ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের স্বাধীনতায় আনন্দের বন্যা ;###;বাংলাদেশ পেল ১৭ হাজার একর জমি ;###;চার দশক পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন ;###;এতদিনের অবরুদ্ধ ৪ হাজার মানুষের হৃদয়ে ;###;আশার দীপ জ্বালালেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা

মধ্যরাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন ॥ পতাকা পেল ওরা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১ আগস্ট ২০১৫

মধ্যরাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন ॥ পতাকা পেল ওরা

তৌহিদুর রহমান ॥ ৩১ জুলাই মধ্যরাত। বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য সত্যিই একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল। বহু প্রতীক্ষার পরে দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হলো ছিটমহল। আর প্রতিবেশী দুই দেশের ছিটমহলবাসী ফিরে পেলেন এক নতুন জীবন। আজ শনিবার ছিটমহলে উদিত হবে নতুন সূর্য। ভোরে বাংলাদেশের ছিটমহল অংশে উড়বে জাতীয় পতাকা। এদিকে ছিটমহল বিনিময় নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এছাড়া ছিটমহল বিনিময়ের ঘটনাকে একটি ঐতিহাসিক দিন বলে জানিয়েছে ভারত। শুক্রবার রাত বারোটায় উভয় দেশের মধ্যে ছিটমহলগুলো বিনিময় হয়েছে। সে অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরের ১১১ ছিটমহল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ৫১ ছিটমহল ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে মোট ১৬২ ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। ছিটমহল এলাকায় রাত বারোটায় নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ছিটমহল বিনিময় হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি, ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকল ও চলতি বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বিল বিনিময়ের পর এখন সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হলো। সীমান্ত চুক্তির রূপরেখা অনুযায়ী ৩১ জুলাই মধ্যরাতে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই ছিটমহলের মানুষ বাড়িতে বাড়িতে নানা উৎসব করে। আর রাত বারোটায় মোমবাতি জ্বেলে আনন্দ উৎসব করে। ছিটমহলে ৬৮ বছর অবরুদ্ধ ছিলেন বলে তারা বাড়িতে বাড়িতে ৬৮ মোমবাতি প্রজ্বলন করে। এছাড়া জুমার নামাজের পর ছিটমহল এলাকায় বিভিন্ন মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আজ শনিবার ভোরে বাংলাদেশ অংশে লাল-সবুজের পতাকা উড়বে। স্থল সীমানা সংক্রান্ত চুক্তি ও প্রটোকল অনুযায়ী শুক্রবার মধ্যরাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের মূল ভূখ-ে অবস্থিত সকল ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখ- হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল বাংলাদেশী ছিটমহল ভারতের ভূখ- হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। একই সঙ্গে উভয় দেশের অপদখলীয় জমি সেদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের পর ‘বন্দীজীবন’ থেকে নাগরিক হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা পাওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুক্রবার এক অভিনন্দন বার্তায় পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন,‘ছিটমহলবাসীর বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, এখন থেকে ছিটমহলবাসীও এ দেশের নাগরিক। দেশের অন্য নাগরিকদের সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য নেই। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে ধরনের প্রকল্প নেয়া দরকার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যেন সে প্রকল্প হাতে নেয়। পরিকল্পনামন্ত্রী অভিনন্দন বার্তায় আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুয়ায়ী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ছিটমহলবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরির কাজ অচিরেই হাতে নিতে যাচ্ছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এ কাজের প্রয়োজনীয় তদারকি করবে বলেও জানান মন্ত্রী। ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। দুই দেশ ছিটমহলের মতো একটি জটিল বিষয় সমাধান করেছে। ছিটমহল সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য অধিকার সুরক্ষিত হবে। ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী দুই দেশের সরকারী এ চুক্তি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ১৯৭৪ সালে ঢাকা ও দিল্লী সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সেই বছরই চুক্তিটি অনুস্বাক্ষর করে। এরপর ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। তবে সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছর ভারতের লোকসভায় সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের পর এই চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এরপর গত ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসার পরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বিল বিনিময় হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে একটি রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন চলছে। আর সেই রূপরেখা অনুযায়ী শুক্রবার দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর ও কোচবিহারের সীমানা নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় ছিটমহলের উদ্ভব হয়। সমস্যা সমাধানে ১৯৫৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনের মধ্যে একটি হয়েছিল। যেটা নেহরু-নূন চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এই চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এরপর ১৯৭৪ সালে ছিটমহল বিনিময়, অমীমাংসিত সীমান্ত ও অপদখলীয় জমি নিয়ে সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেটা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। তখন এই চুক্তি বাংলাদেশের সংসদে অনুমোদিত হলেও ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় সে দেশের পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়নি। ফলে এই চুক্তি বাস্তবায়নও আটকে যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২। এরমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতের ছিটমহলের সংখ্যা ১১১। আর ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১। চুক্তি বাস্তবায়নের পর শুক্রবার রাত বারোটার পর ভারতের ১১১ ছিটমহল যার জমির পরিমাণ ১৭ হাজার একরের বেশি জমি বাংলাদেশের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহল ভারতে যুক্ত হয়। বাংলাদেশ অংশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ৪১ হাজার ৪৩৩। এর মধ্যে ৯৭৯ জন ভারতের নাগরিক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর ভারতের ৫১ ছিটমহলের লোকসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। তাদের কেউই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেননি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের সন্ধিক্ষণে বিভিন্ন ছিটমহলে খুশির বন্যা বয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের এই ঐতিহাসিক দিনে সেখানকার বাসিন্দারা নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ছিটমহল বিনিময় হয়। শুক্রবার পঞ্চগড় থেকে এ রহমান মুকুল জানান, ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আঁধার কেটে একটি স্বাধীন দেশের রৌদ্রোজ্জ¦ল সুন্দর সকাল দেখলেন পঞ্চগড়ের ৩৬ ছিটমহলের (সাবেক) কুড়ি হাজার মানুষ। একইসঙ্গে ‘ছিটের মানুষ’ নামের অপবাদটিও তাদের জীবন থেকে চিরতরে মুছে গেল। আটষট্টি বছরের ঘোর অন্ধকারে বাস করা এসব মানুষ পেল একটি দেশ, নাগরিক পরিচয়। অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে আসা নাগরিকত্বহীন হতাশ হয়ে পড়া এসব মানুষের মধ্যে আশার হৃদয় নিংড়ানো দীপ জ্বালিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৭৪-এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর থেকে ছিটমহলে বসবাসকারী হতভাগ্য মানুষগুলো মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিল আজ তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটল। খুশির আনন্দে ভাসা বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষগুলোর খোঁজ নিতে শুক্রবার সকালে গারাতি ছিটমহলে সরেজমিন পরিদর্শনে যাই। সেখানে বৃদ্ধ ফয়জুল হকের সঙ্গে কথা হয়। ছিটের মানুষের মুক্তির কথা বলতে গিয়ে আনন্দাশ্রুতে দুচোখ ভরে ওঠে। কিছুটা সময় পরে বলেন, ছোট্ট বাচ্চাগোরে সঙ্গে এই পরথমবার একটু নাচলাম। আমাগোর পরধান মন্ত্রীরে ধন্যবাদ, জুমার নামাজে গিয়া ওনার জন্য দোয়া করুম। ওই ছিটমহলের আরেক বাসিন্দা আবু বক্কর ছিদ্দিক জানালেন, এতদিন দ্যাশও ছিল না, মানুষও ছিলাম না। শ্যাওলার নাহাতি ভাইস্যা বেড়াইতে হইছিল। এখন আপনাগোর মতোই আমাগোরো দ্যাশ হইল। দেশের নাম কি প্রশ্ন করতেই সঙ্গে থাকা স্কুলছাত্র ফারুক চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, দেশটির নাম বাংলাদেশ। ফারুক আক্ষেপ করে বলল, এতদিন আমরা কোন দেশের নাগরিক পরিচয় দিতে পারতাম না। মিথ্যা বাংলাদেশের পরিচয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুরা সবাই আমাকে ছিটের মানুষ বলে ডাকত। ওই ছিটমহলের গৃহবধূ রহিমা বলেন, আমার জন্ম বাংলদেশে হলেও বিয়ে হয়েছে ছিটমহলে। ছিটে বিয়ে হওয়ার জন্য বাপের বাড়ির লোকজন আঙ্গুল তুলে নানা কটূ কথা বলত। কেউ আর আঙ্গুল তুলে কথা বলতে পারবে না, আমিও এখন বাংলাদেশী। জুমার নামাজে মসজিদে ছিটের ছোট শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ সকলেই নামাজ আদায় করতে যান। অন্যান্য শুক্রবারের চেয়ে আজ অনেক মুসল্লির উপস্থিতি ছিল বলে ওই ছিটমহলের চেয়ারম্যান মফিজার রহমান জানান। তিনি বলেন, নামাজ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির জন্য দোয়া করা হয়েছে। নীলফামারী থেকে তাহমিন হক ববি জানান, নগর জিগাবাড়ি ছিটমহলের বাসিন্দা আশি বছরের বৃদ্ধ মহিমুদ্দিন বললেন, হামরা দেখেছি ব্রিটিশদের হটিয়ে আইছিল পাকিস্তান। এরপর পাকিস্তানকে তাড়িয়ে আসে বাংলাদেশ। এইবার হামরা ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন থেকে স্বাধীনতা পাইলাম। আমাদের সন্তান আর নাতি-নাতনিরা নতুন পরিচয়ে নতুন করে জীবন শুরু করল। এই দিনটিরই অপেক্ষা করে আসছিলাম আমরা বছরের পর বছর ধরি। ছিটমহলে মুক্তির সূর্যর যে আলো দেখার দীর্ঘ বাসনা আমাদের ছিল তা আজ দেখতে পাইলাম। এখন খুব ভাল লাগছে। এবার মরেও যেন শান্তি পাব। শুক্রবার ছিটমহলের অভ্যন্তরে থাকা মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত করা হয়। হিন্দু পরিবারগুলো তাদের মন্দিরে করেন পুজো অর্চনার মাধ্যমে উলুধ্বনি। চলে রঙখেলা আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। স্থানীয় ছিটবাসীরাই এসবের আয়োজন করে। একই ছিটমহলের শুকুর আলী বললেন, এখন আমরা বাংলাদেশী হইনো বাহে। এতদিন ছিনু ভারতের। হামলা ছিটমহলের মাইনষি বইলা কাহো কাহো হামাক আজাইরা কইতো। আইজ থাইকা ছিটের আজাইরা উপাধি হইতে রক্ষা পাইলাম। হইনো এ্যালা বাংলাদেশের নাগরিক। এইবার শান্তিত ঘুমিবার পারিমো বাহে। বড়খানকি খারিজা গিদালদহের যুবক ওমর ফারুক বললেন, আমাদের ছিটমহলবাসীদের স্বাধীনতা পাওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে গ্রামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। বড়খানকি কান্দাপাড়া ছিটমহলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী মেঘনা আক্তার বলেন, আমাদের লক্ষ্য অর্জনে আর কোনো শঙ্কা থাকল না। এখন লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে নিজের ও বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পারব। জিগাবাড়ি ছিটমহলের জয়নাল আবেদীন (৫৫) বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যে স্বাধীনতা এনে দিলেন তার জন্য আজ শুক্রবার ছিটমহলের মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোয়া করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম থেকে রাজু মোস্তাফিজ জানান, ফুলবাড়ীর দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে রাত বারোটা ১মিনিটে ৬৮ মোমবাতি জ্বালিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ভূখন্ডে পরিণত হলো। এখানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী সাবেক এমপি জাফর আলী, ছিটমহল বিনিময় কমিটির সভাপতি মইনুল হক, সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ হাসান নোমান। দিন থেকে শুরু হওয়া আনন্দ উৎসবের পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় শুক্রবার গভীর রাতে। জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় তিনটি মঞ্চে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে মূল আয়োজন ছিল দাসিয়ারছড়া ছিটের কালিরহাট বাজারে। শুক্রবার সকাল থেকে ছিটমহলবাসীরা মিলিত হয়েছে আনন্দ আয়োজনে। আয়োজন করেছে লাঠিখেলা ও নৌকা খেলা। বিজয় মিছিল, আনন্দ মিছিল। বাড়ি বাড়ি চলে ভাল খাবারের আয়োজন। পরিবার পরিজনরা মিলে খুশিতে মেতেছে সবাই। ভারতীয় ভূ-খ-ে শুক্রবারই ছিল তাদের শেষ জুমা নামাজ। নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল ও আখেরী মোনাজাত এবং মন্দিরে মন্দিরে পুজো অর্চনা করে ছিটমহলবাসীরা। মুক্তির মাহেন্দ্রক্ষণ স্মরণীয় করে রাখতে ছিটমহলবাসীদের এ আয়োজন। ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের মুক্ত ঘটল রক্তপাতহীন। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম প্রায় ৫৫ হাজার মানুষের মুক্তি হলো কিন্ত নেই যুদ্ধ, নেই রক্তপাত। ফুলবাড়ীর দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে অবস্থিত ৯টি মসজিদে ছিল উপচেপড়া ভিড়। ছিটের বাইরের দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন বিশেষ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুস্বাস্থ্য কামনা করা হয়। এ সময় দেশ ও জাতির কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করা হয়। যারা ভারতে চলে যাচ্ছে তাদের জন্য শুভ কামনা এবং যারা বাংলাদেশে রয়ে যাচ্ছেন তাদের মঙ্গল কামনা করা হয়। একই ভাবে দাসিয়ারছড়া ছিটের ৬টি মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশেষ প্রার্থনার। ফুলবাড়ীর অভ্যন্তরে অবস্থিত সবচেয়ে বড় দাসিয়ার ছড়া ছিটমলের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত নীলকোমল নদীতে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের। নদীর দু’তীরে শত শত মানুষ নৌকাবাইচ উপভোগ করেন। পরে দাশিয়ারছড়া ছিটের কামালপুর গ্রামের বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় মনমুগ্ধকর লাঠিখেলা। এতে ছিটের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ লাঠিখেলায় অংশ নেয়। পরে রাত ১২টায় কালিরহাট বাজারে অনুষ্ঠিত ছিটমহল বিনিময় উপলক্ষে আয়োজিত বিজয় উৎসবে বিভিন্নখেলায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের নেতাদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে। এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিরোধী দলের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের সভাপতি মইনুল হকের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বিরোধীদলীয় হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর, ইউএনও নাসির উদ্দিন মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা খান, আলতাফ হোসেন, আজিজার রহমান মাস্টার, হবিবর রহমান প্রামাণিক প্রমুখ। ছিটমহল জুড়ে নেয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ দিনরাতে সর্বক্ষণিকভাবে ছিটমহলে টহল দিচ্ছে। পুলিশী নিরাপত্তা ছিল দু’স্তরের। সাদা পোশাকেও ছিল বিশেষ টিম। এছাড়াও স্থানীয় ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক তাদের সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজ তদারকি করছে। কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ জানান, ছিটমহলবাসীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগনেয়া হয়েছে। সরকারের অনুমতি পেলে আমরা এ ছিটমহলে ভবিষ্যতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করব। ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের সমন্বয় কমিটির দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাব হোসেন জানান, বন্দী থেকে মুক্ত হলাম আমরা। ছিটমহলবাসীরা আজ আনন্দে আত্মহারা। পৃথক পৃথক স্থানে লাঠিখেলা, নোকাবাইচ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এর আগে গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই দুই দেশের ১শ’ ৬২টি ছিটমহলে জনগণনা হালনাগাদ ও নাগরিকত্ব নির্ধারণের মতামত নেয়া হয়। কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলে ১ হাজার ৬শ’ ৩০টি পরিবারে জনসংখ্যা ৮ হাজার ১শ’ ৩২ জন। তাদের মধ্যে ৩শ’ ১৭ জন ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তবে গণনা এবং অভিমত দেয়া থেকে বাদ পড়েছে প্রায় এক হাজার ছিটমহলবাসী। লালমনিরহাট থেকে জাহাঙ্গীর আলম শাহীন জানান, শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮ বছর ধরে ঝুলে থাকা দুদেশের ১৬২টি ছিটমহলের সমস্যার সমাধান হলো। চুক্তির অধীনে ছিটমহল হস্তান্তর এর মধ্য দিয়ে ৬৮ বছরের ছিটমহল সমস্যার ইতি ঘটে। বাড়িতে বাড়িতে জ্বালানো হয় ৬৮টি করে মোমবাতি। দুদেশের ১৬২টি ছিটমহলেই রাত ১২টায় একইসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি। ৬৮ বছর পর ছিটমহল সমস্যা সমাধান হওয়ায় ওইদিন ছিটমহলের প্রত্যেকটি মুসলিম বাড়িতে ৬৮টি মোমবাতি আর হিন্দু বাড়িতে ৬৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। এছাড়াও ছিটমহলগুলোর প্রতিটি অন্ধকার সড়কে মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করার পাশাপাশি ওড়ানো হয় আকাশ প্রদীপ। রাতভর চলে নাচ-গানসহ নানা অনুষ্ঠান। ৬৮ বছরের নাগরিকত্বহীন জীবনের অবসান ঘটানোর প্রতীক হিসাবে দু’দেশের ছিটমহলবাসী এই অভিনব কর্মসূচী পালন করে বলে জানিয়েছেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতারা। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট জেলা শাখার সভাপতি শাহ আব্দুল হামিদ আফতাবী বলেন, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়েছে। প্রতিবছর ৩১ জুলাই আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে এই দিনটি পালন করব।
×