ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগবান্ধব ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৩১ জুলাই ২০১৫

বিনিয়োগবান্ধব ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি ঘোষণা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ টেকসই অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ। তাই নির্বাচিত খাতে বিনিয়োগ করার বিকল্প নেই। সেটা করতে পারলে একদিকে ঋণের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে ধীরে ধীরে কমে আসবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার। আর বাজেটের নির্ধারিত দেশজ উৎপাদনে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও ৬ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির জন্য বেসরকারী খাতে ঋণ যোগানের লক্ষ্যমাত্রা ১ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে তাতে কমবে আর্থিক ঝুঁকি। চলতি অর্থবছরের (২০১৫Ñ১৬) প্রথমার্ধের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আগের কয়েকটি মুদ্রানীতির প্রকৃতির সঙ্গে মিল থাকা এবারের মুদ্রানীতিকে বিনিয়োগবান্ধব ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি বলে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবর্নর ড. আতিউর রহমান মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রে এ সব কথা বলেন। অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাইÑডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গবর্নরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমী, ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। অনুষ্ঠানে অন্য ডেপুটি গবর্নর, নির্বাহী পরিচালকরাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গবর্নর বলেন, উৎপাদন কর্মোদ্যোগের জন্য বিবিধমুখী চলমান নীতি সমর্থন সংকুলান করে প্রণীত হয়েছে ২০১৫Ñ১৬ অর্থবছরের মুদ্রানীতি কার্যক্রম। এর প্রথমার্ধের মুদ্রানীতির ভঙ্গি হলোÑ সামাজিক ন্যায়বোধভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তার পাশাপাশি ঋণ যোগানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্ফীতি এড়িয়ে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি পরিমিতি এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা জোরালো করা। মুদ্রানীতিতে বলা হয়, দেশজ উৎপাদনে ৭ শতাংশ প্রকৃত প্রবৃদ্ধি এবং ৬ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মাত্রা ধরে অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগানের প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে বিগত অর্থবছরের প্রাক্কলিত ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২০১৫Ñ১৬ অর্থবছরের জন্য ১৬ দশমিক ৩ শতাংশে। এর মধ্যে বেসরকারী খাতে ঋণ যোগানের প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের প্রাক্কলিত ১৩ দশমিক ৬ শতাংশের বিপরীতে চলতি অর্থবছরে ১৫ শতাংশে প্রাক্কলিত হয়েছে। ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি বিগত অর্থবছরের ১৩ দশমিক ১ শতাংশের বিপরীতে এবার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে প্রাক্কলিত হয়েছে। আতিউর রহমান বলেন, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগানের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা প্রয়োজন বলে অনেকে ধারণা পোষণ করলেও অর্থনীতির প্রকৃত খাতে বিরাজমান ভৌত অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা এবং অন্যান্য সুবিদিত প্রতিবন্ধকতা নিরসন না করে অপরিমিত তারল্যস্ফীতি আনা মোটেই প্রবৃদ্ধিবান্ধব হবে না। কেবলমাত্র অনুৎপাদনশীল বেশি ঝুঁকিনির্ভর কর্মকা- উৎসাহিত করে মূল্যস্ফীতি এবং সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধির ইন্ধন যোগাবে। তিনি বলেন, আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে মুদ্রানীতিতে সংযত ও সতর্ক ভঙ্গি বজায় রেখে ঋণ যোগান প্রবৃদ্ধির পর্যাপ্ততার দিকে নজর রাখার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত স্ফীতি এড়িয়ে চলেছিÑ যার ফলে ভোক্তা মূল্যস্ফীতির পরিমিতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখায় টেকসই অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। মুদ্রানীতি প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়, বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধার অপ্রতুলতা, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি মন্দা এবং দেশে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত বিঘেœর প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং খাত থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগানের প্রবৃদ্ধি আগের মুদ্রানীতিতে প্রক্ষেপিত ১৭ দশমিক ৪ শতাংশের চেয়ে অনেকটা নিচে মে মাস শেষে ছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ মুদ্রা যোগানে আগের অর্থবছরের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে চলতি অর্থবছরে জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬ শতাংশ। গবর্নর বলেন, নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি কার্যক্রম ঋণ যোগানের প্রবৃদ্ধি প্রকৃত দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মাত্রায় পরিমিত রাখলেও পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট এবং খাদ্য ও জ¦ালানি বহির্ভূত কোর মূল্যস্ফীতিতে নিম্নগামী প্রবণতা সুস্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নীতি সুদহার অর্থাৎ রেপো, রিভার্স রেপো সুদহার সঙ্গতিপূর্ণ মাত্রায় নামিয়ে আনার বিবেচনায় আমরা দ্বিধানি¦ত হব না। ব্যাংক ঋণের গুণগত মান রক্ষা করার জন্য নির্বাচিত খাতে ঋণ দেয়া হবে বলে জানান গবর্নর। তিনি বলেন, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উৎপাদন উদ্যোগগুলোর অর্থায়নের ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারের সঞ্চয় যোগান বর্ধিত মাত্রায় সঞ্চালিত হচ্ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এ সব অর্থায়ন উদ্যোগ এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া অবলম¦ন প্রকল্পের অর্থায়নের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন সহায়তা ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাচ্ছে। নতুন ২০১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিবান্ধব অর্থায়নের এ সমর্থন সূত্রগুলো সচল থাকার পাশাপাশি ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের (প্রায় চার হাজার কোটি টাকা) দুটি অর্থায়ন সূত্র যোগ হবে। প্রথমটি হলো অভ্যন্তরীণ ও রফতানি উভয় বাজারের জন্য উৎপাদনমুখী প্রকল্পগুলোর মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রা অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে আহরণ করা ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল। আর দ্বিতীয়টি হলো রফতানিমুখী বস্ত্র, পোশাক ও চামড়া শিল্পে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া অবলম্বনের অর্থায়নের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস¦ সূত্রের ২০০ মিলিয়ন ডলার পুনঃঅর্থায়ন সহায়তা। প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, বেশি ঋণ দেয়ার চেয়ে মানসম্পন্ন ঋণের দিকে নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে একইসঙ্গে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই ঋণের সুদের হার কমে আসবে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার পাশাপাশি পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়ক ভূমিকা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ছয় মাস অন্তর আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে তার একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করতে প্রতিবারের ন্যায় এবারও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যাংকার, প্রাক্তন গভর্নর, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রাক্তন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়া হয়েছে।
×