শুরু রংপুর অঞ্চলে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার পর। আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ ষোল শতকে রংপুর অঞ্চলের কিছু অংশ জয় করেন। সতের শতকে এই পুরো অঞ্চলটি মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর ঘোড়াঘাট অঞ্চল কোচ রাজার অধীনে ন্যস্ত হয়। তখন রংপুর অঞ্চল মোগলদের অধীন এবং তার উত্তরে স্বাধীন কোচ রাজার রাজ্য। পাল রাজবংশের পতনের পর তের শতকে কামরূপ রাজ্য ভেঙ্গে পশ্চিম অঞ্চলে কামতা ও পূর্বে অহম রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। কামতা প্রথমে খেন’দের দ্বারা শাসিত হয়। পরে আলাউদ্দীন হুসেন শাহ তাদের তাড়িয়ে দিয়ে কামতা দখল করে নেয়। কিন্তু হুসেন কামতায় তার নিয়ন্ত্রণ পাকা করতে পারেনি। সেখানকার সামন্তদের কাছে তিনি হেরে যান। কোচ বংশের প্রতিনিধি বিশ্ব সিংহ নেতৃত্বের এই শূন্যতা পূরণের মাধ্যমে কামতায় কোচ রাজবংশের গোড়া পত্তন হয়। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে এই কামতা রাজ্য ভেঙ্গে যায়। পশ্চিমে কোচ হাজো ও পূর্বে লক্ষ্মী নারায়ণের শাসনে কোচবিহার রাজ্যের পত্তন ঘটে। কোচবিহার একটি প্রভাবশালী রাজ্যে পরিণত হয়। মোগলদের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। মোগলদের সঙ্গে কোচবিহার সন্ধি করে এবং বাংলার সালতানাত দখলে মোগলদের সহায়তা করে। অবশ্য নিজ রাজ্যের অনেক অংশও মোগলদের কাছে হারাতে হয়েছিল কোচবিহারকে। পরবর্তীতে ভুটানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে কোচবিহার ইংরেজদের সঙ্গেও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখে। কোচবিহার প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে তথাকথিত স্বাধীনভাবে ইংরেজ আমলটিও পার করেতে পেরেছিল। ১৯৪৯ সালে রাজ্যটি ভারতে যোগ দেয়। আর তার পরের বছর তা পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয় ‘কোচবিহার’ নামে। র‌্যাডক্লিফের অদ্ভুত জরিপ ॥ তখনো ছিটমহল নিয়ে কোন সঙ্কট তৈরি হয়নি। এই সঙ্কট তৈরি হয় অখ- ভারত খ- করার সময়েই। গোড়ায় গলদটা রেখে যান ব্রিটিশ সিরিল র‌্যাডক্লিফ। তিনিই পাকিস্তান-ভারত সীমানা নির্ধারণ করেন। সেই সঙ্গে সৃষ্টি করেন এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার। ভারতের ভেতর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভেতর ভারত। যেমন কুড়িগ্রাম ছিটমহলের ভেতরে রয়েছে দাশিয়ারছড়া। আবার এই দাশিয়ারছড়ার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের ছিটমহল চন্দ্রখানা। র‌্যাড ক্লিফের ম্যাপে কোচবিহারের বেশ কিছু অংশ চলে আসে তৎকালীন পাকিস্তানে। সে সময় কোচবিহার রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কোচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখ- আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখ- যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হচ্ছে ছিটমহল। র‌্যাডক্লিফের এক অদ্ভুত জরিপ। দেশভাগের পর বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। এ জন্য ১৯৪৭ সালে গঠন করেন সীমানা নির্ধারণ কমিশন। ব্রিটিশ আইনজীবী মি. সিরিল র‌্যাডক্লিফকে বসানো হয় কমিশনের মাথায়। তিনি এতই দ্রুত তার কাজ সমাধা করলেন যে, সীমানা নির্ধারণে সময় নিলেন মাত্র দেড়মাস। তারপরই মানচিত্র। দেখা গেল, ওই মানচিত্রে ভারতের ১১১টি ভূখ- ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ভূখ- চলে গেছে ভারতে। ভারতীয় ভূখ-গুলোর অধিকাংশেরই অবস্থান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভূখ-গুলো রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ৫১টির মধ্যে ৪৭টিই কোচবিহারে। বাকি ৪টি রয়েছে জলপাইগুড়িতে। সিরিল র‌্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণের কারণেই তখন সীমানা ঘেঁষে সৃষ্টি হয় কিছু অপদখলীয় এলাকা। কিছু এলাকায় ভারতীয় লোকজন পড়ে যায় বাংলাদেশ ভূখ-ের মধ্যে আবার পূর্ব পাকিস্তানের কিছু এলাকার জনগণ পড়ে যায় ভারতীয় ভূখ-ের মধ্যে। র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী, কিছু ভূমি ভারতের সীমানার ভেতরে অথচ এ ভূমি দখলে আছে পাকিস্তানী জনগণের। কিছু জমি পাকিস্তান সীমানার ভেতরে আছে, দখলে আছে ভারতীয় লোকজন। এ দখল এভাবেই থেকে যায় পাকিস্তানে ২৪ বছর। এটাই অপদখল। আবার কিছু ছিটমহল আছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, যার মালিকানা ভারতের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে কিছু ছিটমহল আছে, যার মালিকানা বাংলাদেশের। এ রকম ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আছে, যার আয়তন ১৭১৬০.৬৩ একর। ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহল আছে ৫১টি। যার আয়তন ৭৭১০.০২ একর। সীমানা নির্ধারণে এমন সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে কমিশনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ১. র‌্যাডক্লিফের সুবিবেচনার অভাব। অভিযোগ ২. সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা। অভিযোগ ৩. কমিশনের সদস্যদের অজ্ঞতা ও নিষ্ক্রিয়তা এবং অভিযোগ ৪. জমিদার, নবাব ও চা-বাগানের মালিকদের স্বার্থরক্ষা। মূলত এই চার অভিযোগের সম্মিলিত প্রভাবেই ছিটমহল সঙ্কটের সূত্রপাত। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই জটিলতাই যুগের পর যুগ বয়ে বেড়াতে হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতকে। সমস্যা মেটানোর চেষ্টাও হয়েছে বহুবার। ছিটমহল জট কাটাতে প্রথম চুক্তি হয় ১৯৫৮ সালে নেহেরু ও নুরের মধ্যে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন সীমান্ত সমস্যা সমাধানে একটি চুক্তি করেন। এটি নেহরু-নুন চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। চুক্তি অনুযায়ী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরের বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে পূর্ব পাকিস্তান। এর আওতায় বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হলেও ভারত এগিয়ে না আসায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি। নেহেরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। সেই থেকে সীমান্ত বিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিষয়টি ঝুলে থাকে। চলে যায় ঠা-া ঘরে। ছিটমহল জট আর কিছুতেই কাটে না। নেহরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের চেষ্টা একটা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ভারতের কারণেই কার্যকর হয়নি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় নেহরু-নুন চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের বাংলাদেশী নাগরিক এবং ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দাদের বাধ্যতামূলকভাবেই ভারতীয় নাগরিক হতে হতো। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ॥ এই ছিটমহল সমস্যা সমাধানে প্রথম বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে সম্পাদিত গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বি-পক্ষীয় আন্তর্জাতিক চুক্তি। এটি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ১৬ তারিখে নয়াদিল্লীতে সম্পাদিত। বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। বলা হয়, ‘এই চুক্তিটি দুই দেশের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, আন্তরিক মনোভাব ও পারস্পরিক বিশ্বাস, আর সবার ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী -এ দুজন মহান রাষ্ট্রনায়কের শান্তি ও সম্প্রীতির অন্তর্দৃষ্টির প্রতীক’। এই চুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার স্থল-সীমানা নির্ধারণ সম্পন্ন করা। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হলো। বাংলাদেশের ভেতরে ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যাবে। আর পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে ছিটমহলবাসী ভারতের নাগরিক হয়ে যাবে। জমির পরিমাণ নিয়ে বলা হয়, জমি বেশি বা কম এর জন্য কোন ক্ষতিপূরণ কোন দেশ দাবি করবে না। ছিটমহল এবং অপদখলীয় এলাকায় বসবাসরত মানুষ যারা পূর্বপুরুষের কাল হতে বসবাস করে আসছে, ব্যক্তি হিসাবে জমির মালিকানা তাদের। রাষ্ট্র আলাদা হয়ে গেছে বিধায় তাদের উচ্ছেদ করে ১৯৭৪-এ আবার ’৪৭-এর মতো উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি করে মানুষগুলোকে মানবেতর অনিশ্চিত জীবনযাপনের দিকে ঠেলে না দেয়ার জন্যই চুক্তি করা হয়, যে যেখানে আছে সেখানেই থাকবে, শুধু মালিকানা বিনিময় হয়ে যাবে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে। এ কারণেই অতিরিক্ত জমির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের প্রয়োজন হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ১৬ তারিখে চুক্তির দিনই ভারত বেরুবাড়ীর মালিক হয়ে যায়। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ তখন পায়নি তিন বিঘা। ১৬২ ছিটমহল মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ৬ মাসের মধ্যে বিনিময়ের কথা থাকলেও তা হয়নি ৪১ বছরেও। এই চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদের ১৪ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং-১২ এর দক্ষিণ দিকের অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলোর অধিকারী হবে, যে এলাকার পরিমাণ প্রায় ২.৬৪ বর্গমাইল এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের অধিকারী হবে। বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার (পাটগ্রাম থানা) সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে ‘তিনবিঘা’ নামে ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ ও ৮৫ মিটার প্রস্থ এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে। কিন্তু ‘ইন্দিরা-মুজিব সীমান্ত চুক্তি’ কে ভারতের লোকসভা (পার্লামেন্ট) তখন অনুমোদন দেয়নি। বাংলাদেশকে তিন বিঘা করিডর চিরস্থায়ীভাবে পেতে প্রায় ৩৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর আগে অবশ্য ভারত নির্দিষ্ট সময়ে যাতায়াতের সুযোগ দেয়। পরিশেষে ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এসে দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি প্রটোকল স্বাক্ষর করেন। ওই প্রোটোকল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তিন বিঘা করিড়র চিরস্থায়ীভাবে উম্মুক্ত করে দেয়। হাসিনা-মনমোহনের প্রোটোকল ॥ অনেকগুলো চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশেই ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তিস্তার পানি বন্টন, ছিটমহল বিনিময়, ট্রানজিট, ফেনী নদীর পানি বন্টন, শুল্কমুক্ত সুবিধা ইত্যাদি। কিন্তু সফর শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির জেরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি থেকে দিল্লী পিছিয়ে যায়। ফলে ফেনী নদীর পানি বন্টন চুক্তি এবং ট্রানজিট চুক্তিও ছিটকে পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত দুই প্রধানমন্ত্রীর (মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনা) ফলপ্রসূ আলোচনায় দু’দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার মধ্যে ছিটমহল, সীমান্ত চুক্তি, শুল্ক ছাড়, ভারতের মধ্যে দিয়ে পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকাকে ট্রানজিট দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রয়েছে। সেই সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর থেকেই সীমান্ত নিয়ে দু’দেশের বিবাদ। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা পেয়ে বাংলাদেশ হলেও উত্তরবঙ্গ, অসম আর মেঘালয়ে দু’দেশের সীমান্ত নিয়ে মতভেদ এত দিন মেটেনি। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত ও ছিটমহল চুক্তির ফলে সেই সমস্যার আনুষ্ঠানিক সমাধান হয়। নতুন সীমান্ত মানচিত্রের প্রতিলিপির শেষ পাতায় স্বাক্ষর করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের ১১১টি ছিটমহল, ভারতে বাংলাদেশের ৫১টি। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত নিয়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলার অঙ্গীকার করেছিল দুই দেশ। কিন্তু কয়েক দশকেও তা হয়নি। সেই চুক্তির আলোয় দুই দেশের নতুন প্রোটোকলে স্বাক্ষর করেন দুই বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ এবং দীপু মণি। এতে ছিটমহল হস্তান্তরে সম্মত হয় দুই দেশ। সেই সঙ্গে ঠিক হয়, হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের দুই ছিটমহল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতায় যাওয়ার জন্য তিনবিঘা করিডর এ বার থেকে ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই প্রোটোকলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। কিন্তু, সমাধানের লক্ষ্যে এই যে অগ্রগতির সূচনা হয় তা দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সীমান্ত চুক্তির নেপথ্যে হাসিনা-মোদি ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ সালে হলেও এবার সেই চুক্তির ভারতের লোকসভায় চূড়ান্তভাবে পাস হলো। তবে এই চুক্তি পাসের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত বছর মে মাসে ভারতে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। সে সময় ভারতের মোদি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুষমা স্বরাজের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। সে সময় সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রীকে জানান, মোদি সরকার দুই দেশের সকল অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে বিরোধিতায় নেমেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি এক পর্যায়ে সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা থেকে সরে আসেন। এ প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বাংলাদেশে সফরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সে কারণে গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে আসেন মমতা। এ সময় মমতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত বৈঠকে সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে আরও অগ্রগতি হয়। যদিও বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সীমান্ত বিল নিয়ে অনেক শঙ্কার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মোদি সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার কূটনীতি গ্রহণ করেন। তারই আলোকে বিগত ইউপিএ সরকারের আমলে গড়ে উঠা বন্ধুসুলভ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে এবং মোদি সরকার সীমান্ত বিল রাজ্য সভা ও লোকসভায় পাসের উদ্যোগ নেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অসম বিজেপি ছিটমহল বিনিময়ে নতুন করে আপত্তি উত্থাপন করে। ফলে মোদি সরকার অসমকে বাদ দিয়ে সীমান্ত বিল রাজ্যসভা ও লোকসভায় পাস করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত অসমকে অন্তভর্ুুক্ত করেই মোদি সরকার সীমান্ত বিল রাজ্য সভা ও লোকসভায় পাস করে। ফলে ছিটমহল বিনিময়ের ৪১ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটে।
×