ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ছিটমহল বিলুপ্ত

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৩১ জুলাই ২০১৫

ছিটমহল বিলুপ্ত

বিজয় নিশান উড়বে পতপত করে বিলুপ্ত ছিটমহলের ঘরে ঘরে। মুছে যাবে জরা, ঘুচে যাবে গ্লানি। আসবে নতুন ভোর আলোকেরই ঝর্ণাধারা রাঙিয়ে। বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যাবে ‘ছিটমহল’ নামক বিগত ৬৮ বছরের অমানবিক দৃশ্যপট। বিলুপ্ত হবে পরাধীনতার অসহনীয় জীবনধারা। চালু হবে আইনের শাসন। নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা, নাগরিকত্ব। শেষ হবে বঞ্চনার দিনরাত। বিশ্ব মানবের তালিকায় সংযোজিত হবে দীর্ঘদিন ধরে ‘না-মানুষ’ হয়ে থাকা জনরা। ৬৮ বছরের অভিশপ্ত জীবনের ইতি ঘটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় অর্ধ লাখ বাসিন্দা কাক্সিক্ষত নাগরিকত্ব পাবে। দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত ও আইনসিদ্ধ সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের এবং ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল হয়ে যাবে আর কয়েক ঘণ্টা পর ভারতের। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিময় হবে ছিটমহলগুলো। আজ শুক্রবার রাত ১২টার পর বদলে যাবে ভারত-বাংলাদেশের মানচিত্র। বদলে যাবে অর্ধলাখ মানুষের জীবনধারা। ৬৮ বছরের লড়াই সংগ্রাম শেষে এক নতুন জীবনে প্রবেশ করবে বঞ্চিত মানুষেরা। এতদিন নিজ দেশে ছিল যারা পরবাসী। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হলেও ছিটমহলবাসী তার স্বাদ পায়নি। অবশ্য ১৬২টি ছিটমহলের মধ্যে মানুষের বসবাস ১০৬টিতে। এসব এলাকার বাসিন্দারা উড়াবে আজ নিজ নিজ দেশের পতাকা, যে দেশে জন্ম নিয়েও তারা নিজ দেশের নাগরিকত্ব পায়নি। এরা রাজা মহারাজা এবং ব্রিটিশ শাসকদের খেয়ালখুশির শিকার হয়ে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী ‘না-মানুষ’ হয়ে বেঁচে ছিল। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশ শাসনামলে কোচবিহার এবং রংপুরের মহারাজারা তাদের জমিজমার খাজনা ব্রিটিশদের দেয়া বন্ধ করে দেন। এ কারণেই দেশ ভাগের নিয়ম গঠিত বাউন্ডারি কমিশন এসব জমি বাদ দিয়েই দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করে। ফলে পূর্ববঙ্গ ও ভারতের ১৬২ জায়গায় দুই মহারাজার ভূমি থেকে যায়। তাদের ব্যক্তিগত জমি হওয়ায় কোন দেশই ওই সব জমির মালিকানা পায়নি। পরে এগুলো ছিটমহল হিসেবে বিবেচিত হয়। জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ায় প্রজারাই তাদের নিয়ন্ত্রিত জমির মালিকানা পায়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী ছিটমহল হস্তান্তরে চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তি অনুযায়ী সে বছরই ভারতকে বেরুবাড়ি ছিটমহল হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশের সংসদ চুক্তিটিতে সে সময়ই অনুমোদন করে। আর দীর্ঘ ৪১ বছর পর ভারতের সংসদে তা অনুমোদিত হয় সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগে অবশেষে দুই দেশের বঞ্চিত মানুষেরা ফিরে পেল অধিকার, মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। আজ রাতে বিনিময় হবে ছিটমহলগুলো। আগামী ৩০ নবেম্বরের মধ্যে মানুষ বিনিময়ের কাজ শুরু হবে। বিনিময় প্রথায় বাংলাদেশ থেকে সহস্রাধিক বাসিন্দা ভারতে পুনর্বাসিত হবে। তবে ভারত থেকে কেউ আসছে না। যাই হোক, নিজেদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার ক্ষণকে উদযাপন করার পেছনে তাদের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ভেতর রয়েছে তাদের স্বাধীনতা লাভ। আজ রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমের আলোয় ছিটমহল হস্তান্তর হবে। সব বাড়িতে একই সঙ্গে জ্বলে উঠবে ৬৮টি করে মোমবাতি। মোম আর মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে রাত। পাশাপাশি স্মরণ করা হবে সেই সব মানুষকে, যারা ছিটমহল আন্দোলনে নিবেদিত ছিলেন। বিশ্ব মানচিত্রে আজ রাত থেকে যে বদল হবে, তার যাত্রা শুভ হোক- এটাই কাম্য।
×