ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যাংকে অনিয়ম ॥ ছুটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করুন

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৩১ জুলাই ২০১৫

ব্যাংকে অনিয়ম ॥ ছুটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করুন

এই মুহূর্তে দেশে অর্থনৈতিক খবরের কোন অভাব নেই। অর্থনৈতিক খবরের মধ্যে আবার ব্যাংকের খবরও অনেক। রয়েছে বৃষ্টিপ্রসূত বন্যার খবর, এতে বীজতলার ক্ষয়ক্ষতির খবর। এসবে যাওয়ার আগে প্রতিবেশী দেশের ব্যাংকিং খাতের কিছু খবর পাঠকদের দিতে চাই। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ ২০ জুলাই তারিখের একটি ইস্যুর খবর অনুযায়ী ভারতের সরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর ‘ব্যাড লোনের’ পরিমাণ এই মুহূর্তে দুই লাখ ৬০ হাজার রুপী। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সরকারী ব্যাংক ‘স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র ব্যাড লোনের পরিমাণ ৬১ হাজার ৯৯০ কোটি রুপী। উল্লেখ্য, এসব ঋণের মধ্যে অনেক ঋণকে ভারতীয় সরকারী ব্যাংকগুলো ‘পুনর্গঠন’ (রিস্ট্রাকচার) করে দিয়েছে। এজন্য সে দেশে রয়েছে ‘এ্যাসেট রিস্ট্রাকচারিং কোম্পানি’। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের মতো ভারতীয় ব্যাংকগুলোও খেলাপী ঋণ বা ব্যাড লোনের সমস্যায় আক্রান্ত। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ভারতীয় ব্যাংকগুলো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কোন গ্রাহক যদি ঋণের টাকা ফেরত দিতে অক্ষম হয় তাহলে ওই কোম্পানির মালিকানা চলে যাবে ব্যাংকের কাছে- এমন ব্যবস্থা গ্রহণের কথাবার্তা ভারতে চলছে। এই মর্মে খবর পড়ছি তাদের কাগজে। এছাড়া সম্প্রতি ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ একটি পদক্ষেপ নিয়েছে বলে ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে দেখলাম। খবরটিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় ব্যাংকগুলোতে জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এই সমস্যার সমাধানে ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ (আরবিআই) একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের ‘ফোর্সড লিভ’ দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, ছুটিকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যাতে ব্যাংকের সঙ্গে কোনভাবেই কোন যোগাযোগ রাখতে না পারে তা নিশ্চিত করা হবে। একমাত্র যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ রাখবে ‘অনলাইনের’ মাধ্যমে। এটি করার কারণ অনেক অনিয়মে তাদের সংশ্লিষ্টতা। যেসব অনিয়মে তারা জড়িয়ে পড়েছে সেগুলো হচ্ছে : ‘হাইপোথিকেশন’, হাউজিং লোন, লেটারস অব ক্রেডিট, অধিক পরিমাণে ঋণের জন্য জমির অতিরিক্ত মূল্যায়ন, মর্টগেজ করা সম্পত্তির ওভার ভ্যালুয়েশন, স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ, রফতানি আয়ে সরকারের সুবিধা পাওয়ার জন্য ‘রফতানি বিলের’ ওভার ভ্যালুয়েশন ইত্যাদি ইত্যাদি। সাময়িকীটিতে যে তালিকা দেয়া হয়েছে তাই এখানে তুলে ধরলাম। তবে অনুমান করতে বাধা নেই যে, এখানেই শেষ নয়। ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে এবং ‘আরবিআই’ মনে করছে একশ্রেণীর ব্যাংকার এভাবে পয়সা বানাচ্ছে। বলাবাহুল্য, ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র (আরবিআই) মনিটরিং ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। দৃশ্যত আরবিআইয়ের ক্ষমতা আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে বেশি। তাদের গবর্নরের পদমর্যাদাও আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের চেয়ে বেশি। তাদের সিস্টেমস, প্রসিডিউর, অডিট ও ইন্সপেকশন, আইন-কানুন আমাদের তুলনায়, যতটুকু জানি, কঠোরতর। সে দেশে কোন ‘ব্যাংকিং স্ক্যাম’ হলে বহু ক্ষেত্রে প্রধান কর্মকর্তা এবং উর্ধতন কর্মকর্তাদের আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে দেখা যায়। বেশ কিছুদিন আগে হর্ষদ মেহতা নামীয় শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা এরকম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এবং এই ধরনের ঘটনা সেখানে বিরল নয়। মিডিয়া ও আদালত থেকে শুরু করে ‘রাইটস গ্রুপ’গুলো দুর্নীতির ক্ষেত্রে বলা যায় আপোসহীন। সাম্প্রতিককালে আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার ফল বর্তমান অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেসী সরকার। নেতা কেজরিওয়াল। এমন একটা পরিবেশের মধ্যেই তাদের ব্যাংকিং খাতকে দুর্নীতিকবলিত বলে খবর ছাপা হচ্ছে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় ‘আরবিআই’ শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের ছুটির ওপর হামলা করেছে। প্রশ্ন : উপরোক্ত অবস্থা থেকে বাংলাদেশ কি মুক্ত? দৈনন্দিন খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়লে মোটেই তা মনে হয় না। প্রায় প্রতিদিন মিডিয়াতে ব্যাংকের খবর থাকেই। এর অধিকাংশ খবরই নেতিবাচক। কচিৎ ইতিবাচক খবর চোখে পড়ে। এসব খবরে যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয় তার মধ্যে আছে : মূলধন ঘাটতি এবং তা পরিপূরণে অনৈতিকভাবে সরকারী টাকা বরাদ্দ। দ্বিতীয় অভিযোগ খেলাপী ঋণ নিয়ে। দিন দিন তা বাড়ছে এবং এসব টাকা আদায়ের কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। বড় বড় গ্রাহকদের অনৈতিকভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ঘনঘন ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। এতেও যখন হচ্ছে না তখন ঋণগুলোকে করা হচ্ছে পুনর্গঠিত। বেনামী ঋণ বরাদ্দ করা হচ্ছেÑ উদাহরণ হলমার্ক, বিসমিল্লাহ। এছাড়া খবর ছাপা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার খারাপ সম্পর্কের ওপর। প্রচুর খেলাপী ঋণ মামলায় আটকা পড়ছে। ঋণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু অঞ্চলে এবং কিছু লোকের হাতে। সরকারী ব্যাংকগুলোর দক্ষতা নিম্ন পর্যায়ে। তাদের মুনাফা কম। আয়ের সিংহভাগই খরচ হচ্ছে নানা রকমের খরচে। সরকারী ব্যাংকের পরিচালক, পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, উর্ধতন কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেও খবর ছাপা হচ্ছে। সিবিএ নেতাদের কীর্তির কথাও কখনও কখনও ছাপা হয়। তালিকা আর দীর্ঘ করে লাভ নেই। এসব অভিযোগ সত্যি কী মিথ্যা তা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে মানুষ কী ভাবছে, এমনকি সরকার কী ভাবছে। দেশের যারা কর্মকর্তা তারা কী ভাবছে? এসব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ভারতীয় ব্যাংকগুলোর থেকে আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা সবিশেষ ভাল নয়। এমনকি আরেক বৃহৎ প্রতিবেশী চীনর ব্যাংকিং ব্যবস্থার খবরও ভাল নয়। সেখানকার ব্যাংকিং-এ খেলাপী ঋণের অবস্থা তথৈবচ। তবে ওদের সুবিধা ব্যাংকও সরকারের, ব্যবসাও সরকারের। তবু অবস্থার বিচারে সবাই একই কাতারে। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করণীয় কী? বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত কয়েক বছরে অনেক শক্ত হয়েছে। তাদের অডিট ও ইন্সপেকশন আগের চেয়ে শক্ত। সরকারী ব্যাংকের বেলায় প্রযোজ্য রয়েছে অধিকন্তু কমার্শিয়াল অডিট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাঠামোগতভাবেও আগের চেয়ে শক্ত। তাদের ক্ষমতাও অফুরন্ত। একটা ক্ষমতা তাদের ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক কোন অনিয়মের জন্য সরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অপসারণ করতে পারত না। এখন তারা তা পারে। এটি একটা সংশোধনীর মাধ্যমে করা হয়েছে। এখন সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদায়ন, অপসারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতিসাপেক্ষ। এটা যেমন বোর্ড করতে পারে, তেমনি এখন থেকে অনিয়মের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারী ব্যাংকের এমডিসহ অন্য ব্যাংকের এমডিদেরও অপসারণ করতে পারে। এতসব সত্ত্বেও অনিয়ম, ঘোরতর অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতির সংখ্যা ব্যাংকগুলোতে খুব বেশি কমছে না। এসব রোধকল্পে অনেক পদক্ষেপই গৃহীত হচ্ছে। তবে ‘আরবিআই’ সাম্প্রতিককালে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার আদলে কিছু একটা করা যেতে পারে। বস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা বিধি বহুদিন থেকে চালু আছে। তিন বছরের বেশি কেউ একই জায়গায়, একই ব্রাঞ্চে কাজ করতে পারবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই বিধি কেউ মানে না। আমি যতটুকু জানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অডিট রিপোর্টে প্রতিবছর এই অনিয়মের কথা তুলে ধরে। কিন্তু খুব কম ব্যাংকই একে গুরুত্ব দেয়। অথচ তা দেয়া উচিত। এতে ব্যাংকেরই লাভ। বলাবাহুল্য, দীর্ঘদিন এক জায়গায় পদায়িত থাকলে সেখানে একটা বৃত্ত তৈরি হয়। এই বৃত্ত দীর্ঘদিন থাকার ফলে ব্যাংকে অনিয়ম উৎসাহিত হয়। এ কথা ব্যাংকের সবাই মানে। কিন্তু নিয়মিত ট্রান্সফার ও পোস্টিংয়ের কাজটি হয় না। ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ একই পদে একই লোককে রেখে অনিয়ম সংঘটন করে। আমি বুঝতে অক্ষম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন তার দীর্ঘকালীন বিধিটিকে বাস্তবায়িত করতে পারছে না। জরুরীভাবে বলছি, এটি ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় করবে না। তারা নানা ওজর-আপত্তি তুলবে। নানা অজুহাতে তারা তা করবে না। এই জায়গায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত হতে হবে। নির্বিচারে এই নীতি বাস্তবায়ন করতে পারলে ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম দূর করা সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বিদেশী ব্যাংকগুলোতে আরেকটা বিধি চালু আছে। প্রতিবছর ব্রাঞ্চে ব্রাঞ্চে ‘অডিট’ হয়। অডিটকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। এটা বাধ্যতামূলক। ‘অডিট টিম’ যাতে বিনা বাধায় তাদের কাজটি নিরপেক্ষভাবে করতে পারে এজন্যই এই ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে বছরের একটা সময়ে কমকর্তাদের ‘ফোর্সড লিভ’ও দেয়া হয়। এর ফলে কর্মকর্তারা সাবধানে থাকে। কোন অনিয়ম হলে তা তারা ‘রেকটিফাই’ করে ফলে। উদারহণ দিই একটা। ধরা যাক ব্যাংকের একজন ক্যাশিয়ার আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানতের টাকা গ্রহণ করছে। সে ‘ডিপোজিট সিøপে’ যথারীতি সই দিয়ে দিচ্ছে। এতে গ্রাহকের কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ক্যাশিয়ার ওই টাকা ব্যাংকের খাতায় না তুলে নিজের ড্রয়ারে রেখে দিচ্ছে। আমানতকারী যখন টাকা তুলতে এলো তখন কোন অসুবিধা নেই। খাতায় এন্ট্রি না হলেও তার নিজের খাতা দেখে সে চেকের টাকা পরিশোধ করে দিল। এটি ধরা পড়তে সময় লাগবে। কিন্তু হঠাৎ করে বিনা নোটিসে যদি ওই ক্যাশিয়ারকে দশ দিনের ছুটিতে পাঠানো হয় তাহলে সে ধরা খেয়ে যাবে। কোন না কোন গ্রাহক টাকা তুলতে এসে দেখবে তার এ্যাকাউন্টে টাকা নেই। এতে ঘোরতর অনিয়ম ধরা পড়ল, ক্যাশ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ল। আমি মনে করি, অবিলম্বে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং তা নির্দয়ভাবে। ছুটিকে একটা ‘মেকানিজম’ হিসেবে ধরে ব্যাংকের প্রচুর ‘ফ্রড এবং ফর্জারি’ উন্মোচন করা যায়। এতে ব্যাংকের কোন খরচ নেই। শুধু ছুটিকে বুদ্ধিমানের মতো হিসাব করে ব্যবহার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়গুলো ভেবে দেখতে পারে। মোদ্দাকথা, বিধি বাস্তবায়নে কঠোরতম হওয়া দরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়ে হবে না। জীবনেও হবে না। এক্ষেত্রে ‘দানবের’ মতো ব্যবহার করতে হবে। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×