ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল নেই শিশু মরিয়মের মাও ;###;মাগুরা হাসপাতালে সন্তানকে দেখার জন্য চিৎকার করছেন বার বার

মায়ের গর্ভেই বুলেটবিদ্ধ সেই শিশুটি ॥ শঙ্কা কাটেনি, জন্ডিসের কারণে স্থানান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩১ জুলাই ২০১৫

মায়ের গর্ভেই বুলেটবিদ্ধ সেই শিশুটি ॥ শঙ্কা কাটেনি, জন্ডিসের কারণে স্থানান্ত

শমী চক্রবর্তী ॥ ছোট্ট প্রাণটির বেঁচে ওঠার প্রার্থনা এখন চারপাশে। এ প্রার্থনা এখন শুধু আর শিশুটির মা-বাবা বা আত্মীয় পরিজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। নির্মমতার শিকার হয়ে দুনিয়ায় চলে আসতে হয়েছে সময়ের আগেই। শরীরে ক্ষত যেন নিছক ক্ষত নয়, মানুষের লোভ লালসা, হানাহানি আর নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর। যেভাবে তুলতুলে শরীরে এত যন্ত্রণা সহ্য করেছে তা যেন মিছে না হয়ে যায় সৃষ্টিকর্তার কাছে এমন অনুনয় এখন সকলের। মায়ের গর্ভে থেকেই দুই পক্ষের গুলিতে বিদ্ধ শিশুটিকে বাঁচিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টায়রত চিকিৎসকরাও যেন এখন সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন। যেভাবেই হোক বেঁচে উঠুক, বেঁচে থাকুক, বেড়ে উঠুক পৃথিবীর আলো বাতাসে সবার ‘সন্তান’ হয়ে ওঠা এই শিশুটি। শারীরিক অবনতি হওয়ায় তাকে বৃহস্পতিবার স্থানান্তর করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার গুলিবিদ্ধ নবজাতক কন্যা শিশুটির সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবু তার শঙ্কা কাটেনি। নবজাতকের জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে শিশুটি দ্রুত সেরে উঠতে তার মায়ের দুধের বিকল্প দেখছেন না মেডিক্যাল বোর্ড। বোর্ডে চিকিৎসকদের দাবি, মায়ের বুকের দুধ পান করাতে পারলে শিশুটি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। এদিকে সাতদিন পর সন্তানের সান্নিধ্য পেতে গুলিবিদ্ধ শিশুটির মা নাজমা আক্তার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। সঙ্গে শিশুটির বাবা বাচ্চু মিয়াও রয়েছেন। এত কিছুর মাঝে নবজাতককে বাঁচাতে চিকিৎসক, নার্সরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন। কখন শিশুটি সেরে উঠে তার মায়ের কোলে ফিরে যাবে। চিকিৎসকরা তার নাম দিয়েছে বুলেট বেগম। আর ফুপু নাম রেখেছেন মরিয়ম। পৃথিবীতে আসার এক সপ্তাহের জীবনে জুটেছে অনেক যন্ত্রণা। গুলিবিদ্ধ হলেন অন্তঃসত্ত্বা নাজমা। গুলিটি মা নাজমা আক্তারের শরীরে ভেদ করে গর্ভে থাকা কন্যা শিশুর পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলিটা শিশুটির বুকে বিদ্ধ হলো জন্মের আগেই। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের গর্ভে থাকতেই ঘাতকের বুলেটবিদ্ধ হলো সে। পৃথিবীর আলো দেখতে তখনও বাকি দেড় মাস। আঘাত লাগে শিশুটির হাত আর চোখেও। পেটে সন্তান আছে- এ আকুতি জানিয়েও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের গোলাগুলি থেকে রেহাই পাননি নাজমা। পৃথিবীর আলো দেখার আট দিনের জীবনের পুরোটাই তাকে কাটাতে হলো মা থেকে দূরে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে মায়ের বুকের ওম পেতে শিশুটি চেষ্টা করছে তুলা আর নরম লেপের আস্তরণে ঘুমন্ত শিশুটি। মুখম-ল বাদে তার সারাদেহ পুরু সাদা তুলা দিয়ে ঢেকে ছোট্ট বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তুলার উপর ছড়ান ছিল একটি রঙিন সুতির শাড়ি। ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে মা নাজমা আক্তারের ছোঁয়া না পাওয়া মরিয়মের সঙ্গী হয়েছে মায়ের পরনের এই শাড়ি। ভূমিষ্ঠ হবার পর স্বাভাবিকভাবেই তার পাকস্থলীতে মায়ের বুকের দুধ যাবার কথা থাকলেও কোমল চামড়া সুচ দিয়ে ভেদ করে ক্রমাগত যাচ্ছে স্যালাইন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বুধবার গুলিবিদ্ধ শিশুটির ক্ষতস্থানে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সময়ের আগে কম ওজনে জন্মানো শিশুটি ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। বৃহস্পতিবার সকালে শিশুটিকে জন্ডিসের কারণে ফটো থেরাপি দিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি থেকে নবজাতক বিভাগে স্থানান্তর করা হয়েছে শিশুটিকে। এতদিন শিশুটিকে কোন নামে ডাকা হতো না। কারও মাথায় ছিল না তার একটা নাম দিতে হবে। সবাই ব্যস্ত শিশুটিকে সুস্থ করে তুলতে। হাসপাতালের ভর্তি খাতায় শিশুটির নাম ও পরিচয়ের জায়গায় লিখা ছিল বেবি অব নাজমা বেগম। কিন্তু এখন শিশুটির নাম রাখা হয়েছে ‘মরিয়ম’। ফুপু শিউলি বেগমের রাখা এ নামেই এ শিশুকে ডাকছেন স্বজনরা। নির্মমতার শিকার নিষ্পাপ ফুটফুটে শিশুটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু সার্জারি বিভাগে শনিবার থেকে ভর্তি ছিল। বুধবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি ইউনিটে অপারেশন থিয়েটারে ছোট্ট এ শিশুটির অপারেশন হয়। শিশুটির উন্নত চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ও শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলীর নেতৃত্বে ৯ জনের একটি চিকিৎসক দল শিশুটির অস্ত্রোপচার করেন। বুকের ডান পাশে, পেছনে, হাত ও গলায় ১৮টি সেলাই দেয়া হয়। পাশাপাশি একই বুলেটে গুরুতর আহত শিশুটির মা নাজমা আক্তারের দেহ থেকেও সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গুলি বের করা হয়েছে। সন্তানকে দেখার জন্য বার বার চিৎকার করছেন তিনি। তবে মা-শিশুর দেহে সফল অস্ত্রোপচার হলেও তারা এখনও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গুলি শিশুটির শরীর ভেদ করায় সেটি আর মায়ের খাদ্যনালি ও নাড়িভুঁড়ির বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারেনি বলে জানান চিকিৎসকরা। অন্যথায় মায়ের মারা যাওয়ার শঙ্কা থাকত। আর এমন বিরল ঘটনায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই শিশুটি মায়ের প্রাণ বাঁচাল বলেও মন্তব্য তাদের। ডাঃ কানিজ হাসিনা শিউলী জানান, মায়ের দুধের বিকল্প নেই। আশা করছি, মায়ের বুকের দুধ পান করতে পারলে শিশুটি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। তিনি জানান, মায়ের বুকের দুধ না পাওয়ায় তাকে বুধবার গুঁড়োদুধ খাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু শিশু পেটে রাখতে পারেনি। বমি করে ফেলে দিয়েছে। পরবর্তীতে তাকে আর গুঁড়োদধ খাওয়ানো হয়নি। ইতোমধ্যে নবজাতক জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (এনআইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি জানান, সামান্য জন্ডিস নিয়েই শিশুটি পৃথিবীতে এসেছিল। এখন জন্ডিসের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাকে স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে (এনআইসি) রাখা হয়েছে। পরে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। কানিজ হাসিনা জানান, রক্তের হিমোগ্লোবিন মাত্রা প্রতিটি শিশুর দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ থাকার কথা। কিন্তু বুধবার তার ৫০ হাজারে নেমে আসে। এরপর আমরা তার শারীরিক পরীক্ষা করি। পরীক্ষা রিপোর্টটি এখনও হাতে পায়নি। তিনি জানান, শিশুটি এখনও আশঙ্কামুক্ত নয়। এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভাল রয়েছে। এজন্য ফটো থেরাপি দেয়ার জন্য তাকে ওই ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। শিশুটির চোখে ও পিঠে গুলি লাগার কারণে এরই মধ্যে হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শিশুটির চিকিৎসা দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, নবজাতক পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই সমস্যার মধ্যে আছে। অপরিণত জন্ম। কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া। পেটের মধ্যে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়াÑ সবকিছুই ওর জন্য রিস্ক ফ্যাক্টর। এসব মাথায় রেখেই নিবিড় তত্ত্বাবধান চলছে। ওকে নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত। অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালের বিশেষজ্ঞগণ আলোচনায় বসেছিলেন। সমন্বিতভাবে সেবা দেয়ার জন্যই আলোচনা হয়েছে। যাতে তার চিকিৎসার কোন ত্রুটি না হয়। ওই নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম। ছোট্ট শরীরে অস্ত্রোপচারের ধকল গেছে। তাই আইসিইউর বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সংক্রমণ যাতে না হয়, সে দিকে বেশি খেয়াল রাখতে হচ্ছে। নবজাতকের কথা চিন্তা করে মাকে কেবিনে রেখে সেখান থেকে বুকের দুধ নিয়ে নবজাতককে খাওয়ানোর কথা চিন্তা করা হচ্ছে। মেডিক্যাল বোর্ডের অন্যতম সদস্য শিশু সার্জারি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ আবদুল হানিফ টাবলু জানান, ডাক্তাররা শিশুটির সর্বক্ষণিক মনিটর করছেন। তবে শিশুটিকে মায়ের বুধের দুধ খাওয়ানোটা জরুরী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আশরাফ-উল হক বলেন, এখনও কোন বড় ধরনের উন্নতি না হওয়ায় শঙ্কামুক্ত বলা সম্ভব নয়। এমনিতে শিশুটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে। তার ফুসফুস, হƒৎপি- অক্ষত। শুধু ডান চোখে জখম রয়েছে। চোখের জন্য আলাদা চিকিৎসা শুরু হয়েছে। শিশুটিকে আংশিক অবশ করে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তবে স্বস্তির খবর হলো, সময়মতোই ও সাড়া দিয়েছে। অবশ ভাবটা কেটে যাওয়ার পরই কান্নাকাটি করেছে। শিশুটির ঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমতঃ সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে মাত্র আট মাসে। দ্বিতীয়তঃ তার ওজন মাত্র দুই কেজি, যা স্বাভাবিকের চেয়ে আধ কেজি কম। তৃতীয়তঃ এসব অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বুধবার সকালে তাকে পরপর দুটি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের স্থানে এখন ১৮টি সেলাই। এসব সেলাই হাতে-বুকে। জানা যায়, মাগুরা সদরের বাসিন্দা পেশায় চা দোকানদার বাচ্চু ও নাজমা দম্পত্তির তৃতীয় সন্তান মরিয়ম। তাদের বড় ছেলে সোহাগ আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবেন। দ্বিতীয় সন্তান সুমাইয়া পড়ছে তৃতীয় শ্রেণীতে। কিন্তু তার বুদ্ধিবিবেচনা শক্তি স্বাভাবিক নয়। মরিয়মের পাশে থাকা শিউলি বেগম ও জেবুন্নেসার ভাষায়Ñ ‘সুমাইয়া হাবাগোবা। এর লাইগাই ভাই আরেক সন্তান নেয়নের চিন্তা করছিল। কিন্তু পেটে সন্তান আসে না। আটটা বছর ধইরা ঘুরছে ডাক্তার-কবিরাজের কাছে। এত সাধনার এই মাইয়াডার এহন এই অবস্থা। মায়ের পেট থেইক্কা পরনের আগেই গুলি খাইয়া মরতে বইসে।’ নাম রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেদিন হাসপাতালে আনা হইতাছিল। অয় আমার কোলেই আছিল। তখনই ভাবছিলাম মরিয়ম নাম রাখার ব্যাপারে। আজকা থেইকা ওরে এই নামেই ডাকতাছি’। তিনি আরও বলেন, ‘বাবা বাচ্চু মিয়ার চায়ের দোকান, ভিটাবাড়ি ছাড়া আর কিছু নাই। তিন টেকা কাপ চা বেইচা এই বাচ্চার চিকিৎসা করানির ক্ষমতা অর বাপের নাই। ও যে এদ্দিন বাঁচব এইটাই ভাবি নাই। এহন যহন বাঁচার আশা দেখা দিসে, দরকার দেখা দিছে টেকার।’ বাচ্চু মিয়া আছেন স্ত্রী নাজমার সেবায়। ঘটনার দিন থেকে তিনি ভর্তি মাগুরা সদর হাসপাতালে জানিয়ে শিউলি বলেন, ‘ওর বাপ ফোন দিলেই কয়, সোনামনি কেমন আছে, কী খাইছে, ঘুমাইতাসেনি, কান্দেনি, হাজারটা প্রশ্ন।’
×